মালালা ইউসুফজাই, যিনি তালেবান অধ্যুসিত পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় তালেবানের নির্দেশ অমান্য করে স্কুলে যেতেন এবং স্থানীয় মেয়েদের স্কুলে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। মূলত, শিক্ষা অনুরাগী বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি ভয়কে জয় করেছিলেন।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর, স্কুলের বাসে একজন বন্দুকধারী তাকে চিহ্নিত করে তিনটি গুলি করে, যার মধ্যে একটি তার কপালের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে চামড়ার তলা দিয়ে তার মুখমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে কাঁধে প্রবেশ করে। পরবর্তী বেশ কয়েকদিন তিনি অচৈতন্য ছিলেন ও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হলে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনের বার্মিংহ্যামে কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
২০১৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। নারী শিক্ষা নিয়ে তার আবেগ/আগ্রহ/সংগ্রামকে আমরা সম্মান করি। তাই বলে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাকে নোবেল পুরস্কার দিতে হবে? বাকি জীবনের নিজের সত্যিকারের কোন উল্লেখযোগ্য অর্জনের জন্য নোবেল কমিটি কি তাকে আরেকটি নোবেল দেবে!
সম্প্রতি বিখ্যাত মার্কিন ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ-এর ব্রিটিশ সংস্করণের প্রচ্ছদ তারকা হয়ে ২৩ বছর বয়সী মালালা বলেন, 'আমি এখনো বুঝি না মানুষ কেন বিয়ে করে? আপনার জীবনে যদি একজন মানুষের দরকার হয়, তাহলে কেন আপনাকে বিয়ের কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে? কেন শুধুমাত্র এটি এক ধরনের পার্টনারশিপ হতে পারে না?'
মালালার এই মন্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীল সমাজে সমালোচনার ঝড় উঠে।
শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার (Nobel Peace Prize), নোবেল পুরষ্কারের পাঁচটি বিভাগের মধ্যে অন্যতম। ডিনামাইটের আবিষ্কারক বিখ্যাত সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল (Alfred Nobel) ১৯০১ সালে এটি প্রবর্তন করেন। নোবল পুরষ্কারের অন্যান্য বিভাগগুলো হলো: রসায়ন বিজ্ঞান (Chemistry), পদার্থ বিজ্ঞান (Physics), চিকিৎসা বিজ্ঞান (Physiology or Medicine) এবং সাহিত্য (Literature)। প্রতি বছর নোবেল শান্তি পুরষ্কার নরওয়ে থেকে দেওয়া হলেও বাকি সব বিভাগের পুরষ্কার সুইডেন থেকে দেওয়া হয়।
নোবেল শান্তি পুরষ্কার গ্রহীতা নির্বাচন করেন পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি জুরি কমিটি, যারা নরওয়ের সংসদ (Parliament of Norway) দ্বারা নির্বাচিত। প্রতি বছর ১০ই ডিসেম্বর নরওয়ের রাজধানীর 'অসলো সিটি হল'-এ আনুষ্ঠানিকভাবে পুরষ্কারটি প্রদান করা হয়।
শুরু থেকে আজ অবধি নোবেল কমিটির অদূরদর্শীতা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্টান শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। যা পুরষ্কারটির মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আজ এমন কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোকপাত করবো।
১৯৭৩ সালে আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা লি ডুর থোয়ের (Le Dur Tho) সাথে যৌথভাবে পুষ্কারটির জন্য মনোনীত হন। তখন ভিয়েতনামের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিরতি চলছিল। সে সময় তিনি অনেকটা কৌশলে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে একের পর এক বোমা ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এতে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়। তাঁর এ কূটকৌশল বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এজন্য তার শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের ঝড় উঠে।
প্রতিবাদস্বরুপ লি ডুর থো যৌথভাবে তার সাথে শান্তি পুরষ্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। এর কিছুদিন পর প্রতিবাদে সিলেকশন কমিটির দুইজন সদস্য নোবেল কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' কিসিঞ্জারের নোবেল প্রাপ্তীকে 'নোবেল ওয়ার প্রাইজ' বলে সমালোচনা করেছিল। বিখ্যাত আমেরিকান কূটনৈতিক জর্জ বোল 'ওয়াশিংটন পোস্ট' পত্রিকায় লিখেছিলেন, 'The Norwegiens must have a sense of humour' অর্থাৎ নরওয়ের নাগরিকদের অবশ্যই কাণ্ডজ্ঞান থাকাটা জরুরী।
অং সান সুকি ১৯৯১ সালে তার "Non violent struggle for democracy & human rights" এক্টিভিটির জন্য শান্তিতে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। সে সময় তিনি মায়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের জেলে দীর্ঘদন থেকে বন্ধী ছিলেন। বিশ্ব জনমত তার শান্তিপূর্ণ গনতান্ত্রিক আন্দোলন, দীর্ঘ কারাবাস ও নির্যাতিত মানুষের নেত্রী হিসাবে এ অর্জনকে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু ২০১১ সালে তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল মায়ানমারের ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন বিতর্কীত কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি সমালোচিত হন। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নিধনে তাঁর নীরব ভূমিকার জন্য।
