লন্ডন কিভাবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্থাপত্য-শিক্ষা-চিকিৎসা-বিজ্ঞান-দর্শন-খেলাধূলা এবং আভিজাত্যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা নগরী? প্রতি বছর কিসের টানে মিলিয়ন মিলিয়ন ট্যুরিস্ট বৃটিশ সম্রাজ্যের রাজধানীতে আসেন? লন্ডনের প্রথমদিকের দিনগুলোতে এই ভাবনাগুলো মনের গহীনে উঁকিঝুঁকি মারতো। মূলত, সেই অমীমাংসিত উত্তরগুলো খুঁজতে অভিজাত এই নগরীকে জানতে কৌতুহলী হয়ে উঠি। লন্ডনের আকর্ষণীয় স্পটগুলোতে কতশতবার গিয়েছি তার কোন হিসেব নেই, যতবার গিয়েছি ততোবার মুগ্ধ হয়েছি আর উপলব্ধি করেছি একটি শহর কতটুক পরিকল্পিত হতে পারে, শাসকরা কতটুকু দেশপ্রেমিক হতে পারেন, শহরটি কতটুকু নাগরিক বান্ধব হতে পারে? ব্যাচেলর জীবনের সুন্দর দিনগুলোতে ইউনিভার্সিটি কিংবা কাজের ফাঁকে চলতো দুই পা ফেলিয়া, চক্ষু মেলিয়া আবিষ্কারের মিশন।
লন্ডনের হাজারো উল্লেখযোগ্য স্মৃতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ের দিনটি। সেদিন বাকিংহাম প্যালেসের সামনে থেকে সরাসরি দেখেছি রাজসিক এই বিয়ের চাকচিক্য। সেদিন সত্যিকার অর্থেই অনুভব করেছিলাম রাজকীয় বিয়ের উত্তাপ। নিঃসন্দেহে এটি সারা জীবন মনে রাখার মতো একটি স্মৃতি। এছাড়া, ২০১২ সালের অলিম্পিকের কথা তো আছেই। তখন ইস্ট লন্ডনের বড় বোনের বাসায় থাকতাম। অলিম্পিক ভিলেজ ছিল বাসা থেকে মাত্র দুই-তিন মিনিট দূরত্বে আর স্টেডিয়াম ছিল পাঁচ মিনিট হাঁটা দূরত্বে। চোখের সামনেই চলেছে অলিম্পিকের সব প্রস্তুতি। সেই দুর্লভ স্মৃতিগুলো আজো স্মৃতিপটে প্রতিনিয়ত ভেসে উঠে।
শুধু ভালো স্মৃতি থাকবে তা কি হয়? একদিন সেন্ট্রাল লন্ডনের মার্বেল আর্চে (Marble Arch) বাংলাদেশের সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সাথে দেখা। প্রথম দিন কেবলমাত্র হাই-হ্যালো হলেও কাজের সূত্রে পরপর তিনদিন দেখা হওয়ায় কিছুটা খোলামেলা আলাপচারিতার সুযোগ হয়েছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে লন্ডনে এতদিন থাকার কারণ বলতে গিয়ে জানালেন, মে ফেয়ারে (MayFair) একটি বাড়ি কিনতে সপরিবার এসেছেন। দাম ৪.২ মিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ৫০ কোটি টাকা); সাথে তার মানবাধিকার নেত্রী বউ এবং মেয়েও আছেন। সেদিন আমি উনার মুখের উপরে বলেছিলাম, 'শুনেছিলাম মিনিস্টার থাকাকালীন প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশার লাইসেন্স বাবদ আপনি ৫০ হাজার টাকা কমিশন নিয়েছিলেন। এখন কি এই টাকা লন্ডনে বিনিয়োগ করছেন? একটি ছোকরার মুখ থেকে এমন বেয়াদবী সূর তিনি অবশ্য প্রত্যাশা করেননি। এর পরে আরো দু’একবার দেখা হলেও তিনি এড়িয়ে গেছেন। মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়নি।
অসংখ্য ছবি থেকে এসব ছবি চিহ্নিত করা কঠিন। তবুও প্রতিযোগিতার নিয়মের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১২টি ছবি পোস্ট করলাম।
