ঢাকার বাইরে বসবাস করি বলে প্রতিদিন গ্রন্থমেলায় যাওয়ার সুযোগ হয় না। এ পর্যন্ত পাঁচদিন ঢাকার বইমেলায় ছিলাম, শেষ দু'দিনও থাকবো আশা করছি। দেখা হয়েছে নাম-পরিচয় না জানা অনেক পাঠক ও শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে। সবচেয়ে আনন্দদায়ক ছিল সামুর গুণী ব্লগারদের সাক্ষাৎ পাওয়া। কেউ কেউ স্টলে (উৎস প্রকাশন, প্যাভিলিয়ন ৩২) এসে খুঁজে গেছেন বলে আফসুস করেছি। আর আমাদের নীলদার 'এক রঙা এক ঘুড়ি' স্টলের সামনে ২২ তারিখে অনেকেই এসেছিলেন তাদের সঙ্গ পেয়েছি। ব্লগের সম্মানিত মডারেটর জাদিদ ভাই অসুস্থতা নিয়েও কষ্ট করে দীর্ঘ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে সঙ্গ দিয়েছেন এটা সত্যি আমার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
'সরল'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স করা একজন সাহিত্যপ্রেমী টগবগে যুবক। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি উৎস প্রকাশন থেকে 'পুতুলনাচ' বইটি কিনতে গিয়ে আমার সাথে পরিচয়। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সমসাময়িক যারা ভালো লিখছেন তাদের মধ্যে একজন কবি, একজন গল্পকার এবং একজন উপন্যাসিকের নাম বলতে। আমি পছন্দের নামগুলো বললে, তিনি আকাশ থেকে পড়লেন! কি বলছেন, 'উনাদের নাম-ই তো কখনো শুনিনি।' জবাবে বললাম, এখন তো শুনলেন। এবার সম্ভব হলে উনাদের একটি করে বই কিনে নিয়ে যান। ভালো লাগবে পড়ে। এছাড়া সাহিত্যে সাথে সিনেমা, নাটকের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ ভাবনার পার্থক্য নিয়ে কথা হয়। তিনি তিনটিকে এক পাল্লায় মাপলেও আমি দ্বিমত করি এবং কেন সাহিত্য ভাবনা আলাদা তা বুঝিয়ে বলি। আমার কথাগুলো শুনে পছন্দ হওয়ায় কথা দিয়েছেন এ সপ্তাহে এসে পুতুলনাচ পড়ে একটি রিভিউ দেবেন এবং সুযোগ পেলে সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন। গত পরশু তিনি ফোন দিয়ে দেখা করতে চাইলেন। সামনের উইকএন্ডে বইমেলায় থাকবো জেনে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
বইয়ের লেখক হিসাবে এটা আমার দ্বিতীয় বইমেলা। যদিও এখনো নিজেকে লেখক ভাবি না। কমপক্ষে পাঁচটি বছর একাধারে লেখার পর, সাহিত্য সাধনায় নিজেকে সপে দেওয়ার পর যদি পাঠকের স্বীকৃতি মিলে তাহলে হয়তো একটা প্লাটফর্ম পাওয়া যেতে পারে। হুট করে লেখক হওয়ার সর্টকার্ট কোন পথ নেই।
