বস্তু পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিসের মধ্যে জীবন খোঁজাই বাউলদের কাজ। জীবন মানে তাদের কাছে সার্বজনীন ভালোবাসা ও বৈরাগ্য। বাউলদের সেই জীবনের খোঁজে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় বাসা থেকে বের হই। নিজের খুব প্রিয় একজন বন্ধুর সাথে শুরু দিনের প্রথম বৈরাগ্য সাধন। দুজন মিলে জীবনের অর্থ সংজ্ঞায়িত করতে করতেই দুপুর ঘনিয়ে এলো। নেই বাসায় যাওয়ার কোন তাগাদা অথবা পূর্বনির্ধারিত কোন কাজের শিডিউল। দুপুর বেলায় ২ জন থেকে বাড়তে বাড়তে ক্রমান্বয়ে একটা সময় ৫ জনে রূপান্তরিত হই। দুপুর শেষে আবারও আমরা ২ জন। পেটের ভিতর রাইচ গ্রেইন না পরলেও, অনেক কিছুই পরেছিল।
শেষ দুপুরে কিছুক্ষণ পার্কের এক কোণায় ছেলেপুলেদের শখের ফুটবল খেলা দেখলাম। বিকেল বেলায় টাউন হলে এসে দুজন মিলে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। সাথে সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণ চলছিল। প্ল্যান ছিল চা খাবো। তা আর খাওয়া হল না, দিলাম ছুট কুমিল্লা রেলওয়ে ষ্টেশনে ট্রেন ধরবো বলে। কোন রকম প্ল্যান ব্যতিত ট্রেন ধরতে চাওয়ার মত পাগলামি করতে মোটেও ভয় পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ, ট্রেন আর ধরা হল না, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে মনে মনে গালি দিচ্ছিলাম। ষ্টেশনে হরেক রকমের মানুষের সাথে দেখা, হরেক রকমের জীবন দেখা। কিছুক্ষণ প্ল্যাটফর্মে তো কিছুক্ষণ রেললাইনের উপর আমাদের বৈরাগ্য সাধন চলছিল।
হরেক কিসিমের মানুষ আসল, গেল- হরেক কিসিমের জীবন উপলব্ধি করলাম। রাত সাড়ে ৯ টায় আমরা আবারো ৩ জন। ৩ বন্ধু মিলে তারপর কখনো হাসি, তো কখনো টেনশন, আবার কখনো বা ভূরিভোজ। রাত পৌনে ১২ টায় পুলিশের চেকিং, নিজেদেরকে মডেস্ট পারসন হিসেবে উপস্থাপন। রাত ১ টায় যখন আবার ট্রেন ধরতে আসি, তখন আমাদের ট্রেন মাসাল্লাহ ৪ ঘণ্টা ডিলেতে চলছিল। ট্রেনের চিন্তা বাদ দিয়ে তখন সেখানে একদল আসল (আমরা নকল) বাউলদের গান শুনতে পাই। সেই রাত দুপুরে আসল বৈরাগ্য খুঁজে পাই।
যতটুকু জানি ‘বাউল সম্রাট’ লালন ১লা কার্তিক আমাদের থেকে অদৃশ্য হয়ে যান। কেউ কেউ বলে সেটা নাকি ১৭ অক্টোবর। কাল ১লা কার্তিক হয়তো নয়, কিন্তু ১৭ অক্টোবর তো। সেজন্য বৈরাগ্য উপভোগে নকল বাউলদের মাঠে নামা (রেল ষ্টেশনে যাদের গান শুনেছিলাম ওরা মোটেও নকল ছিল না)। একটা দিন বাউলদের মত চিন্তা করতে গিয়ে আমরা যে আসলে কতটা অপরিপক্ক সেটা টের পেলাম। অবশেষে ২৯ ঘণ্টা পরে নিজ বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় পৌঁছে বারবার খালি ষ্টেশনের বাউলদের গাওয়া গানটি মনে পরছিল-
নতুন সাইকেল পুরান হইবে
কলকব্জায় জং যে ধরিবে
বেল বাতির ঐ ঠনঠন আওয়াজ
বন্ধ যে হইবে।–––
এক কদম আগে না বাড়বে
হাজার বার মারলেও প্যাডেল
মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল।
মানুষ আসলে একটা দুই চাকার সাইকেল। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর স্যান্ডেল পরা আমি যার বাম চোখটি ফুলে কলাগাছ হয়ে রয়েছে, সে যে আরেকবার একই ধরণের বৈরাগ্য সাধন করতে পারবে, হাজার বার প্যাডেল মেরেও যে তাকে আদৌ নাড়ানো যাবে, সেটা কি কেউ বলতে পারবে?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:২৮