(১) Cutty Sark- (উপরে দেওয়া ছবি) মূলত; ভারত উপমহাদেশে থেকে চা পাতা আমদানীর জন্য ১৮৬৯ সালে স্কটল্যান্ডে জাহাজটি নির্মিত হয়। স্টিম চালিত এই জাহাজটি পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া থেকে ভেড়ার পশম আমদানীতে ব্যবহৃত হয়। লন্ডন থেকে অস্ট্রেলিয়া ছিল তখনকার সময়ে জাহাজের সবচেয়ে লম্বা রুট। জাহাজটি বর্তমানে গ্রিনউইচ পার্কের পাশে থেমস নদীর কিনারে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে। টিকেটের বিনিময়ে যেকেউ 'কাটি সার্ক' এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন। এটি লন্ডনের অন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণ।
(২) Gherkin Tower- লিভারপুল স্ট্রিট, অলগেট এবং ব্যাংক স্টেশনের মাঝামাঝি St. Mary Axe এ অবস্থিত ৪১ তলা বিশিষ্ট 'গার্কিন টাওয়ার' লন্ডনের অন্যতম আইকন বিল্ডিং। আমার সবচেয়ে পছন্দের বিল্ডিং এটি। বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে উপরে তাকালে মন হবে একটি বিশালাকার মার্বেল পাথর হাওয়ায় ঝুলছে। ২০০৪ সালে নির্মিত আইকনিক এই টাওয়ার নির্মাণে খরছ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ছবিটি অলগেট স্টেশনের সামনে থেকে তোলা।
(৩) Royal Observatory, Greenwich- গ্রীণউইচ পার্কের উঁচু টিলায় অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরি বর্তমানে Greenwich Mean Time সংক্ষেপে GMT নামে পরিচিত। ১৬৭৫ সালে কিং চার্লস (২) এটি উদ্ভোদন করেন। টাওয়ারে নির্মিত ঘড়ির কাটার সময়ে সারা পৃথিবীর সময় পরিবর্তন হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এটি দেখতে ভীড় জমায়। সুউচ্চ এই টিলা থেকে লন্ডন শহরের স্কাই লাইন দেখা যায়। বিশেষ করে থেমসের ওপারে 'ক্যানরি অফ' এর উচু বিল্ডিং এবং ডানদিকে ব্লাকওয়েল টানেলের পাশে ডিম্বাকৃতির বিশাল মিলেনিয়াম ডোম দেখা যায়। এছাড়া সিটি এয়ারপোর্টেে বিমান উঠানামার দৃশ্য চোখে পড়ে। হাইড পার্কের পর গ্রীণউইচ পার্ক লন্ডনের অন্যতম ব্যস্থতম এবং সুন্দর পার্ক। Greenwich University, National Maritime Museum, Queen's House এবং Cutty Sark এখানে অবস্থিত।
(৪) Harrods - লন্ডন তথা ইউরোপের অন্যতম লাক্সারি শপিং সেন্টার 'হারডস'। এর বর্তমান মালিক কাতারের রাজ পরিবার। আরব ধনুকুবেরদের সবচেয়ে পছন্দের শপিং প্লেস এটি। লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা নাইসব্রিজে হারডস এর অবস্থান। এক-দুইবার টুকটাক শপিং করলেও দেখার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার হারডসে গিয়েছি। একবার তো সাড়ে পাঁচকোটি টাকা দামের ডায়মন্ডের তৈরী রোলেক্সে একটি ঘড়ি দেখে অবাক হয়েছি। নরমাল লেডিস হ্যান্ড ব্যাগের দাম দশ লাখ টাকা! অবাক না হয়ে উপায় নেই।
