জুন মাসের সাতাশ তারিখ, ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল এক সকাল; গ্রীষ্মের চমৎকার আরামদায়ক আবহাওয়া পরিবেশটাকে বেশ উপভোগ্য করে তুলেছে। সবুজ শ্যামল ঘাসের সাথে নানা বর্ণের ফুল ফুটেছ। উৎসব মূখর এ দিনটিতে গ্রামের সর্বস্থরের মানুষ জমায়েত হতে শুরু করলো একটি মাঠে; জায়গাটি গ্রামের পোস্ট অফিস আর ব্যাংকের ঠিক মাঝামাঝিতে অবস্থিত। সময় আনুমানিক দশটা বাজে। কোন কোন শহরের জনসংখ্যা এতো বেশি যে, লটারির কার্যক্রম জুনের দুই তারিখ থেকে শুরু করতে হয়! কিন্তু এ গ্রামের লোকসংখ্যা মাত্র ৩০০ জনের কাছাকাছি হওয়ায় লটারির পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে দুই ঘন্টারও কম সময় লাগবে; লটারি সকাল দশটায় শুরু হলেও গ্রামের মানুষ মধ্যাহ্ন ভোজের আগেই বাড়ি ফিরতে পারবে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকায় ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব উপভোগ করতে সবার আগে ছোট ছোট বাচ্চারা এসে জড়ো হয়েছে; তবু কেন যেন তাদের চোখে মুখে স্বভাবিক উচ্ছাসের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, এজন্য অনেকটা নীরবে জটলা পাকাচ্ছে তারা। তাদের আলোচনার সিংহভাগ জুড়েই ছিল স্কুলে শ্রেণীকক্ষ, পাঠ্যবই, স্কুলের শিক্ষক/ শিক্ষিকা আর একে অন্যকে ট্রল করা নিয়ে। তবে তাদের মধ্যে ববি মার্টিন কিছুটা ব্যতিক্রম, সে ছোট ছোট পাথরের টুকরো দিয়ে পকেট ভারী করে ফেলেছে! বাকি বাচ্চারাও তার দেখাদেখি একই কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাথর কুড়াতে ব্যস্থ হয়ে পড়লো। তারা সবচেয়ে মসৃণ আর গোলাকার আকৃতির পাথর সংগ্রহে অধিক মনযোগী ছিল। এদের মধ্যে ববি, হ্যারি জোন্স এবং ডিকি ডেলাক্রক্স (তবে গ্রামের লোকজন তাকে ডেলাক্রয় বলে ডাকে) মাঠের একটা কোনায় রীতিমত একটা পাথরের ঢিবি বানিয়ে ফেললো এবং সটান দাঁড়িয়ে রইলো ঢিবির গা ঘেঁসে, যাতে অন্য ছেলেরা এসে তা ভেঙ্গে ফেলতে না পারে। লটারির উৎসবে যোগ দিতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এসেছে, তারা মাঠের একটি পাশে জটলা পাকিয়ে গল্পে মশগুল। তারা একে অন্যের কাঁধ বরাবর তাকিয়ে সুয়েটারের উপরে ভাই বোনদের নোংরা হাতের ছাপ লক্ষ্য করছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের পুরুষরা আসতে শুরু করলো। গল্প গুজবে তারাও কিন্তু কম যায় না; তবে তাদের গল্পের বিষয়বস্তু ভিন্ন। তাদের আলোচনায় রোদ, বৃষ্টি, খরা, চাষবাস, ট্রাক্টর আর খাজনার বিষয়াদি প্রাধান্য পাচ্ছে। সন্তানরা পাথরের ঢিবি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও তাদের দৃষ্টি সদা জাগ্রত ছিল। সবশেষে এলেন গ্রামের মহিলারা; তাদের পরনে ছিল মলিন পুরাতন সোয়েটার। পরিচিত সবাইকে দেখে তারা হাঁসি টাট্টায় মেতে উঠলেন, কেউ বা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। পরে চলে গেলেন যার যার স্বামীর কাছে। কিছুক্ষণ পর স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ছেলে মেয়েদেরকে কাছে ডাকলেন। চার পাঁচবার ডাকার পর গোমড়া মুখে যার যার বাবা-মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তারা। ববিকে তার মা কিছু সময় শক্ত হাতে আটকে রাখলেও হঠাৎ করে ফসকে গিয়ে আবার পাঁথরের ঢিবির দিকে ছুট দিল। কিন্তু বাবার চোখ রাঙানি আর ধমকের কারণে ববি ফিরে আসতে বাধ্য হলো। অনেকটা লক্ষী ছেলের মত চুপচাপ বাবা আর বড় ভাইয়ের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো।
গ্রামের নৃত্য কলা থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরীদের সংঘ, হেলোইনের আয়োজন সহ যাবতীয় অনুষ্ঠান যার হাত দিয়ে সুচারু ভাবে সম্পন্ন হয় সেই 'মিস্টার সমারর্স' এর উপরেই লটারি আয়োজনের গুরু দায়িত্ব পড়েছে। স্বীকার করতে হবে নাদুসনুদুস চেহারার এই কয়লা ব্যবসায়ী মানুষটার ধৈর্য্য সীমাহীন। একে তো দজ্জাল বউ, তার উপর নিঃসন্তান; এজন্য গ্রামের লোকজন তাকে বেশ সমীহের চোখে দেখে। মিস্টার সমারর্সকে লটারির কালো বাক্সটা নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে সবাই চুপচাপ হয়ে গেলেও গ্রামবাসীদের মধ্যে ফিসফিসানি ঠিকই চলতে থাকলো।
