এদেশের সিংহভাগ ছেলেমেয়ে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই জীবনের লক্ষ্য/উদ্দেশ্য ঠিক করে নেয়ে। স্কুলের পরীক্ষায় বড় বড় রচনা লিখতে হয় এই বিষয়ে। এজন্য পরীক্ষা পাশের জন্য হলেও না বুঝে ছাত্রদের 'এইম ইন লাইফ' মুখস্থ করতে হয় দিনকে রাত করে।
না, ভুল বলেছি। জীবনকে জানার আগেই জীবনের উদ্দেশ্য সন্তানের মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। সকাল-বিকাল গম্ভীর বদনে বারবার সন্তানকে স্বরণ করিয়ে দিচ্ছেন 'বড় হয়ে তোমাকে অবশ্যই ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনয়ার হতে হবে, সচিব হতে হবে, বিচারক হতে হবে, পুলিশ অফিসার হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কখনো বলা হয় না, 'তোমাকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে, তুমি জীবনে যা কিছু করো না কেন 'মানুষ' হতে না পারলে তোমার সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। না, এই কথাগুলো কখনো বলা হয় না। বাচ্চাদের এসব পেশা সম্বন্ধে কোন প্রকার ধারণা না থাকার পরও 'এইম ইন লাইফ' মগজে গেঁথে নিচ্ছে নিজের অজান্তেই।
কিন্তু, বড় হয়ে সবাই গন্তব্যে যেতে পারে না, যায় না কিংবা যাওয়ার সুযোগ হয় না। যারা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মনে করেন আমি 'এলিট' লেভেলে চলে এসেছি। তার পদের চেয়ে একটু ছোট কাউকে 'মানুষ' বলে মনে হয় না তার। কারণ, জীবনে কখনে মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা অর্জন হয়নি। নিজের উচ্চ পদের সাথে বাপ-মা যদি আগে থেকেই 'এলিট' লেভেলের কেউ হয়ে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। তিনি 'এলিট বর্গ' হয়ে উঠেন। কথায়-কাজে, উঠায়-বসায় চলে খবরদারি, আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর পায়তারা আর দাম্ভিকতার প্রদর্শনী।
এলিটদের দ্বারা 'সাধারন' নাগরিক যখন পথে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে অপদস্ত/অপমানিত হন, নিজের পকেট ফাঁকা করে সর্বশান্ত হন তখন বাড়িতে ফিরে নিজের সন্তানকে 'এলিট' বানাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ফলে এই চক্র আবর্তিত হচ্ছে বৃত্তাকারে।
এলিফ্যান্ট রোডে গতকাল 'ডাক্তার-ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ' যে ত্রিমুখী ক্ষমতার দম্ভ দেখলাম তা এই এলিট-এলিট খেলার বহিঃপ্রকাশ। কথার মারপ্যাচে কিংবা অন্য কোন কারণে মানুষের রাগ উঠতেই পারে। মেজাজ হারিয়ে অনেক সময় মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। এজন্য অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা শিষ্টাচার বহির্ভূত এই ঘটনা নিয়ে কিছু বলবো না। আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়।
করোনার ভয়াবহ সংক্রমন ঠেকাতে চৌদ্দ এপ্রিল থেকে সরকার দেশব্যাপী এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি, বলা হয় জরুরি প্রয়োজনে যাদের বাইরে যেতেই হবে তারা যেন নিজ উদ্যোগে 'মুভমেন্ট পাস' সংগ্রহ করেন এবং যাদের মুভমেন্ট পাস লাগবে না তারা যেন নিজেদের আইডি সাথে রাখেন। পুলিশ-ডাক্তার সহ করোনা মোকাবেলার ফ্রন্টলাইনারাও এই আইনের আওতায় পড়েন। এখন আমি যদি ডাক্তার হই, পুলিশ হই, দায়িত্বশীল কোন কর্মকর্তা হই তাহলে সমাজের সবচেয়ে সচেতন