(৫) Wellington Arch (Hydepark corner)- লন্ডনের সবচেয়ে ব্যস্ততম রাউন্ড এবাউট হাইড পার্ক কর্ণারে ওয়েলিংটন আর্চ অবস্থিত। বাকিংহাম প্যালেস, ভিক্টোরিয়া স্টেশন, পিকাডিলি সার্কাস, মার্বেল আর্চ এবং নাইস ব্রিজের রাস্তাগুলো এই রাউন্ড এবাউটে এসে মিলেছে। কেউ কেউ ওয়েলিংটন আর্চকে কনস্টিটিউশন আর্চও বলে থাকেন। মার্বেল আর্চ এবং ওয়েলিংটন আর্চ একটা সময় বাকিংহাম প্যালেসের সামনে থাকলেও ১৮২৫ সালে কিং জর্জ (৪) এগুলো হাইড পার্কের দুই পাশে স্থানান্তরিত করেন।
(৬) Stratford Bus Station- এটি লন্ডনের সবচেয়ে সুন্দর বাস স্টেশন। স্টেশনের ঠিক সামনে সুবিশাল রেল ও মেট্রো স্টেশন। আর স্টেশনের ডানদিকে বিখ্যাত 'ওয়েস্ট ফিল্ড' শপিং সেন্টার। ২০১২ সালের অলিম্পিকের জন্য স্টেশনটি নতুন করে সাজানো হয়েছে। অলিম্পিক স্টেডিয়াম এং অলিম্পিক ভিলেজ স্টেশনের পাশেই অবস্থিত। ২০১২ সালের অলিম্পিকের সময় দক্ষিন আমেরিকান একদল বংশিবাধক পর্যটকদের বিনোদন দিচ্ছেন ল্যাটিন মিউজিক আর বাঁশিতে। লন্ডনে এরকম অসংখ্য স্ট্রিট মিউজিশিয়ান দেখা যায়। মূলত মানুষকে বিনোদিত করে টাকা নেয় এরা। দর্শকরা খুশি হয়ে এক-দুই পাউন্ড বকশিস দিলেই তারা খুশি।
(৭) Buckingham Palace- কুইন এলিজাবেথের অফিসিয়াল রেসিডেন্স হচ্ছে 'বাকিংহাম প্যালেস'। যদিও বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি উইনজার ক্যাসেলে থাকেন। রাষ্ট্রীয় কাজে এবং বিদেশি অতিথিদের ভোজসভা কিংবা কোন অনুষ্ঠানের আয়োজক রানী হলে তিনি বাকিংহাম প্যালেসে আসেন। রাণীর ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি কেউ এই প্যালেসে থাকেন না। তাদের সবার জন্য আলাদা প্যালেস রয়েছে। ছবিটি ২০১১ সালের ২৯শে এপ্রিল প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ের দিন তুলেছি। ওয়েস্ট মিনিস্টার আবেতে বিয়ে সেরে বাকিংহাম প্যালেসে ফিরে ঐতিহ্য মাফিক রাজা-রানী সহ পরিবারের সবাই এই বেলকনিতে এসে উপস্থিত দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্য হাত নাড়েন। রাজকীয় বিয়ে এতো জমজমাট হয় তা সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম। প্রিন্স উইলিয়ামের পাশাপাশি রাণীও সেদিন ঘোড়া টানা সুদৃশ্য পালকি চড়ে চার্চে গিয়েছিলেন।
(৮) Lords Cricket Ground- শুধু লর্ডস (Lords) বললেই পৃথিবীর ক্রিকেটপ্রেমী সবাই এক নামে চিনে। ক্রিকেটের মক্কা হিসাবে আমরা তাকে চিনি। সেন্ট্রাল লন্ডনের সেন্ট জনস্ উডে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে অভিজাত এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামটির অবস্থান। Marylebone Cricket Club স্টেডিয়ামেটির মালিক। Middlesex Country Cricket Club এর হোম গ্রাউন্ড এটি। ECB এবং ইউরোপীয় ক্রিকেট হেডকোয়ার্টার এখানে অবস্থিত। ২০০৫ সালের আগপর্যন্ত এখানে আইসিসির হেড অফিস ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ক্রিকেট মিউজিয়াম এখানে। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা এবং ইংল্যান্ডের মধ্যকার ওয়ানডে খেলা দেখতে গিয়ে ছবিটা তোলা। স্টেডিয়ামটি এতোই দৃষ্টি নন্দন মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