মাঠের মাঝামাঝি এসে সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে তিনি বললেন, "আজ একটু দেরী হয়ে গেছে।" তার ঠিক পেছনে একটি টুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রামের পোস্ট মাস্টার 'মিস্টার গ্রেভস'; তিনি টুলটা মাঠের ঠিক মধ্যখানে রাখলেন। মিস্টার সমারর্স লটারির কালো বাক্সটি টুলটির উপরে রাখলেন।
গ্রামের লোকজন টুলটা থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে গোল হয়ে দাঁড়ালো। মিস্টার সমারর্স উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আপনাদের মধ্যে কেউ কি লটারির কার্যক্রমে অংশ নিতে চান?" কথাটি শুনে প্রথমে সবাই চুপটি মেরে থাকলেও কিছুক্ষণ পর মিস্টার মার্টিন ও তার বড় ছেলে হাত তুলে আগ্রহের কথা জানালেন। এবার মিস্টার সমারর্স বাক্সের ভেতরে আগে থেকে ভরে রাখা লটারির কাগজগুলোতে কয়েকটি বড় ঝাঁকুনি দিলেন; এসময় বাপ-ছেলে টুলটা চেপে ধরেছিলেন যাতে বাক্সটার ঝাঁকুনির সাথে টুলটা নড়তে না পারে।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, লটারি আয়োজনের আগের সেই জৌলুস আর উত্তেজনা এখন আর নেই; লটারিতে ব্যবহৃত কালো বাক্সটা শহরের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি ওয়ার্নারেরও জন্মের আগের। মিস্টার সমারর্স অনেক দিন থেকেই বাক্সটা পরিবর্তন করে নতুন আরেকটি তৈরীর তাগিদ দিয়ে আসছেন। কিন্তু গ্রামবাসী দীর্ঘদিন থেকে ব্যবহৃত বাক্সটা নিজেদের ঐতিহ্য মনে করে বলে এ প্রস্তাবে সায় দেয় নাই। গ্রামের অনেকের ধারণা কালো বাক্সটা বানানোর সময় গ্রামের গোড়াপত্তনের শুরুতে ব্যবহৃত সর্ব প্রথম বাক্সটার কাঠের টুকরোও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে প্রতি বছর লটারি আয়োজনের শেষে মিস্টার সমারর্স নতুন আরেকটি বাক্স বানাতে তাগিদ দিলে প্রতিবারই গ্রামের সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, "এবার থাক, পরের বার দেখা যাবে।" তবে বাক্সটা অনেক পুরোনো হওয়ায় প্রতি বছর একটু একটু করে তা বিবর্ণ হচ্ছিল; এছাড়া বাক্সটার কালো রং জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়ে অসুন্দর দেখাচ্ছে, দাগ পড়েছে যত্র তত্র।
মিস্টার মার্টিন ও তার বড় ছেলে টুলের উপরে বাক্সটাকে রেখে টুলটাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন যাতে এটি পড়ে না যায়। বছরের পর বছর থেকে চলে আসা এই প্রথার অনেক পরিবর্তন এসেছে; লটারির উপাদান হিসেবে দীর্ঘদিন কাঠের টুকরো ব্যবহৃত হলেও গত কয়েক বছর থেকে মিস্টার সমারর্স কাগজের প্রচলন শুরু করেন। আগে গ্রামের জনসংখ্যা কম থাকায় কাঠের টুকরো ব্যবহারে কোন সমস্যা ছিল না; কিন্তু প্রায় তিনশত মানুষের এ গ্রামটিতে এখন কী আর কাঠের টুকরো দিয়ে লটারি করা সম্ভব? এজন্যই এ পরিবর্তন। বাক্সেও এতো জায়গা নেই। লটারির আগের রাতে মিস্টার সমারর্স আর মিস্টার গ্রেভস মিলে কাগজের ছোট ছোট টুকরোগুলোকে বাক্সের মধ্যে ভরে রাখনে, পরে বাক্সটা পাঠিয়ে দেওয়া হয় মিস্টার সমারর্সের কয়লা খনিতে। পরদিন সকালবেলা মাঠে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত বাক্সটা এভাবেই সিল করা থাকে। আর বছরের বাকি সময়টাতে সেটি এ বাড়ি, ও বাড়ি, সে বাড়ি ঘুরতে থাকে। একবার তো পুরো বছরের জন্য মিষ্টার গ্রেভসের গোলাঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল! আরেকবার রাখা হয়েছিল পোস্ট অফিসে। মার্টিনের মুদি দোকানেও রাখা হয়েছিল বেশ কয়েকবার।
