১.
কাজের তেমন ব্যস্ততা নেই আজ। তারপরও প্রতিদিনের মত রেবেকা ম্যাডাম ঠিক সময়ে অফিসে এসেছেন। সকাল নয়টা থেকে নয়টা তিরিশের মধ্যে অফিসে পৌছান তিনি। গত দুই-তিনদিন থেকে সারা দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন আর হরতাল-অবরোধ থাকায় অফিসের ব্যস্ততা তুলনামূলক কম। এত রাজনীতি, এত আন্দোলন, এত মিছিল-মিটিং কেন হয় তা রেবেকার ছোট মগজে ধরে না। কবে ইলেকশনে ভোট দিয়েছিলেন মনে নেই; ভোট-জোট আর ক্ষমতার রাজনীতিতে কোন আস্থা নেই রেবেকার। দলগুলোর মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষের জন্য প্রায় সময় ব্যবসায় লস গুনতে হয়, বিদেশি ভায়াররা দেশে আসতে ভয় পায়, সময়মতো শিপমেন্ট হয় না। এজন্য বিদেশীদের কাছে নিজের দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হয়।
ম্যাডাম এতে বিব্রত হন। সাথে বাড়ে দেশ-দশের লজ্জা।
বায়িং হাউজের ব্যবসা রেবেকার। বনানীতে বহুতল ভবনে বিশাল অফিস তার। ২১ তলা ভবনটির টপ ফ্লোরে বসেন তিনি। কোম্পানির অধীনে ১১টি গার্মেন্টস আাছে তাদের; চারটি মিরপুরে, পাঁচটি টঙ্গী আর বাকি দু'টি নারায়নগঞ্জে। বিশাল এ কোম্পানীর চেয়ারপার্সন হলেন রেবেকা ম্যাডাম। বনানীর এ অফিসটা মূলত বিদেশী বায়ারদের সাথে অন্যান্য কোম্পানীগুলোর সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া প্রতিটি গার্মেন্টসের দায়িত্বে থাকা একজন করে জিএম আছেন এখানে। আছেন কোম্পানির এইচআর, ডিজাইনার, মার্চেন্ডাইজার ইত্যাদি বহু পদবীর লোকজন।
সব ক'টি কোম্পানীর অপারেটর/অফসিয়াল মিলে প্রায় চব্বিশ হাজার মানুষ রেবেকার অধীনে কাজ করেন। তবে বনানীর এ অফিসে আছেন সর্ব সাকুল্যে ৯৩ জন কর্মচারী/কর্মকর্তা। লক্ষনীয় বিষয় যে, তার অফিসে কর্মরত অফিসার/কর্মচারীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মহিলা। মহিলাদের জন্য আছে আলাদা ওয়াশ রুমের সুব্যবস্থা। মহিলারা যাতে অফিসে কমফোর্ট ফিল করেন এজন্য সদা সতর্ক থাকেন তিনি। মহিলা কর্মচারী, কর্মকর্তাদের জন্য আছে বেতন সহ ছয় মাসের মাতৃত্বককালীন ছুটির বিধান। এছাড়া বিবাহ ভাতার ব্যবস্থাও আছে।
প্রতিদিন অফিসে এসে নিয়ম করে এক কাপ গ্রীন টি পান করেন তিনি। বেশ কয়েক বছর থেকে নিয়মিতভাবে চলছে এটি। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নাই। প্রতিদিন নিজেই ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি গরম করে চা তৈরী করেন। একান্ত প্রয়োজন না হলে কর্মচারীদের বিরক্ত করেন না। আজ দিনটি মেঘলা, মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। বৈশাখ মাসের এ সময়টাতে কালবৈশাখী হয় বলে খুব ভয় পান তিনি; এমনকি বিদ্যুৎ চমকালেও ভীষণ ভয় হয়। পত্রিকায় পড়েছেন ইদানিং বজ্রপাতে বাংলাদেশে অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
ছোট বেলা থেকেই অন্ধকার, ঝড় ও বজ্রপাতকে তিনি এড়িয়ে চলতে চান।
রেবেকা ম্যাডামের অফিসটি বেশ ছিমছাম। গোছানো। আছে চার-পাঁচটি চেয়ার, একটি আলমারি ও দু'টি সেল্ফ। এছাড়া আছে মাঝারি আকারের একটি সোফা ও ওয়াশরুম। আছে দক্ষিণমুখী একটি জানালা। জানালাটি সব সময় ভারী পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। পুরো অফিসটি এসি। এজন্য রুমের পর্দা/জানালা খোলার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। যখন ঝম ঝম বৃষ্টি হয়, পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়ে তখন পর্দাটা একটু ফাঁক করে প্রকৃতির এ রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করেন তিনি।
২.
