'অমর একুশে বইমেলা' প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম তারিখ থেকে শুরু হলেও এবার করোনা মহামারির জন্য তা মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে। বাংলা একাডেমি আয়োজনটা যাতে সফল হয় সে চেষ্টার কোন কমতি রাখে না। বইমেলাটি লেখক-পাঠক-প্রকাশকের একটি মিলনমেলায় রূপ নেয়। এতো বেশি প্রকাশনীর অংশগ্রহণে মাসব্যাপী চলা বইমেলা পৃথিবীর কোথাও হয় না। সে হিসাবে এমন আয়োজন জাতি হিসাবে বিশ্বদরবারে আমাদের মুখ উজ্জল করছে। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার, জাতীয়তা, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রসারে এই আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজন্ম বইমেলাকে উপলক্ষ করে বই কিনতে আসে। বইমেলায় গিয়ে লেখকদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়। তরুণ লেখকেরা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছ থেকে পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা পায়।
অমর একুশে বইমেলা শুরু হওয়ার সময় থেকে প্রতি বছর মেলার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে। লেখকের সংখ্যা বাড়ছে। মেলা শেষে বই বিক্রির রেকর্ড হচ্ছে। এগুলো নিশ্চয় ইতিবাচক দিক। কিন্তু বাস্তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বইমেলার আয়োজন তা কি প্রতি বছরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে? বইমেলায় বিক্রিত বই কিংবা বইমেলাকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশিত বই অনলাইনে বিক্রি, পাঠক চাহিদা এবং রুচির বিচারে সত্যিকারের সাহিত্যিের মানসম্পন্ন বই কি আলোচিত হচ্ছে? কিংবা এসব বইয়ের লেখকেরা পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছেন?
তরুণ প্রজন্ম বইমেলা থেকে যেসব বই সংগ্রহ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেসব বইয়ের সাহিত্যমান কতটুকু কিংবা আদৌও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বই কিনা? এসব প্রশ্ন এসেই যায়। তথাকথিত মোটিভেশন, ধর্মীয় বই, ভাষা শিক্ষার বই কিংবা রান্না শেখার বইও মলাটবন্দী বই। আমারা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যে গাইড বই পড়ি/পড়তাম সেগুলোও বই। আর গাইড বই হলো এদেশে বিক্রিত বইয়ের তালিকায় সবার উপরে। আমরা এসব গাইড বই সুন্দর মোড়কে কিনলেও বেশিরভাগ সময়ই শুধু প্রকাশনীর নামটি দেখি; লেখকের নামটি আমরা খুব একটা খেয়াল করি না। এসব বইয়ের লেখকেরাও কোথাও জোর গলায় বলেন না, 'অমুক গাইড বইয়ের লেখক আমি।'
বইমেলা শেষে যখন কোন বই বিক্রির অনলাইন শপ থেকে প্রকাশ করা হয় অমুক ক্যাটাগরিতে বইমেলার সর্বাধিক বিক্রিত বই তমুক। তখন পাঠক হিসাবে আগ্রহী হয়ে উঠি, জানার চেষ্টা করি। মটিভেশন, ধর্মীয় বই, ভাষা শিক্ষার বই, রান্নার বই আর ইউটিউভ শেখার বই ইত্যাদি যদি তালিকার শীর্ষে থাকে তাহলে প্রতি বছর এতো বড় আয়োজনে বইমেলা করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই থাকে। এই তালিকা তৈরীতে কোন প্রতিষ্ঠান যদি 'বইমেলা' শব্দটি জুড়ে দেয় তাহলে বাংলা একাডেমির দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে গভীর মনোযোগে দৃষ্টিপাত করা।
বাংলা একাডেমি বইমেলা চলাকালীন প্রতিদিন প্রকাশিত বইয়ের নাম মাইকে প্রকাশ করার পাশাপাশি যদি বইমেলা শেষে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সেরা বইগুলোর তালিকা প্রকাশ করতো তাহলে লেখক-পাঠকরা উপকৃত হতেন। ভালো বইয়ের লেখকেরা উৎসাহিত হতেন। পাঠকরাও এসব বই সংগ্রহ করতে আগ্রহী হতেন।
প্রতি বছর বাংলা একাডেমি দশজন কবি, সাহিত্যিককে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার দিয়ে থাকে। পুরষ্কার প্রাপ্ত এসব গুণী লেখকদের নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করার দায়িত্ব কি বাংলা একাডেমি কখনো পালন করেছে? এরা তো হঠাৎ করে পুরষ্কার পাননি। দীর্ঘদিন থেকে ভালো লিখে দেশের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। খোঁজ নিলে দেখবেন, পুরষ্কার প্রাপ্ত এসব লেখকদের সিংহভাগকে তরুণ প্রজন্ম চেনে না। এজন্য তাদের বইও পড়ে না। এসব লেখকদের সাহিত্যকর্ম জাতির সামনে তুলে ধারার দায়িত্ব কার?
প্রকাশনী কি দায়িত্ব পালনে সক্ষম কিংবা আন্তরিক?