লটারি শুরুর আগে মিস্টার সমারর্সকে বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো- গৃহকর্তাদের নামের তালিকা সংগ্রহ সহ পরিবারের বাকি সদস্যদের তথ্য সংগ্রহ করা। এবার লটারির পরিচালক হিসেবে মিস্টার সমারর্সকে শপথবাক্য পাঠ করান মিস্টার গ্রেভস। তবে একটা সময় ছিল, যখন লটারি শুরু হওয়ার আগে একটি ব্যতিক্রমী আবৃত্তির আয়োজন করা হতো; এটি না ছিল কবিতার আসর, না ছিল গানের আসর! অনেকটা দু'টোর মাঝামাঝি কিছু একটা হবে। সারি বেঁধে সবাই বিড় বিড় করে সূরহীন গম্ভীর ভাব নিয়ে কিছু একটি আওড়াতো; এ সময় পরিচালক নীরবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। তবে কারো কারো মতে তিনি ভীড়ের চারিপাশে ঘুরে ঘুরে যাচাই করতেন গ্রামের কেউ অনুপস্থিত রইলো কিনা। সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে অনেক কিছু। এমনও শুনা যায় একটা সময় লটারির বল তুলতে আসা সবাইকে পরিচালক দাঁড়িয়ে স্যলুট করতেন। এখন আর এ রীতির প্রচলন নেই, শুধু কথা বলার সৌজন্যতার মধ্যে রীতিগুলো সীমাবদ্ধ। অবশ্য এ কাজে মিস্টার সমারর্স বেশ দক্ষ। ধবধবে সাদা সার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট পরা পরিচালককে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছিলো, তিনি আনমনে কালো বাক্সের উপর একটি হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন এবং বেশ ফুরফুরে মেজাজে গ্রেভস আর মার্টিনদের সাথে গল্প করছেন।
মিস্টার সমারর্স যখন বরাবরের মতো সব কিছু গুছিয়ে লটারি চূড়ান্ত পর্ব শুরু করতে মাঠে জমায়েত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলতে যাবেন ঠিক তখনই খেয়াল করলেন 'মিসেস হ্যাচিসন' অনেক দূর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের দিকে ছুটে আসছেন। কাঁধের উপর সুয়েটার গিট্টু দিয়ে তিনি প্রাণপনে দৌড়ে এসে মাঠের এক পাশে সবার পেছনের সারিতে দাঁড়ালেন। হাঁপাতে হাঁপাতে মিসেস ডেলাক্রক্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ''আমি একদম ভুলেই গিয়েছিলাম আজকের দিনটির কথা।" পাশেই দাঁড়ানো মিসেস ডেলাক্রক্স তার কথা শুনে হেঁসে উঠলেন। মিসেস হ্যাচিসন আবার বলতে লাগলেন, ''ভেবেছিলাম আমার বুড়ো স্বামী বোধহয় কাঠ সংগ্রহ করতে বাইরে বেরিয়েছে; কিন্তু জানালার বাইরে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম বাচ্চাদের কেউও বাড়িতে নেই। হঠাৎ মনে পড়লো আজ তো সাতাশ তারিখ! সাত পাঁচ না ভেবে দিলাম ভৌ দৌড়, এক দৌড়ে এখানে এসে পৌছিলাম।" মিসেস ডেলাক্রক্স প্রতি উত্তরে বললেন, "টেনশনের কিছু নেই, তুমি সময়মতোই এসেছ; লটারি এখনো শুরু হয় নাই।"
মিসেস হ্যাচিসন ভীড়ের মধ্যে দু'চোখ ঘুরিয়ে হয়রান হয়ে স্বামী সন্তানদের খোঁজ করতে লাগলেন এবং পেয়েও গেলেন; তারা সামনের সারির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মিসেস ডেলাক্রক্সের বাহুতে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিদায় নিয়ে স্বামী-সন্তানদের কাছে ছুটলেন। লোকজন একটু ফাঁকা হয়ে তাকে পথ করে দিল। এসময় ভীড়ের মধ্য থেকে দু-একজন উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, "এই তো এসে পড়েছেন মিসেস হ্যাচিসন; বিল, তোমার টেনশনের কিছু নেই; তোমার প্রেয়সী বউ এসে গেছে।" এবার মিসেস হ্যাচিসন স্বামী বিল হ্যাচিসনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিস্টার সমারর্স এবার গলা খেকিয়ে মিসেস হ্যাচিসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন, ''ভেবেছিলাম এবার তোমাকে ছাড়াই লটারির পর্ব শুরু করতে হবে।'' কথাটি শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসলেন মিসেস হ্যাচিসন; উত্তরে বললেন, "আমি তো বেসিনে একগাদা এঁটো থালা বাসন রেখে এক দৌড়ে ছুটে এসেছি, মিস্টার জো; সাথে রসিকতা করে যোগ করলেন, আপনাকে তো এমন কোন কাজ বাড়িতে রেখে আসতে হয় নাই!" এবার শুরু করে দিন, প্লীজ। মিসেস হ্যাচিসনের কথা শুনে চারিদিকে হাঁসির রোল পড়ে গেল, যাক অবশেষে গম্ভীর পরিবেশটা কিছুটা হালকা হলো!