এজন্য এবার মন থেকে চাচ্ছিলাম আমাকে খুশি করতে কিংবা সম্পর্কের খাতিরে যাতে কেউ বই না কিনেন। আমি জানি, ঠেকায় পড়ে কেনা এসব বই কেউ পড়ে না। এতে আপনার কষ্টের টাকা তো গচ্চা গেল সাথে আমিও ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। আমার সারা বছরের সাধনার ফসল মলাটবন্ধী থাকলে লেখাগুলো পাঠক পর্যন্ত পৌছিবে না। আমি চাই আমার ভাবনাগুলো প্রকৃত পাঠকের হাতে পৌঁছুক, লেখার গঠনমূলক সমালোচনা হোক, লেখক/পাঠক আড্ডায় আলোচিত হোক। এতে লেখকের পরিচিতি বাড়ে, নতুন পাঠক সৃষ্টি হয়। এভাবেই নতুন লেখক পুরাতন হন, লেখা সমৃদ্ধ হয়। আর একটা সময় সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারে লেখকের কলমের কালির স্বীকৃতি মিলে। বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখকরা এভাবেই তিলেতিলে নিজেদের গড়ে তুলেছেন।
একজন অভিনেতা/সিনেমা পরিচালক/গীতিকার/রেডিও জকি ভালো লেখক/কবিও হতে পারেন। এটা পৃথিবীর অনেক লেখকের বেলায় ঘটেছে। একজন ভালো লেখকও অভিনেতা/পরিচালক হতে পারেন। কিন্তু একজন লেখক পরিচালক/অভিনেতা হলে তিনি কতটুকু ভালো লিখেন সেটা বিবেচনায় আসে না, তিনি কতটুকু ভালো অভিনয়/পরিচালনা করেন সেটাই বিবেচ্য। কিন্তু শুধুমাত্র টিভি, সিনেমা আর ইউটিউবের ফেইমকে ভিত্তি করে কবি/লেখক হলে তাতে পাঠক বিভ্রান্ত হন, নতুন প্রজন্ম দিশেহারা হয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে সেফাতুল্লা/সেফুদা কখনো গালির কবিতা/বই লেখলে বইমেলার সর্বকালের সবচেয়ে বিক্রিত বই হবে নিশ্চিত। এতে পরিশ্রমী আর সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত লেখকরা উনাকে ফলো করে পরের বছর গালির কিতাব লিখে ফেমাস হওয়ার চেষ্টা করবেন। বইমেলা/বইলেখা ফাতরামির জায়গা নয়, এটা প্রকৃত লেখকদের আবেগ আর সম্মানের জায়গা।
বেশিরভাগ লেখক/পাঠক অমর একুশে বইমেলা বললেও বাংলা একাডেমির সারাদিনের মাইকে ঘোষণায় একটিবারও বইমেলা বলা হয় না। তাদের ভাষায় এটা 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। শুধু বইমেলা বললে গ্রন্থমেলার ভারিক্কি হয়তো থাকবে না, তাই বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় এটা যেনতেন মেলা নয়, ইহা গ্রন্থমেলা। এতে আয়োজক হিসাবে বাংলা একাডেমির মর্যদা বাড়ে, জৌলুস বাড়ে, গাম্ভীর্য বাড়ে। কিন্তু একজন লেখক, একজন কৌতুহলী পাঠক যখন গ্রন্থমেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন তখন তিনি সুমধুর কণ্ঠে শুনা গ্রন্থমেলার ঘোষণার সাথে বাস্তবে মিল খুঁজতে গেলে মেলায় অস্থায়ীভাবে বিছানো ইটে উষ্টা খেয়ে উল্টে পড়বেন, নিশ্চিত৷
কৌতুহলবশত খেয়াল করলে দেখবেন বেশি ভীড় হওয়া স্টল/প্যাভিলিয়নে বই কিনতে আসা পাঠকরা অসীম ধৈর্যের সাথে সিরিয়াল মেইনটেন করে লেখকের অটোগ্রাফ/সেলফি সহ যে বইটি কিনছেন তা মোটেও 'গ্রন্থ' নয়। আরো খোলাসা করে বললে, এটি বহুল চর্চিত একটি পণ্য। যে পণ্যটি বইয়ের মোড়কে তরুণ তরুণীরা মুড়ি মুড়কির মতো গিলছে। কেউ ধর্মের মোড়কে পণ্য বিক্রি করছেন, কেউ মটিভেশন বিক্রি করছেন, কেই আউটসোর্সিং বিক্রি করছেন, কেউ আইএলটিসে দশে-দশ পাওয়ার দাওয়াই বিক্রি করছেন!