বইমেলা আসলে হাজারো প্রকাশনীর স্টল থাকে। এসব প্রকাশনীর একটা বড় অংশই নাম সর্বস্ব। বইমেলায় অংশগ্রহণের সাইনবোর্ড দেখিয়ে নতুন লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই করে সারা বছর নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। এদের না আছে পেশাদারিত্ব, না আছে লেখকদের প্রতি দায়বদ্ধতা। বইমেলায় স্টলে এক-দু'জন সেলসম্যান থাকলেও এসব নামসর্বস্ব প্রকাশনীর প্রকাশক স্টলে কখনো আসেন না। এরা সারা বছর বইমেলায় বই বের করার জন্য নতুন লেখকদের মশাল জালিয়ে খোঁজে। ফলে প্রতি বছর বইমেলার কলেবর বাড়লেও পেশাদার প্রকাশনী সংস্থার সংখ্যা বাড়ছে না।
একটি দেশে যখন বাক স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ হয়, হাজার বছরের সংস্কৃতির চর্চার পথ রুদ্ধ হয় তখন এই শুণ্যস্থান পূরণ করে উগ্রবাদ, কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোড়ামী। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার তখন বধির হয়ে বিকল্প উপায়ে বিনোদন চায়। নিজেদের চরম হতাশা আর অন্ধকার ভবিষ্যতকে জয় করতে মটিভেশন চায়। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার নামে ইংরেজি শিখে দেশত্যাগ করতে চায়। এদের একটি বড় অংশ হতাশ হয়ে ধর্মের নামে উগ্রবাদী ধ্যান ধারণায় মটিভেট হয়।
বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাশ, শতভাগ পাস ইত্যদির খেসারত দিচ্ছি আমরা। পরিবার থেকে সন্তানদের দিয়েছি দিনের পর দিন চব্বিশ ঘন্টা পাঠ্যবই গিলে খেয়ে, মুখস্থ করে বড় বড় সার্টিফিকেট আর বড় চাকরি পাওয়ার দিকনির্দেশনা। ভালো মানুষ হওয়া, দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য চর্চা, জাতীয়তাবোধ আর মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে কখনো মনযোগ দেইনি। ফলাফলস্বরূপ নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশই ধর্মীয় গোঁড়ামী আর রাজনৈতিক গোলামীতে মত্ত। এরা কৌতুহলী হয় না, যুক্তিবাদী হয় না, স্বাধীন মতের দিশা পায় না। তারা জানে, টাকার মেশিন হতে হলে বিসিএস গাইড মুখস্থ করতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে হবে। মাথা পরিপক্ব না হওয়ায় চিন্তাশক্তি খুব দুর্বল হয়। ফলে চিন্তা-চেতনা সাম্প্রদায়িক হয়। অন্য মত আর পথকে রুদ্ধ করতে জান কোরবান করতেও দ্বিধা করে না।
একটি প্রগতিশীল সরকার দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতায় থাকার পরও এদেশে ধর্মীয় উস্কানি কমেনি। ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান বাড়েনি। গ্রামে-গঞ্জে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমনকি দেশাত্মবোধক/বাউল গানের আয়োজন করা এখন কঠিন হয়ে গেছে। এসবের বিরোধিতা কোন প্রবীণ নয় তরুণেরাই করছে। এদের কাছে ধর্মীয় উসকানিমূলক মাহফিলগুলো হলো বিনোদন। আর যিনি মাহফিল মাতিয়ে উগ্রবাদীতাকে বৈধ করে বক্তব্য দিচ্ছেন আর দেশীয় সংস্কৃতিক চর্চাকে হারাম বলে প্রচার করছেন তাদের লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। এসব বক্তাদের মধ্যে যাদের লেখায় এবং বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি বেশি থাকে এবং আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, উৎসব এবং সাহিত্য চর্চার বিরোধিতা এবং প্রগতিশীল লেখক/কবিদের নিয়ে বিরুপ মন্তব্য/বিরোধিতা থাকে তারাই আজ নতুন প্রজন্মের কাছে হিরো। ফলাফলস্বরূপ মগজ ধোলাইয়ের শিকার হচ্ছে সোনালী প্রজন্ম।
আবার বইমেলা প্রসঙ্গে আসি। একটি প্রকাশনীর ক্যাটালগ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি এবারের বইমেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ষোলটি বই বেরিয়েছে। শুধু বইয়ের নাম উনিশ-কুড়ি করেই বইগুলো ছাপানো! প্রতি বছর কয়েক'শো লেখক শুধু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কপি-পেস্ট করে বই লিখছেন। আমিও চাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হোক, নতুন প্রজন্ম জাতির জনকের অবদান জানুক। কিন্তু এসব লেখকেরা যদি অতি উৎসাহি হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অতিরঞ্জিত করে একটি প্যারাও লিখেন তাহলে এটা বঙ্গবন্ধুর জন্য মোটেও সম্মানজনক নয়। আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন করে লিখার কিছু যদি থেকেও থাকে তাহলে তা হবে গবেষণালব্ধ বই। যে কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই লেখা এবং সেন্সরশিপ না করে তা বইমেলায় প্রকাশ করা কতটুকু যৌক্তিক তা সরকারের বিবেচনায় থাকার দরকার।
বইমেলায় তোলা তিনটি ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:৫১