রোহিঙ্গারা বার্মার আটটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর অন্যতম হলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের তিনি মায়নমারের নাগরিক হিসাবে অস্বীকৃতি জানান। মায়ানমারের সামরিক সরকার ১৯৮২ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিকত্ব সনদ বাতিল করে। শত শত বছর থেকে রোহিঙ্গারা মায়ানমারে বসবাস করলেও অং সাং সুকির ভাষায় এরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা অবৈধ নাগরিক। তাঁর এ মতবাদ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। জাতিসংঘ সহ বিশ্বের বড় বড় সব মানবাধিকার সংগঠন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও অসন্তোষ জানায়। হাজার হাজার মানুষ তার নোবেল শান্তি পুরষ্কার বাতিলের জন্য রাস্তায় নামে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার মাত্র নয় মাসের মাথায় নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান। ক্ষমতার সামান্য এ সময়ে তাঁর এমন কোন উল্লেখযোগ্য অবদান না থাকায় নোবেল কমিটির এ সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। নোবেল কমিটির এ সিদ্ধান্তে ওবামা নিজেও বিষ্মিত হয়েছিলেন। এমনকি ওবামার অনেক সমর্থকও তাঁর নোবেল প্রাপ্তিকে নোবেল কমিটির ভূল বলে সমালোচনা করেন। ২০১৫ সালে নোবেল ইন্সটিটিউটের সাবেক পরচালক এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তাঁর শাসনামলে লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের (ISS) উত্তানের জন্য তাঁর প্রশাসনকে অনেকেই দায়ী করেন।
অভিযোগ আছে সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাত করার জন্য আইএস সহ অনেক জঙ্গি সংগঠনকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগীতা করেছিল ওবামা প্রশাসন। যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। গত কয়েক বছরে লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের নৃশংস অত্যাচারে কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ সন্ত্রাসী সংগঠনটির কার্যক্রম এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। যা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরুপ।
২০০৯ সালে যে বছর বারাক ওবামা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, সে বছর অনেকেই ভেবেছিলেন আফগানিস্তানের বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মী ছিমা ছামের (Sima Samar) শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেতে যাচ্ছেন। এজন্য বারাক ওবামার নাম ঘোষণা হওয়ার পর অনেকেই বিষ্মিত হয়েছিলেন।
২০০৬ সালে ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়। বিশ্বব্যাপী 'ক্ষুদ্রঋণ' ধারণার পরবর্তনের জন্য তিনি এই পুরস্কার পান। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ (micro finance) তো অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক উচ্চ সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিকল্প হিসাবে বিনা জামানতে দরিদ্র মানুষদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে এই ঋণের কর্মসূচি চালু করে। সে হিসাবে এই সফলতার জন্য তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন। শান্তিতে কেন? নরওয়েজিয়ান কোম্পানী টেলিনোরকে (Telenor) গ্রামীণ ফোনের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার পার্টনার করার পুরস্কার কি এই শান্তি মেডেল?
এছাড়াও ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রেরর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্ডেল হোল (Cordell Hull), ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সা'দাত (Anwar Sadat), ১৯৮৯ সালে দালাই লামা (DalaiLama), ১৯৯২ সালে রিগোবার্টা মেঞ্চু (Rigoberta Menchu), ১৯৯৪ সালে ইয়াসির আরাফাত (Yasser Arafat) ও শিমন পেরেজ (Shimon Peres), ২০০২ সালে জিমি কার্টার (Jimmy Carter)।
২০০৪ সালে কেনিয়ান ওয়াংরি মাতাই (Wangari Maathai), ২০০৭ সালে আল গোর (Al Gore), ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (EU); এদের নোবেল প্রাপ্তিও সমালোচনার উর্ধ্বে ছিল না।
২০০৬ সালে নোবেল ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক গিওর লুন্ডেস্টড্ (Geir Lundestad) দুঃখ করে বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর (Mahatma Gandhi) নোবেল পুরষ্কার না পাওয়াটা নোবেল কমিটির ইতিহাসের অন্যতম বড় ভূল। মহাত্মা গান্ধী নোবেল শান্তি পুরষ্কারের ছোট্ট তালিকায় পাঁচবার নমিনেশন পেয়েছিলেন, কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে তাকে কখনো মনোনীত করা হয়নি।
ফটো ক্রেডিট-
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০২১ সকাল ৯:৪১