নাগরিক হিসাবে তা সংগ্রহ করে সাথে রাখা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এই এক সপ্তাহ তো সচেতন নাগরিক হিসাবে এই আইন মানা উচিৎ। এর ব্যত্যয় ঘটলে এর দায়ভারও নিজের কাঁধে নিয়ে দায়িত্ব অবহেলার কথা স্বীকার করা উচিৎ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ডাক্তার ভদ্রমহিলার আচরণে তার ছিটেফোঁটাও দেখা গেলো না। উনার আচরণে মনে হয়েছে উনি বুঝাতে চাইছেন, 'আমি দেশের নামকরা একটি মেডিকেলের অনেক বড় একজন ডাক্তার, আমার বাবার ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা, পুচকে মাজিস্ট্রেট আমার আইডি চেক করার স্পর্ধা দেখায়, পুলিশ ম্যাডাম ম্যাডাম বলে স্যালুট না করে চোখে চোখ রেখে আইডি দেখতে চাওয়ার মতো সাহস দেখায়! কিছুক্ষণ পরে বাস্তবেও দেখলাম উনার ক্ষমতার হাত কত লম্বা। গাড়ি থেকে নেমে মেবাইল ফোন হাতে নিয়ে যখন পুলিশ অফিসারকে বারবার ক্ষমা চাইতে আদেশ করলেন তা খুবই দৃষ্টিকটু ছিল। মাজিস্ট্রেটও ছিলেন খুবই অসহায়।
আমরা অনেকেই জানি না কিংবা মানি না, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যখন যে ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন বাকি সবাইকে বাধ্যতামূলক তাদের দায়িত্ব পালন করতে সহযোগিতা করতে হয়। এটাই নিয়ম। একজন মাজিস্ট্রেট একটি প্রতিষ্ঠান, একজন পুলিশ অফিসার একটি প্রতিষ্ঠান; আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগফল হলো রাষ্ট্র। আমি কার মেয়ে, কার পোলা, কার বউ, কার শালা এসব মোটেও বিবেচ্য নয়। আমার হাত কত লম্বা তা দেখানো রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ঘটনায় খুব খারাপ একটি বার্তা জাতির কাছে পৌঁছিল, 'এদেশে আইন সবার জন্য নয়, সবাই আইন মানতে বাধ্য নয়, আইনের শাসন শুধু দুর্বলের জন্য প্রযোজ্য।' স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের এই বছরে আমরা এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সবার জন্য সমান হয়ে উঠতে পারেনি। দুর্ভগ্যজনকভাবে আমাদের প্রতিনিয়ত স্বরণ করিয়ে দেওয়া হয় এদেশটা কারো নিজের/কারো স্বামীর/করো মুক্তিযুদ্ধা বাবার। আর, আমরা যারা এসবের বাইরে তাদের পরিচয় হলো 'মুক্তিযুদ্ধা বাবা/স্বামীর দেশের সাধারন পাবলিক।'
ছোট্ট একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। ২০১৩ সালের কথা। লন্ডন অক্সফোর্ড স্ট্রিটে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম। পিক আওয়ার থাকায় প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ির নড়চড় নেই। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) আমার ঠিক বাম পাশে সাইকেল নিয়ে ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই হ্যালো বললে তিনিও প্রতি উত্তর করলেন। দুই-তিন মিনিটের রাস্তা পার হতে আমাদের বিশ মিনিটের মতো লেগেছিল। অধৈর্য্য হয়ে অনেকে মেয়রকে পেছনে ফেলে ফুটপাত দিয়ে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেও মেয়র তা করেননি। সেদিন তার ধৈর্য্য আর দায়িত্বশীলতার যে চাক্ষুষ সাক্ষী হলাম তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, লন্ডনের মেয়র বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর পর লন্ডন সিটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২১ রাত ১২:৪৫