(৯) Oxford Street- ইউরোপের সবচেয়ে ব্যস্ততম এবং লম্বা শপিং স্ট্রিট হচ্ছে 'অক্সফোর্ড স্ট্রিট'। শপারদের সিংহভাগই পর্যটক। বিশেষ করে আরব ধনীরা। এছাড়া পাশের বন্ড স্ট্রিট এবং রিজেন্ট স্ট্রিটও শপিং মলে ভরপুর। বিবিসি হেডকোয়ার্টারের একটু সামনেই ছবিটি তোলা। ক্রিসমাস টাইম হওয়ায় হরেক রকম লাইটের বাহারি আয়োজন ছিল। লন্ডনের বিখ্যাত 'সেলফারেজ শপিং মল' এখানে অবস্থিত। লন্ডনের ব্লাক ক্যাবের অন্যতম বিজি রুট এটি।
(১০) London Eye- লন্ডনের সবচেয়ে বড় টুরিস্ট আকর্ষণ এটি। মন খারাপ হলে প্রায় সময় লন্ডন আইয়ের নিচে গিয়ে উপরে তাকিয়ে বিশাল হুইল/ক্যাপসুল দেখতাম, হাজার হাজার পর্যটকের আগ্রহ আর উদ্দীপনা দেখে মনটা ভালো হয়ে যেত। প্রতি বছর প্রায় ৩০ লক্ষ দর্শনার্থী লন্ডন আই ভিজিট করেন। হুইলটিতে ৩২টি ডিম্বাকার ক্যাপসুল চেম্বার রয়েছে। প্রতিটি ক্যাপসুলের ওজন ১০ টন। একেকটি ক্যাপসুলে ২৫ জন পর্যন্ত দর্শনার্থী উঠতে পারেন। ছবিটি ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজ থেকে তোলা। পাশেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং মাথার ঠিক উপরে বিগ বেন (বর্তমানে কুইন এলিজাবেথ টাওয়ার)।
(১১) Downing Street- ট্রাফালগার স্কয়ার পার হয়ে হোয়াইট হলের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে হাতের ডানদিকে ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টেশনের একটু আগেই ডাউনিং স্ট্রিট এর অবস্থান। ডাউনিং স্ট্রিটে পারমিশন ছাড়া প্রবেশের সুযোগ নেই। বাইরে খুব মজবুত স্টিলের গেইট এবং সশস্ত্র সিকিউরিটি আছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং উপ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং অফিস এখানে অবস্থিত। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ট্রেজারী সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস আছে। এখান থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ২ মিনিট হাঁটা দূরত্বে এবং বাকিংহাম প্যালেস ১০ মিনিট হাঁটা দূরত্বে।
(১২) St. Katherine Dock- এটি মূলত প্রাইভেট ইয়ট রাখার জায়গা। টাওয়ার ব্রিজের পাশে এবং থেমস নদীর তীর ঘেসে এর অবস্থান। ব্রিটেনের বিলিয়নিয়ার/মিলিয়নিয়ার সৌখিন ধনীরা তাদের প্রমোদ তরী এখানে রাখেন। একটা সময় জাহাজের মাল উঠানামার জন্য এই ডক ব্যবহৃত হতো।
ছবিগুলো আমার SAMSUNG NX300 ক্যামেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:১৪