জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আমাদের স্কুল তখন ব্যস্ত। অষ্টম শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীকে বারুদ বানানোর প্রক্রিয়ায় পুরো স্কুল। আমার বন্ধুবান্ধব সবাই বারুদ হব হব করছিল কিন্তু আমার কোন বিকার নেই। নির্বিকার আমাকে অনেক চেষ্টা করেও কোনদিন এক্সট্রা কোচিং ক্লাসে আনা যায়নি। শিক্ষকমহল এ নিয়ে আমার উপর বেশ মনঃক্ষুণ্ণ ছিল। তারা আমাকে ভবিষ্যৎ ট্যালেন্টফুল বৃত্তিপ্রাপ্ত স্টুডেন্ট মনে করত। কিন্তু আমি আমার ট্যালেন্ট সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিলাম, ফলস্বরূপ বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালাম। পরে অবশ্য এ নিয়ে আফসোস হয়েছিল।
এক্সট্রা কোচিং ক্লাসের স্টুডেন্টদের জন্য অনেক ছাড় ছিল। তাদেরকে স্কুল লাইফের সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস পিটি করতে হত না। কিন্তু আমি যেহেতু কোচিং ক্লাসের বাইরে ছিলাম, তাই আমাকে প্রতিদিন সামনে থেকে পিটি করতে হত। তো একদিন ফরিদ স্যার কোচিং-এর ম্যাথ ক্লাস নিচ্ছিলেন। কোচিং ক্লাস সেদিন আমাদের নিয়মিত ক্লাসরুমে হচ্ছিল। আমি পিটিতে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ক্লাসরুমে ব্যাগ রাখতে গিয়েছিলাম। ক্লাসে প্রবেশের জন্য স্যার থেকে অনুমতি চাওয়াতে অনুমতি পাওয়া দূরে থাক, উল্টো কানে-গালে রাম চড় বসিয়ে দিল। স্যারের ভাষ্যমতে আমি নাকি সেদিন সাড়ে সাংঘাতিক বেয়াদবি করেছিলাম! প্রচণ্ড ব্যাথা পেয়েছিলাম কিন্তু আমি সেদিন কাঁদিনি।
তারপর যথাসময়ে বৃত্তি পরীক্ষা হল, আমি অংশ নেইনি। বৃত্তি পরীক্ষার পরপরই আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বেরোল। আমি অবাক, আমি ফার্স্ট। আমাদের ব্যাচে কখনোই ছেলেরা ফার্স্ট হয়নি, এমনকি থার্ডও না। আমি সরাসরি ৪ নম্বর থেকে ১ নম্বর। সেদিন প্রথম আমি নিজের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস করতে শিখলাম।
জীবনে প্রথম কাপ্তান হিসেবে তারপর ক্লাস নাইনে পদার্পণ। কাপ্তান হয়েও পিছনের বেঞ্ছে বসার সুখ্যাতি অবশ্য আমাদের স্কুলে একমাত্র আমারই ছিল। বিভাগ নির্বাচনের সময় এল, বিজ্ঞান চুজ করলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার এক বন্ধু সনিও বিজ্ঞান বিভাগ চুজ করল। অবাক হওয়ার কারণ, সে স্যারদের বিশেষ বিবেচনায় নাইনে উঠে। আমি অবশ্য অনেক আগে থেকেই তার সবকিছুতে বিস্মিত ছিলাম, সবচেয়ে বিস্মিত ছিলাম তার নামটা নিয়ে। তখন আমি সনি বলতে শুধু টিভিকেই বুঝতাম। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কি করে টিভি একটা মানুষের নাম হতে পারে।
সেই সময় আমাদের স্কুলে নতুন কয়েকটা কম্পিউটার এসেছে। আমাদের হেডস্যারও ছিলেন নতুন। তিনি ডিক্রি জারি করলেন, যেভাবেই হোক চতুর্থ বিষয় হিসেবে কম্পিউটার কমপক্ষে ২০ জনের নেয়া চাই। উনি মূলত বিজ্ঞানের স্টুডেন্টদেরকে লক্ষ্য করেই ডিক্রি চালু করেন। আমি সিলেবাস দেখে আগেই ঠিক করেছিলাম, আমি চতুর্থ বিষয় হিসেবে “হিসাব বিজ্ঞান” নিব, জ্বি এটা “হিসাব বিজ্ঞান”-ই। আমার সিলেকশনে আমি বাদে সবাই অবাক হয়েছিল কিন্তু হেডস্যার হননি। “হিসাব বিজ্ঞান” শুনেই স্যার তার হিসাব চুকিয়ে দিল, চারদিন কোমরে বেতের ইয়া মোটা কালো দাগ ছিল। চারদিন পর দাগ কমল, আমারও কম্পিউটার বই ঘরে আসল।
প্রথম প্রথম তো পড়তে খুব মজাই লাগছিল- বিল গেটস, স্টিভ জবস, এনিয়াক!!! কিন্তু যতই দিন যাচ্ছিল ততই বিরক্তি লাগছিল। আমার মনে পড়ে, প্রথম সাময়িক পরীক্ষার সময় আমি জেদের বশে কম্পিউটার বইয়ের কয়েকটা পেজ ছিঁড়েই ফেলেছিলাম, আর কোনদিন পড়িনি। কিন্তু পরীক্ষা দিতে যেয়ে আমার সমস্ত বিরক্তি মজায় পরিণত হয়। আমাদের স্কুলে কম্পিউটার বিষয় চালু হয়েছিল আমাদের এক বছর আগে। সেই কারণে আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল আমাদের সিনিয়রদের সাথে। আমাদের সিনিয়রদের মধ্যে নাসির ভাই ছিলেন দুষ্টের হাড্ডি। উনি পরীক্ষায় আমার পাশেই বসেছিলেন। পরীক্ষার ৩০ মিনিট যাওয়ার পর উনি জরুরি কাজে টয়লেটে যান। উনি যখন ফিরে আসেন তখন থেকেই কম্পিউটার আমার কাছে মজার বিষয়ে পরিণত হয়। কারণ উনি এসেছিলেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক ১০ মিনিট পর। পরে শুনেছি উনি নাকি বাসায় যেয়ে ঘুমিয়েও এসেছিলেন।
২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেই, কম্পিউটারকে সাময়িক বিরতি দেই। ঠিক ২ বছর পর ভার্সিটিতে উঠে আবার কম্পিউটার নিয়ে পড়তে বসা, এবার তো রীতিমত কাছা বেঁধে নাসির ভাইয়ের মত। ভার্সিটিতে প্রথম দিককার কোন এক ক্লাসে ভ্যাকুয়াম টিউব শুনে আমার সকল বন্ধুবান্ধব যারপরানই অবাক। কিন্তু আমি মনে মনে হাসছিলাম। হাসতে হাসতে আমার মন তখন বিশালাকার যেকোনো একটি ভ্যাকুয়াম টিউবে নাসির ভাইকে চুয়িংগাম দিয়ে আটকে রাখতে চাচ্ছিল। উল্লেখ্য, নাসির ভাই একবার স্যারদের চেয়ারে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছিল, আর তাতে গৌরাঙ্গ স্যার ধরাও খেয়েছিল।