"ঠিক আছে।" শান্ত কণ্ঠে বললেন, মিস্টার সমারর্স। "আমাদের এবার শুরু করা উচিৎ; আগে ভাগে শেষ করে যার যার কাজে ফিরে যাওয়া যাবে। কেউ এখনো বাকি আছে নাকি?"
"ডানবার।" ভীড়ের মধ্য থেকে অনেকে বলে উঠলো, "ডানভার ডানভার।" ডানভার এখনো আসে নাই।
"হুম, ক্লাইভ ডানবার" মিস্টার সমারর্স হাতের তালিকার দিকে চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হলেন। শুনেছি ক'দিন আগে পা ভেঙেছে লোকটার; তবে এর সত্য মিথ্যা জানি না, ঘটনা কি সত্যি? তার পক্ষে কে লটারি টানবে?
"আমি আছি।" একটা নারী কণ্ঠ শোনা গেল ভীড়ের মধ্যে। পরিচালক তার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তাহলে স্বামীর হয়ে স্ত্রী লটারি তুলবে?" তিনি আরো যুক্ত করলেন, "তোমাদের তো প্রাপ্ত বয়স্ক একটি ছেলে আছে, তাই না? আমার মনে হয় বাবার হয়ে সেই লটারিটা তুলুক, কি বলো জেন্সি?" যদিও উত্তরটা গ্রামের আরো দশটি মানুষের মতো মিস্টার সমারর্সেরও জানা; তবুও আনুষ্ঠানিক ভাবে বিষয়টি অবগত করা পরিচালকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। উত্তরের অপেক্ষায় মিসেস ডানবারের দিকে সৌম্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি।
"হুরাসের বয়স এখনো ষোল হয়নি।" কাচুমাচু হয়ে কথাটি বললেন ডানবার। সাথে যোগ করলেন, "এ বছর বুড়ো লোকটার পক্ষে আমাকেই লটারি টানতে হবে।"
"ঠিক আছে।" ঘোষণা দিলেন লটারির পরিচালক। হাতে ধরে রাখা তালিকায় কিছু একটা লিখলেন; তারপর উচ্চস্বরে বললেন, "ওয়াটসনের ছেলে এ বছর লটারি টানবে।"
ভীড়ের মধ্য থেকে লিকলিকে লম্বা একটি ছেলেকে হাঁত তুলতে দেখা গেল। "এই তো আমি, মায়ের পক্ষে আমিই কাগজ তুলবো।" ভীড়ের মধ্যে চিৎকার শুনা গেল, "সাবাস জ্যাক।" লোকজনের কথা শুনে ভয়ে মাথা নীচু করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো ছেলেটা। লোকজন আরো বলতে লাগলো, "যাক অবশেষে তোমার মা একজন পুরুষ মানুষের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন তাহলে?"
"ঠিক আছে।" মিস্টার সমারর্স বললেন, "আশা করি সবাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন, বুড়ো ওয়ার্নার আছে নাকি?"
"আমি এখানে।" গলার আওয়াজ শুনে ভীড়ের মধ্যে তাকে খোঁজার চেষ্টা করলেন মিস্টার সমারর্স।
চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ দেখাচ্ছে; হাতের তালিকার দিকে একটু দৃষ্টি দিয়ে গলা খেকিয়ে মিস্টার সমারর্স বললেন, "সবাই প্রস্তুত আছেন তো?" আমি এখন তালিকা দেখে একে একে নাম ডাকবো। প্রথমে আসবে পরিবারের কর্তারা। আপনারা এসে এই বাক্স থেকে একটা করে কাগজ তুলবেন তারপর সেটার ভাঁজ না খোলে পরিবারের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না সবাই একবার করে সুযোগ পাবে ততক্ষণে কেউ কাগজের ভাঁজটি খোলবে না। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন সবাই?"
অর্ধেকের বেশি লোক সেই নির্দেশনার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করলো না; তারা এতো বছর থেকে প্রক্রিয়াটি দেখে আসছে এজন্য নতুন করে জানার কিছু নেই। তবে ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ শুনার ভান করলো। আবার কেউ কেউ জিহ্বা দিয়ে ঠোট দু'টি আলতো করে চেটে নিল। লটারির মতো বিশাল এ আয়োজনে কমিবেশি সবার মনে উত্তেজনার পাশাপাশি একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করছে। এবার হাত উঁচু করে প্রথম নামটি ডাকলেন পরিচালক মিস্টার সমারর্স, ''এ্যাডামস"; নামটি শুনে একজন লোক ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে আসলেন। "কেমন আছ স্টিভ?" হাসি মুখে জানতে চাইলেন মিস্টার সমারর্স। এবার মিস্টার এডাম বললেন, "কি খবর, জো?" প্রথমে নার্ভাস দৃষ্টিতে একে অন্যের মধ্যে চোখাচোখি হলো। এরপর মিস্টার এ্যাডাম এগিয়ে এসে বাক্সের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটি লটারি তুলে নিলেন এবং মাঠের একটা কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যদের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন; কিন্তু হাতের দিকে ভুলেও থাকালেন না।
"এ্যালিন" ..... "এন্ডারসন" ..... "বেনথাম" ..... এভাবে মিস্টার সমারর্স একের পর এক নাম ডাকতে লাগলেন।
"ইদানিং খুব দ্রুত লটারির সময় ঘনিয়ে আসে, আমার মনে হচ্ছে গত বছরের লটারি যেন গত সপ্তাহে হয়ে গেল!" ঠিক পেছনের সারিতে দাঁড়ানো মিসেস গ্রেভসকে উদ্দেশ্য করে বললেন মিসেস ডেলাক্রক্স।
"সময় কত দ্রুত দ্রুত ফুরিয়ে যায়।" উত্তর দিলেন মিসেস গ্রেভস।
এবার ডাক পড়লো, "ক্লার্ক" ..... "ডেলাক্রক্স".....