রকমারিও যেহেতু ব্যবসা করে তাই বইমেলাকে তারাও ব্যবসায়ের রমরমা সময় ধরে, 'গত সপ্তাহে সবচেয়ে বিক্রিত পণ্যের' তালিকা দিচ্ছে। তারা জানে বইয়ের নামে অনলাইনে যা বিক্রি করছে তাতে বইয়ের সংখ্যা দুই-চারটি মাত্র, বাকিগুলো স্রেফ পণ্য।
আর এবার তো গ্রন্থমেলার বিরাট অংশজুড়ে মুখরোচক খাবারে ভরপুর। আছে আরামসে বসে চৌদ্দগোষ্ঠীকে নিয়ে লাঞ্চ/ডিনার করার সাহেবী ব্যবস্থা। ভ্রমণ পিপাসুরা গ্রন্থমেলায় এসে এক-দুটি বই হাতে নিয়ে বইটি না কিনে সেলফি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েই বই কেনার দায়িত্ব শেষ করলেন। সবাই বাহবা দিল। আর পকেটের টাকাগুলো ঢাললেন- ফুচকা, গ্রিল, বিরিয়ানী/কাচ্ছি খেয়ে। ফেরার সময় পকেটে সামান্য টাকা অযত্নে পড়ে থাকলে এক-দুটি মটিভেশন কিনলেন। শুধু কি তাই? আরো আছে! অনেক তরুণ লেখক রমরমা এই বাণিজ্যের সুযোগে নিজেকে পণ্য বানানোর নেশায় বেহুশ হয়ে আছেন। কেউ একশো কপি বই সামনে নিয়ে একটি বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দিতে ছবি পোস্ট করছেন, 'মাশাল্লাহ প্রি-অর্ডারে সামান্য একটি অংশের বইয়ে আজ অটোগ্রাফ দিলাম'। কেউ কেউ লিখছেন, 'বইয়ের মোড়ক উম্মোচনের আগেই তৃতীয় মুদ্রণ শেষ'!
সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন প্রকৃত পাঠকেরা। রমরমা বাণিজ্যের মোড়কে সত্যিকারের বই কোনটি তা তাদের জন্য বিরাট এক ধাঁধা। অনলাইনের প্রচার দেখে কিনে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, আবার গ্রন্থমেলায় ভীড় দেখে এই পণ্য কিনতে গেলেই আরো বিপদ। এজন্য অতি প্রচারের ভীড়ে যারা ভালো লিখছেন, সত্যিকারের সাহিত্য সাধনায় নিজেকে সপে দিয়েছেন তাদেরকে পাঠক চিনতে পারছেন না। এই ব্যর্থতা পাঠকের নয়, গ্রন্থমেলার নামে পণ্যমেলার আয়োজকদের। যারা মাইকে সুরেলাকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের নেই কোন তদারকি, নেই কোন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা।
ফটো গ্যালারী-
সবার প্রিয় ব্লগার তানিয়া আপা, ফরিদপুর থেকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে, ছুটি ম্যানেজ করে বইমেলায় আসলেন। মোবাইলে ফোন দিয়ে অনেক কষ্টে স্টলের সন্ধান পেলেন। সাথে হাবিব ভাই (আমাদের হাবিব স্যার, যিনি পুরোটা সময় আপার ক্যামেরাম্যান থুক্কু বডিগার্ড ছিলেন) থাকায় আমার সন্ধান পেতে সুবিধা হয়েছে।
কবি রূপক বিধৌত সাধু। চমৎকার একজন মানুষ। প্রিয় এই ব্লগারের সাথে প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ। মুগ্ধ হয়েছি উনার জ্ঞানের ভান্ডার দেখে। হাতে লিস্টি নিয়ে বইমেলায় এসেছেন, আমার পুতুলনাচ তালিকায় ছিল দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম। আবার দেখা হবে চলতি বইমেলায়, অনেক কথা হবে।
ইনি একজন মনোযোগী পাঠক। কিনেই যাবতীয় এটেনশন বইয়ে, লেখককে পাত্তা না দিয়ে!
চশমাওয়ালা আমরা চারজন! আসাদ ভাই, যুনাইদ ভাই, হামিদ ভাই আর আমি হতভাগা!!
