বৃটেনের 'দ্যা ইকোনোমিস্ট' পত্রিকার করা জরিপ মতে মতে ২০১৯ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় আমাদের ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। অভিনন্দন হে মহান নগরী, প্রিয় ঢাকা! তাহলে প্রথম স্থানের শিরোপাজয়ী শহরের নামটিও এক্ষেত্রে বলে দেওয়া উচিৎ। হ্যা, ঢাকাকে রানারআপ করে আমাদের কাঁদিয়ে গর্বের এই শিরোপা গেছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের হাতে। অভিনন্দন দামেস্কবাসীকে! কথা দিচ্ছি আগামী বছর আপনাদের চ্যাম্পিয়নশীপ শিরোপা আমাদের হাতেই আসবে। এজন্য যতরকম কৌশল, ট্রেনিং নিতে হয় সব করা হবে। ঢাকা সিটির দুই মেয়র কাম কোচ এজন্য তাদের বাজেটের বড় একটি অংশ বরাদ্দ করবেন আশা করছি। সরকার প্রয়োজনীয় সহযোগীতায় এগিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করি।
আমার অভিনন্দন বার্তায় যারা উল্লাসে ফেঁটে চৌচির হয়ে দম আটকে মরে যাওয়ার ভয়ে আছেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, তালিকাটির জরিপের ফলাফল একদম তলানী থেকেই শুরু করেছি। এদেশে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট আর আই এ্যাম জিপিএ ফাইভের বাম্পার ফলন হয় তাই ফেইলের বাম্পার ফলন দিয়ে শুরু করলাম। আরো স্পষ্ট করে বলি, পৃথিবীর সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়! না, কেউ ইচ্ছে করে আমাদের হাতে এই অযোগ্যতা আর বসবাসের অনুপযোগী শহরের খেতাব গলায় ঝুলিয়ে দেয়নি। আর এই তালিকা করতে লীগ-বিএনপির কোন হাত-অজুহাত ছিলো না। গত কয় বছরে সিরিয়া গৃহযুদ্ধ ক্ষতবিক্ষত না হলে শিরোপাটা আমাদের হাতেই থাকতো নিঃসন্দেহে।
তাহলে সত্যি সত্যি শিরোপাজয়ী শহর কোনটি? ইকোনোমিস্টের জরিপে ২০১৯ সালের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর 'ভিয়েনা'; মধ্য ইউরোপের শান্তিপ্রিয় আর হাজারো বছর থেকে তিলেতিলে সমৃদ্ধির সাথে উঠে আসা দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী শহর এই ভিয়েনা। গত সাত বছর মার্জিন ব্যবধানে এগিয়ে ছিলো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। তাদের অবস্থান এবার দ্বিতীয়। এরপর যথাক্রমে আছে; জাপানের 'ওসাকা', কানাডার 'ক্যালগেরি', অস্ট্রেলিয়ার 'সিডনি', কানাডার 'ভ্যাংকুবার', কানাডার 'টরেন্টো', জাপানের 'টোকিও', ডেনমার্কের 'কোপেনহ্যাগেন' এবং অস্ট্রেলিয়ার আ্যাডিলেড।
"ভিয়েনা পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের মর্যাদা পেল যেসব কারণে"
এখানে একটি বিষয় লক্ষনীয়, প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং জাপানের একাধিক শহর তালিকায় স্থান পায়। এসব শহরের স্কোর কার্ডে ব্যবধান এতো কম থাকে যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে খুব একটা পার্থক্য পাওয়া যায় না। সিঙ্গাপুর সিটিও তালিকার শীর্ষ দশে আসেনি। এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি জাপান। শীর্ষে থাকা ভিয়েনার স্কোর একশোতে ৯৯.১! ভাবা যায়? আর ঢাকা একশোতে ৩৮; অর্থাৎ সেকেন্ড ডিভিশন আর থার্ড ডিভিশনের মাঝামাঝি। তালিকায় তলানীতে থেকে প্রথম স্থান পাওয়া দামেস্ক কিন্তু ৩০.৭ স্কোর করে ফেইল করেছে। আমরা তো ফেইল মারিনি; হোক তা থার্ড ডিভিশন! তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলতে পারি, পাশ মার্ক তো!!