"এবার আমার স্বামীর ডাক পড়েছে।" মিসেস গ্রেভসকে উদ্দেশ্য করে মিসেস ডেলাক্রক্স বললেন; সাথে যোগ করলেন, "স্বামীকে এগিয়ে যেতে দেখে উত্তেজনায় ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছি না।"
"ডানবার।" মিস্টার সমারর্স ডানবারের নাম ডাকতেই স্বামীর নাম শুনে বাক্সের দিকে পা বাড়ালেন মিসেস ডানবার। ভীড়ের মধ্য থেকে নারী কন্ঠের চিৎকার শুনা গেল, "এগিয়ে যাও, জেনি। আরেকজন মহিলা সাথে যোগ করলেন, "হুম, তিনি যাচ্ছেন।"
"এরপর আমাদের পালা।" মিসেস গ্রেভস বললেন। মিস্টার গ্রেভস যখন ধীর পায়ে বাক্সের পাশে আসলেন তখন তিনি পরিচালকের সামনে কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্স থেকে লটারির কাগজ তুললেন। এবার ভীড়ের মধ্যে থাকা সব পুরুষের হাতে হাতে ছোট্ট লটারির কাগজটি পৌছে গেছে; তারা কাগজটাকে নার্ভাস ভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। মিসেস ডানভার দুই ছেলেকে পাশে রেখে কাগজটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
"হার্ভার্ট" ..... "হ্যাচিসন" .....
"শুনছো বিল? তোমার নাম ডাকছে"। মিসেস হ্যাচিসন স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন; তার কথা শুনে আশপাশের লোকজন হাসাহাসি করতে লাগলো।
"জোন্স।"
পাশে দাঁড়ানো বুড়ো ওয়ার্নারের সাথে গল্প জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার এ্যাডামস, "শুনেছি উত্তরের গ্রামে নাকি লটারির প্রথা বাতিল করার কথা হচ্ছে।"
"যত্তসব ফালতু কথা", বলে নাক সিটকালেন ওয়ার্নার। আরো বললেন, "ছেলে-ছোকরাদের কথায় কান দিয়ে লাভ আছে? ওরা বুঝে কি? কদিন পর আবার দেখবে জঙ্গলে গিয়ে বাস করার কথা বলবে, হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকতে পারলেই খুশি ওরা। "জুনে হলে লটারি, ফসল ফলে বাহারি" কথাটা কি তুমি শুনেছ? লটারি আগেও ছিল এখনও আছে ভবিষ্যতেও চলবে।
"অনেক জায়গায় কিন্তু লটারি বন্ধ হয়ে গেছে।" মিসেস এ্যাডামস্ বললেন।
"যে কথাটি শুনেছ তা কিন্তু মিথ্যা নয়। গুজব ছড়ানো ছোকরায় ভরে গেছে চারিপাশ।" বুড়ো ওয়ার্নার রেগেমেগে আবার বললেন।
"মার্টিন" ববি মার্টিন লক্ষ্য করলো ডাক শুনে তার বাবা লটারি তুলতে গেছেন।
"ওভারডাইক ..... পার্সি" বিরামহীনভাবে ডেকে চলছেন পরিচালক।
"আমার মনে হয় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, খুব তাড়াতাড়ি।" মিসেস ডানভার তার বড় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বললেন।
"হুম, লটারি তো শেষ হওয়ার পথে।" ছেলে উত্তর দিল।
"তোমার বাবাকে খবরটা পৌছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও।" মিসেস ডানভার আবারও ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
এবার মিস্টার সমারর্স নিজের নাম ডেকে বাক্স থেকে লটারি তুললেন। তারপর ডাকলেন, "ওয়ার্নার।"
"সাতাত্তর বছর থেকে আমি লটারিতে অংশগ্রহণ করছি। ভীড় ঠেলে এগুতে এগুতে বললেন ওয়ার্নার।
কম কথা! সা-তা-ত্ত-র বছর!!