পুতুলনাচের প্রথম ক্রেতা এরা। কলেজ ছুটির পর বইমেলায় এসে বইটির কিছু অংশ পড়ে 'কিনবো কি না' ভাবতে ভাবতে শেষমেশ কিনে নিলেন। একটি কপি বাড়তি নিলেন তাদের প্রিয় একজন শিক্ষককে উপহার দেবেন বলে।
হাবিব স্যার, আমার অনুপস্থিতিতে বইটি কিনে নিয়েছিলেন। যেদিন শুনলেন আমি বইমেলায় থাকবো সেদিন হঠাৎ বইটি নিয়ে চুপিচুপি হাজির- 'কাওসার ভাই, অটোগ্রাফ বাকি ছিলো বলে বাসা থেকে বইটি নিয়ে আসলাম!' কৃতজ্ঞতা ভাই, আমি মোটেও সেই মানের লেখক নয়, তবুও যে সম্মান দেখালেন তাতে কৃতজ্ঞ।
তারেক ভাই একা আসেন নাই; সাথে ছিল পুতুলসোনাটা। বইমেলার ধুলাবালি, কিচিরমিচির, ঠেলাঠেলি সহ্য করেও মা-মণিটা খুব হাসিখুশি ছিলো। অনেক অনেক আশীর্বাদ রইলো।
একজন স্কুল শিক্ষিকা। চমৎকার একজন মানুষ। এমন মানুষের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়।
নাদিয়া আপা- পেশায় ডাক্তার হলেও কবিতা লিখেন নিয়মিত। 'সামহোয়্যারইন' ব্লগের একনিষ্ঠ পাঠক। এবার পেন্সিল প্রকাশনী থেকে উনার দু'টি কবিতার বই বের হয়েছে। শুভ কামনা রইলো।
প্রিয় ব্লগার 'জ্যোতির্ময় ধর' দাদা। জার্মান প্রবাসী চমৎকার হাস্যোজ্জল একজন মানুষ। বর্তমান দেশের একটা বড় প্রজেক্টের কাজে চট্টগ্রামে থাকেন। বইমেলার ২৮তম দিনে এসে অনেক খোঁজে আমাকে বের করে 'বায়স্কোপ' আর 'পুতুলনাচ' এর দু'টি কপি সংগ্রহ করেন। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা রইলো, দাদা।
সানজিদা শিফা আয়েশা। চমৎকার লিখেন। এবার বইমেলায় তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী বই 'চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন' বইটি 'বর্ষাদুপুর' প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। এর আগে আরো দু'টি বই বেরিয়েছিল।
কাজী বিশালাক্ষী, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এই বয়সে এতো চমৎকার লিখেন, সত্যি মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। 'শ্রাবণসন্ধা' তাঁর প্রথম উপন্যাস হলেও পরিপক্বতার ছাপ স্পষ্ট। বইটি 'নাগরী প্রকাশনী' থেকে বেরিয়েছে।
আমাদের সবার প্রিয় ব্লগার কানিজ আপা। এবার তার বইটি মেলায় আসেনি বলে মন খারাপ থাকলেও প্রচুর বই কিনেছেন। যে দু'দিন আমার সাথে দেখা হয়েছে দেখেছি দু'হাতে বইয়ের ভারী ব্যাগ। শেষ দিনে এসে আবার শুভ কামনা জানিয়ে গেলেন।
কষ্ট করে টাইপ করা লাগবে না, ক্যাপশনে লিখে দেওয়া আছে!!
সামহোয়্যারইন ব্লগের একজন নিয়মিত ব্লগার। বইমেলায় প্রথম দেখা। কিন্তু পরিচয় দিতে আপত্তি থাকায় আফসুস রয়ে গেল। আমি নাকি তার অধিকাংশ পোস্টে কমেন্ট করতাম। রহস্যের কোন কুল-কিনারা হয়নি!
আমাদের সবার প্রিয় ব্লগার শাহিন ভাই। স্টলে আমাকে না পেলেও পুতুলনাচের একটি কপি কিনলেন, পথিমধ্যে দেখা হলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, অনেক গল্প হলো। সত্যি চমৎকার একজন মানুষ তিনি। এমন মানুষের সাথে বারবার দেখা হোক।
প্রিয় ব্লগার আমাদের শ্রদ্ধাভাজন সুরঞ্জনা মায়া আপা। আপার একটি বই এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছেন। চমৎকার একজন মানুষ তিনি। সদাহাস্যজ্বল এবং ব্যক্তিত্ত্ব সম্পন্ন একজন ব্লগার।
আগামী ২৮, ২৯ ফেব্রুয়ারি (শুক্র-শনিবার) গ্রন্থমেলার শেষ দু'দিন উৎস প্রকাশন (প্যাভিলিয়ন-৩২) এবং শিখা প্রকাশনীতে (স্টল ৫১৭-৫২০) থাকবো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২১ রাত ১২:৩০