এখন দেখা যাক কোন কোন মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এই জরিপ করা হয়। ইকোনোস্ট মূলত, পাঁচটা মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এই তালিকা করে থাকে-
(১)রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা (অপরাধের হার আর জঙ্গিবাদের ঝুঁকিও পড়ে)।
(২)স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা।
(৩) সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ (এর মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু জিনিস অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেমন, শহরের গড় তাপমাত্রা, দুর্নীতির সূচক, খাবার-পানীয়র মান, খেলাধূলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ ইত্যাদি)।
(৪) শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধা।
(৫) অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, ট্রান্সপোর্ট।
এই মানদন্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি শহর বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠতে দীর্ঘ একটি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু অট্টালিকা, সুন্দর ঝকঝকে রাস্তা-ঘাট, শপিংমল, ধনীদের বসবাস এবং আভিজাত্যকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনা হয় না। এমনটি হলে লন্ডন, নিউইয়র্ক, মাদ্রিদ, প্যারিস, লসএঞ্জেলস, সাংহাই, সিউল, সাওপাওলো, দুবাই ইত্যাদি শহর শীর্ষে থাকার কথা। আমাদের রাজধানী শহর এতো অবসবাসযোগ্য হওয়ার কারণ খুঁজতে গেলে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরী।
আমাদের ঢাকা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্থিতিশীল? স্বাস্থ্য সেবার মানের বিষয়ে সরকার কিংবা ঔষধ কোম্পানি/হাসপাতাল/ডাক্তার পেশাগত জীবনে সৎ/ মানসম্পন্ন কিংবা সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর/দায়িত্বশীল? উদার সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিদ্যমান? দুর্নীতি, পানীয় খাবরের মান, শিশু খাদ্যের মান-দাম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি সহনীয়? শিক্ষার মান কিংবা সবার জন্য সমান শিক্ষার সুযোগ আছে? যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ/সহজলভ্য/আরামদায়ক?
এসব প্রশ্নের উত্তর পাঠকরা খুঁজবেন। পেয়ে যাবেন নিশ্চিত।
এবার ভিয়েনা শহরটি নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
অস্ট্রিয়া একটি ল্যান্ডলক কান্ট্রি। দেশটির সাথে জার্মানি, স্লোভেনিয়া, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডের বোর্ডার আছে। ভিয়েনার অবস্থান এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইটালি, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরিসহ কয়েকটা দেশে চলে যাওয়া যায় সহজেই।
দানিউব নদীর দুই তীরে বিস্তৃত চারশো বর্গ কিলোমিটারের সাজানো-গুছানো এক শহর ভিয়েনা। জনসংখ্যা প্রায় পঁচিশ লক্ষ। অস্ট্রিয়ার মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই থাকে রাজধানী বা এর সাব-আরবান এলাকাগুলোয়। ভিয়েনার শহরতলীর এক অংশ ‘ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’ হিসেবে পরিচিত, যেখানে জাতিসংঘের আঞ্চলিক কার্যালয় অবস্থিত। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন, জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা, তেল রপ্তানিকারক দেশদের সংগঠন ওপেকসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর ভিয়েনায়। এর ফলে প্রতি বছরই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সম্মেলন লেগেই থাকে ভিয়েনায়। এক হিসাব অনুসারে প্রতি বছর ভিয়েনায় আসা ট্যুরিস্টের সংখ্যা প্রায় সত্তর লাখ, যা কিনা শহরটার স্থায়ী জনসংখ্যার কয়েক গুণ বেশি।
ভিয়েনা একটি মাল্টি কালচারাল সিটি। ভিয়েনায় তিনজন মানুষের সাথে দেখা হলে তার মধ্যে গড়ে একজন থাকবে যে কিনা জাতিতে অস্ট্রিয় না। সার্বিয়, তুর্কি, পোলিশ, জার্মান, রোমানিয়ান এমন কোনো ইউরোপীয় জাতির মানুষ নাই যাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না ভিয়েনায়। বিভিন্ন জাতির এই সাংস্কৃতিক মিলনই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-স্থাপত্য সব দিক থেকেই ভিয়েনাকে ইউরোপে করেছে অনন্য। এর ফলে ইতিহাসের বহু বিখ্যাত মুখ তাদের জীবনের একটা সময় কাটিয়েছে ভিয়েনায়। এই তালিকায় সিগমন্ড ফ্রয়েডের মতো বিখ্যাত মানুষ থেকে শুরু করে আছে এডলফ হিটলারের মতো কুখ্যাত মানুষও।