"ওয়াটসন" ডাক শুনেই লম্বা ছেলেটা জটলার মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো। কেউ একজন বলে উঠলো, "ভয় পেয়ো না, জ্যাক।" মিস্টার সমারর্স তাকে অভয় দিয়ে বললেন, "তাড়াহুড়োর কিছু নেই, সময় নাও বাবা।
" জেনিনি।"
এরপর কিছুক্ষণ সময় পরিবেশ কিছুটা স্থবির হয়ে গেল; উপস্থিত জনতা যেন শ্বাস নিতেও ভুলে গেছেন! অবশেষে মিস্টার সমারর্স ঘুরে দাঁড়িয়ে জটলার দিকে হাতের কাগজটা ধরে বললেন, "এক মিনিট কেউ নড়াচড়া করবেন না; প্লীজ, এবার হাতে রাখা লটারির কাগজটি খোলে ফেলুন সবাই। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে কানাঘুষা শুরু করলো মহিলারা। সবার একটাই জিজ্ঞাসা "কার নাম উঠেছে?"; "কে লটারি পাইলো?"; "নামটি কি ডানবার?"; "নাকি ওয়াটসন?"
এবার সবাই একযোগে বলে উঠলো, "হ্যাচিসনের নাম উঠেছে, হ্যাচিসন; এবার বিল হ্যাচিসনের নাম উঠেছে।
" যাও, যাও; তোমার বাবাকে গিয়ে সংবাদটি দিয়ে আস।" মিসেস ডানভার তার বড় ছেলেকে তাগদা দিলেন।
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে হ্যাচিসন পরিবারকে খোঁজতে লাগলো। বিল হ্যাচিসন নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বিস্ফুরিত চোখে হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে টেসি হ্যাচিসন চিৎকার দিয়ে মিস্টার সমারর্সকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, "আপনি আমার স্বামীকে পছন্দ মতো কাগজ তোলার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেন নাই; আমি তা দেখেছি, এটা স্রেফ অবিচার!"
"খেলাটা কিন্তু দারুন হয়েছে, টেসি।" মিসেস ডেলাক্রক্স বললেন। সাথে মিসেস গ্রেভস যুক্ত করলেন, "আমাদের সবার জন্য সমান সুযোগ ছিল।
"চুপ কর, টেসি।" বউকে উদ্দেশ্য করে বিল হ্যাচিসন বলে উঠলেন।
কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন মিস্টার সমারর্স, "সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনুন, "লটারির কার্যক্রম দ্রুত শেষ হওয়ার পথে; আশা করি বাকি কাজগুলোও দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।" এরপর তিনি আরেকটা তালিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, "বিল, পরিবারের কর্তা হিসাবে তুমিই কাগজ তুলেছ। তোমার বাড়িতে আর কেউ বাকি আছে?"
"বাড়িতে 'ডন' আর 'ইভা' আছে।" মিসেস হ্যাচিসন এবার চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, "ওদেরকেও লটারি তোলার সুযোগ দেওয়া হোক।"
"মেয়েদেরকে তাদের স্বামীর পরিবারের অংশ হিসেবে ধরা হয়, টেসি"; মিস্টার সমারর্স শান্ত গলায় উত্তর দিলেন। সাথে যোগ করলেন, বাকি সবার মতো নিয়মটা তোমারও ভাল মত জানা আছে, তাই না?"
"এট অবিচার।" টেসি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন।
"কিছুই করার নেই, জো।" বিল হ্যাচিসন দৃঢ়তার সাথে বললেন। আমার মেয়েটা ওর স্বামীর পরিবারের হয়ে লটারি টেনেছে। এটাই সত্যি; ছোট দু'টি বাচ্চা ছাড়া আমার পরিবারে আর কোন বাড়তি মানুষ নেই।
"তার মানে বাড়ির কর্তা হিসেবে যেমন তুমি আছ, ঠিক তেমনি পরিবারের পক্ষ থেকেও তুমি; কি ঠিক বলি নাই?"
"ঠিক বলেছ", বিল হ্যাচিসন উত্তর দিলেন।
"বাড়িতে বিল জুনিয়র, ন্যান্সি, পিচ্চি ড্যাভ, টেসি আর আমি থাকি।"
"তাহলে তো ঠিক আছে; হ্যারি, তুমি কি তাদের কাছ থেকে লটারির কাগজগুলো ফিরিয়ে নিয়েছ?" মিস্টার সমারর্স জানতে চাইলেন।
মিস্টার গ্রেভস মাথা নাড়ালেন এবং কাগজের টুকরোগুলো দেখালেন। "এগুলো সব বাক্সের মধ্যে রেখে দাও।" নির্দেশনা দিলেন মিস্টার সমারর্স; এছাড়া বিলের হাতের কাগজটাও বাক্সে ফেলে দাও।"
"আমি ভেবেছিলাম আবার নতুন করে লটারি হবে।" নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললেন, মিসেস হ্যাচিসন। তিনি আবারও অভিযোগের সূরে বলতে লাগলেন, "আমি এখনও বলছি লটারির প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না; আপনারা সবাই দেখেছেন বিলকে একদম সময় দেওয়া হয়নি।"
মিস্টার গ্রেভস পাঁচটি কাগজের টুকরো বাছাই করে আবার বাক্সের ভেতরে ফেললেন; বাকিগুলো ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন, এগুলো বাতাসে ভেসে অজানার উদ্দেশ্যে উড়ছিল।
"সবাই মনযোগ দিয়ে শুনুন।" মিসেস হ্যাচিসন উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্য আবার বলে উঠলেন।
"বিল, তুমি কি প্রস্তুত?" মিস্টার সমারর্স তাড়া দিলেন। স্ত্রী আর সন্তানদের দিকে এক পলক তাকিয়ে সায় দিলেন বিল হ্যাচিসন।
"শুনুন", মিস্টার সমারর্স আবারো ঘোষণা দিলেন সব কাগজ তোলা শেষ হলে তবেই নিজের হাতের কাগজটা খোলা যাবে। হ্যারি, তুমি এবার ড্যাভকে সাহায্য কর। পিচ্ছি ড্যাভকে হাতে ধরে এগিয়ে নিয়ে আসলেন মিস্টার গ্রেভস, খুশি মনেই বাক্সের সামনে দাড়ালো সে; "এবার বাক্স থেকে একটা কাগজ তুলে নাও বাবু", বাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা হাঁসি দিল ড্যাভ; "একটাই কাগজ তুলবে কিন্তু। হ্যারি, কাগজটা তোমার কাছে রাখ।" পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী ড্যাভের শক্ত করে রাখা মুটির ভেতর থেকে ভাঁজ করা কাগজটি বের করে নিলেন মিস্টার গ্রেভস, বাচ্চাটা তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
"এবার ন্যান্সির পালা", বার বছর বয়সের মেয়েটার নাম ডাকতেই ওর স্কুলের বান্ধবীরা আৎকে উঠলো, সে স্কার্ট উচিয়ে ধীর পায়ে বাক্সের কাছে এসে দাঁড়ালো, এবার ভয়ে ভয়ে একটা কাগজ তুলে নিল।
"বিল জুনিয়র", মিস্টার সমারর্স বিলিকে ডাকলেন; আতঙ্কে তার মুখটা লাল হয়ে উঠলো, তার পা দুটি কাপতে লাগলো, লটারি তুলতে আরেকটু হলেই সে অসাবধানতা বশত বাক্সটা নীচে পড়ে যেত, অনেক ভেবেচিন্তে একটা কাগজ তুলে নিল বিলি।
এবার মিসেস হ্যাচিসনের দিকে তাকালেন লটারির পরিচালক; "টেসি, এবার তোমার সময়"; তিনি একটু ইতস্তত করলেন, চারপাশ একপলক দেখে নিলেন এবং বিড় বিড় করে মনে মনে কি যেন বলতে বলতে হাত ডুকালেন বাক্সের ভেতর, তারপর দ্রুত একটুকরো কাগজ বের করে পেছনে লুকিয়ে ফেললেন।
বাকি রইলেন কেবল "বিল", " বিল হ্যাচিসন", মিস্টার সমারর্সের ইশারা অনুযায়ী শেষ কাগজটা হাতে তুললেন তিনি।
কথা বলতে ভুলে গেছে যেন সবাই, চারদিকে অসহ্য নীরবতা। ভীড়ের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগলো, "ন্যান্সি যাতে না হয়, আশা করি ন্যান্সির নাম আসবে না।" সেই কণ্ঠস্বর যেন সবার হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করলো।
"আগে এসব রং তামাশা হতো না, বুড়ো ওয়ার্নার বললেন। মানুষ আর আগের মতো নেই।"
"ঠিক আছে।" তাহলে সবাই হাতের কাগজটা খুলে ফেলুন। "হ্যারি, তুমি পিচ্চি ড্যাভের কাগজটা খোল।"
মিস্টার গ্রেভস কাগজটা খোলে তুলে ধরতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো উপস্থিত জনতা; সেই কাগজে কোন দাগ বা ছোপ নেই। ন্যান্সি আর বিল জুনিয়র একই সাথে নিজেদের কাগজ খোলে ফেললো, ওদের হাঁসি দেখেই বুঝা যাচ্ছে কি ঘটনা। বাকিটুকু কাগজ মেলে ধরতেই নিশ্চিত হওয়া গেল কাগজগুলো ধবধবে সাদা, একদম ফাঁকা।
এবার বিল হ্যাচিসনের কাগজটা খোলতেই ফকফকা সাদা লাগলো; এতে কোন দাগ নেই।
"তাহলে, নিশ্চিত টেসিই হবে।" মিস্টার সমারর্স জোর গলায় বলে উঠলেন।
বিল হ্যাচিসন এবার জোর করে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কাগজটি কেড়ে নিয়ে খোলে ফেললেন; উঁচু করে ধরতেই সবাই দেখলো কাগজের মাঝখানে একটা কালো দাগ দেওয়া। গতকাল রাতে কয়লা কোমপানীর অফিসে বসে গাঢ় পেন্সিল দিয়ে এই দাগটা দিয়েছেন পরিচালক মিস্টার সমারর্স।
"আর দেরী করা যাবে না", মিস্টার সমারর্স এবার ঘোষণা করলেন যত তাড়াতাড়ি আয়োজনটি শেষ করা যায় ততই মঙ্গল।