সঙ্গীতের জগতে ভিয়েনা এতই বিখ্যাত যে অনেকসময় একে ডাকা হয় City of music নামেও। ভিয়েনাজুড়েই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য থিয়েটার আর অপেরা। এই শহরেই কাজ করেছেন বেথোভেন, মোজার্টের মতো সুরস্রষ্টারা। সঙ্গীতের জগতে ভিয়েনার প্রভাব এতই প্রকট যে একে বিশ্ব সঙ্গীতের রাজধানী হিসেবেও সম্বোধন করা হয় অনেক সময়ে।
এখনকার ভিয়েনা শহর বেড়ে উঠেছে গত কয়েক শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে। ফলে এখানে যেমন মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায় ঠিক তেমনি দেখতে পাওয়া যায় অনেক আধুনিক স্থাপত্য। ভিয়েনা সিটি সেন্টারকে ইউনেসকো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও পরবর্তীতে ২০১৭ সালে এই স্বীকৃতির জায়গায় দেওয়া হয় ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ইন ডেঞ্জার’। শহরের আধুনিকায়ন করতে যেয়ে প্রশাসন হাই-রাইজ বিল্ডিং তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ইউনেস্কোর মতে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শহরের স্বাভাবিক চালচিত্র, যার ফলে বিপদে থাকা হেরিটেজ সাইট ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বসবাসযোগ্য শহর হওয়ার আরেকটা যে মাপকাঠি সেই অবকাঠামোতেও ভিয়েনা এগিয়ে থাকে স্থাপত্যের জন্য। অবকাঠামোগত সুবিধার মধ্যে শুধু সুন্দর বাড়ি-ঘর পড়ে না, যোগাযোগ ব্যবস্থা (স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক), গণপরিবহণ, বিদ্যুৎ বা পানির মতো সুবিধার সহজলভ্যতার ভিত্তিতেই অবকাঠামোগত স্কোর দেওয়া হয়। এই বিচারে ভিয়েনা একশোতে একশো।
উচ্চশিক্ষার সুযোগের জন্য ভিয়েনা ইউরোপের অন্যতম আকর্ষণীয় শহর। ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা। বর্তমানে ছাত্রসংখ্যার দিক থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা এই বিশ্ববিদ্যালয়। ২০ জন নোবেল পুরস্কারবিজয়ী কাজ করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়াও এই শহরে আছে ১৬৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘একাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইউনিভার্সিটি অফ মিউজিক এন্ড পারফর্মিং আর্টস’ সব বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে ‘ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অফ ইকোনমিকস এন্ড বিজনেস’ ইউরোপের সেরা বিজনেস স্কুলগুলোর একটা হিসেবে পরিচিত।
ঢাকা একটি ব্যর্থ সিটি হওয়ার পেছনো হাজারো কারণ আছে। এজন্য দেশ-বিদেশের মিডিয়াগুলো কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে। বিবিসি বাংলা তা নিয়ে একটি অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট করেছে।
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল, অন্যতম মেগা সিটির মর্যাদা পাওয়া ঢাকা একটি ফেইল সিটি। এটাই প্রকৃত সত্য। কারণ, ঢাকা কখনো পরিকল্পনা মাফিক গড়ে উঠেনি। স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা সিটিকে সরকারগুলো দুর্নীতি আর রাজনৈতিক রঙ ছিটিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত করেছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নদী। এছাড়া ঢাকা সিটিকে দু'টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে আরো বেশি বসবাস অযোগ্য করা হয়েছে। প্রতি বছর ঢাকায় জন্ম নেওয়া হাইব্রিড অতি ধনিক শ্রেণীর জন্ম এই নগরীকে অভিশপ্ত করছে। এসব হাইব্রিড ধনীরা শ্রমিক আর নাগরিকদের রক্ত চুষে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। দেশে সম্পদের এভারেস্ট বানাচ্ছে। এজন্য অভিশপ্ত এই নগরী কখনো বসবাসযোগ্য হবে না। এটা প্রকৃতির বিচার।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল। (ছবিগুলো অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১:২৮