গ্রামের লোকজন যেন এই নির্দেশের অপেক্ষা করছিল; পুরাতন রীতিনীতির অনেক কিছু ভুলে গেলেও পাথর নিক্ষেপের কথা সবার মনে আছে। সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটে গেল পাথরের স্তুপের দিকে। হাতের কাছেই বিশাল একটা পাথর দেখে দুই হাতে সেটাকে তুলে নিলেন মিসেস ডেলাক্রক্স; এরপর মিসেস ডানবারের দিকে তাকিয় বললেন, "কি হলো জলদি শুরু করুন।"
মিসেন ডানবার দুই হাতে কয়েকটা ছোট ছোট পাথর বেছে নিলেন এবং উত্তেজনা চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন; তিনি মিসেস ডেলাক্রক্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমি একদম দৌড়াতে পারি না, তুমি সামনে যাও, আমি পেছনে পেছনে আসছি।"
বাচ্চাগুলো আগে থেকেই পাথর নিয়ে অপেক্ষা করছিলো; এরই মাঝে কে যেন ছোট্ট ড্যাভের হাতে কয়েকটা নূড়ি ধরিয়ে দিয়েছে।
টেসি হ্যাচিসন মাঠের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখলেন গ্রামবাসীরা চারপাশ থেকে পাথর হাতে এগিয়ে আসছে। "এটা অবিচার, একদম অবিচার", মিসেস হ্যাচিসন আবারও বলে উঠলেন। হঠাৎ একটুকরো পাথর ছুটে এসে তার কপালের একপাশে আঘাত করলো। বুড়ো ওয়ার্নার দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে হাক দিলেন, "কোথায় গেলে সবাই? এসো এসো, জলদি এসো।" স্টিভ এডাম সবার সামনে আর মিসেস গ্রেভস তার ঠিক পাশে।
"এ হতে পারে না, এটা অবিচার", প্রাণপনে চিৎকার করলেন মিসেস হ্যাচিসন। তার কান্না মিশ্রিত আর্তনাদে কেউ গুরুত্ব দিল না। একসাথে ঝাপিয়ে পড়লো গ্রামবাসী, বৃষ্টি ফোঁটার মতো একের পর এক পাথর ছুটে গেল লটারি বিজয়ীর পানে।
"হাজার বছর ধরে চলে আসা প্রথা না মেনে যে উপায় নেই তাদের!"
[ ১৯৪৮ সালের ২৬শে জুন 'The Lottery' গল্পটি বিখ্যাত 'The New Yorker' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিতে এটি পৃথিবীতে এ পর্যন্ত লেখা সবচেয়ে টুইস্টেড গল্প। এটিকে 'one of the most famous short stories in the history of American literature' হিসেবে গণ্য করা হয়। গল্পটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর চতুর্দিকে সমালোচনার ঝড় উঠে। প্রতিবাদ জানিয়ে হাজার হাজার চিটি আসতে শুরু করে পত্রিকা অফিসে। অনেক পাঠক গল্পের শেষ পরিণতির বিশদ ব্যাখ্যা জানতে চান।
গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার মাস খানেক পর লেখিকা তাঁর প্রতিক্রিয়া স্বরুপ 'San Francisco Chronicle'-এ লেখেন "Explaining just what I had hoped the story to say is very difficult. I suppose, I hoped, by setting a particularly brutal ancient rite in the present and in my own village to shock the story's readers with a graphic dramatization of the pointless violence and general inhumanity in their own lives."]
লেখক পরিচিতি -
"Shirley Jackson" একজন্য বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক। ১৯১৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তিনি ক্যালিফোরনিয়ার সান ফ্রানসিসকোতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় দুই দশকের সাহিত্য চর্চায় তিনি ৬টি উপন্যাস, দু'টি স্মৃতিকথা এবং ২০০টির বেশি গল্প লেখেন। বিশ্বব্যাপী তিনি "The Queen Of Horror" নামে পরিচিত। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'The Road Through the Wall' প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে; এরপর যথাক্রমে, Hangsaman (১৯৫১); The Bird's Nest (১৯৫); The Sundial (১৯৫৮); The Haunting of Hill House (১৯৫৯); We Have Always Lived in the Castle (১৯৬২) প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো; (1) The Lottery (2) The Missing Girl (3) Charles (4) The Possibility of Evil (5) The Daemon Lover (6) Pillar of Salt (7) One Ordinary Day, With Peanuts (8) The Tooth (9) The Summer People (10) The Witch ইত্যাদি।
১৯৬৫ সালের ৮ আগস্ট মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি হার্ট এ্যাটাকে মারা যান।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত পোস্ট।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প-ধূমকেতু
ধর্ষণ ও ধর্ষক (বাংলাদেশ/বহির্বিশ্ব)
অনুবাদ গল্প-(দি নেকলেস)
দি গিফট অফ দ্যা ম্যাজাই
গল্প লেখার সহজ পাঠ
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:২৭