মানুষের জন্ম, শৈশব, কৈশর আর যৌবনকাল কতই না বৈচিত্র্যময়; একটি সময়ের ভাবনা, ভাল লাগা-মন্দ লাগা, স্বপন-উপলব্ধি, চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে কত যে দূরত্ব তা কেউ কখনো মেপে দেখে না। বয়স বাড়ার পাশাপাশি মানুষের চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে, আসে পরিপক্বতা। অথচ জীবনের এতো এতো অভিজ্ঞতা অর্জন করার পরও মানুষ ভুলের মধ্যে বসবাস করে। যা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চক্রাকারে আবর্তিত হয়। বিষয়টি ইদানিং খুব বেশি ভাবায় রেবেকা ম্যাডামকে।
হঠাৎ দরজায় জিএম হারুন সাহেবের নক শুনে ভাবনায় ছেদ পড়লো তার।
-- কি অবস্থা জিএম সাহেব, কিছু বলবেন?
-- সুখবর আছে ম্যাডাম। সুইডেনের এইচ এন্ড এম কোম্পানির অর্ডারটি ফাইনাল হয়ে গেছে। আগামী ক্রিসমাসের আগে তারা পঞ্চাশ হাজার পিস লেডিস সার্ট ও ত্রিশ হাজার পিস লেডিস ডেনিম প্যান্ট আমাদের কাছ থেকে নেবে। আর ইউএস এর গ্যাপের অর্ডারটিও দুই-এক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত হয়ে যাবে। জার্মানির এডিডাসের শিপমেন্ট আজ বিকালে হয়ে যাবে আশা করছি।
-- ভাল। খুশির সংবাদ। আপনারা সঠিকভাবে কাজ করছেন এজন্য এইচ এন্ড এমের কাজটি পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
-- না, ম্যাডাম এ কৃতিত্ব আপনার। আপনি দক্ষ হাতে কোম্পানিটা পরিচালনা করছেন বলে আমরা সফলতা পাচ্ছি।
জিএম লোকমান সাহেবকে আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে ফাইলে সই করলেন রেবেকা ম্যাডাম। ফাইলটি তার হাতে দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন-
-- নতুন কাজটির তদারকির দায়িত্ব কাকে দিয়েছেন?
-- এখনো কাউকে সিলেক্ট করা হয়নি, ম্যাডাম।
-- দায়িত্বটা মিস্ মিলা রহমানকে দেবেন। আর তাকে বলবেন, এক্ষুণি যেন আমার সাথে এসে দেখা করে।
-- ঠিক আছে ম্যাডাম, আ-সি।
-- হ্যা, শুনুন। আরেকটি কথা........
-- জি, ম্যাডাম।
-- বিকাল তিনটায় সব সেক্টরের জিএমদের নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয় আছে, সবাইকে জানিয়ে দেবেন। নতুন একটি নিট ওয়ার কোম্পানি খোলার প্লান আছে।
-- জি, অবশ্যই।
রেবেকা ম্যাডামের অফিসে অদ্ভুত একটি নিয়ম আছে। নিয়মটি এরকম; কোম্পানীর জিএম/ম্যানেজার/বায়ার/মার্চেন্টাইজারের কাছে তিনি ম্যাডাম। তবে সাধারণ কর্মচারী/শ্রমিকদের কাছে তিনি আপা। রেবেকা আপা। এটি তার অফিস অর্ডার।
গত চার বছর হলো রেবেকা ম্যাডাম কোম্পানীর চেয়ারপার্সনের দায়িত্বে আছেন; স্বামী আসলাম বেপারী মারা যাওয়ার পর থেকে। অতিরিক্ত নারী, ইয়াবা আর মদের আসক্তি স্বামী নামের লোকটিকে শেষ করে দিয়েছে অকালে। লিভার ও কিডনি ডেমেজে মৃত্যু হয়েছে তার। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক ঝড়-তুফান গেছে রেবেকার উপর দিয়ে। আসলামের বিশাল এ সম্পদের উপর অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি ছিল। অনেক মামলা মোকদ্দমাও মোকাবেলা করতে হয়েছে রেবেকাকে। কিছু সম্পদ হাতছাড়া হলেও কোর্টের রায়ে স্বামীর বেশিরভাগ সম্পদ ফিরে পেয়েছেন তিনি।
রিসিপশনিস্ট হিসাবে আসলাম বেপারীর একটি কোম্পানীতে চাকরি করতেন রেবেকা। মফস্বলের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় মামার বাসায় থেকে জগন্নাথ কলেজ হতে মার্কেটিংয়ে অনার্স করেছেন তিনি। পাশাপাশি ইংরেজি বিষয়েও তার ভাল দখল ছিল। দেখতে আহামারি সুন্দরী না হলেও শ্যামলা চেহারার মাঝারি গঠনের আধুনিক, স্মার্ট একটি মেয়ে ছিলেন রেবেকা ম্যাডাম। ছোটবেলা থেকেই খুব চটপটে, মেধাবী ও কর্মট ছিলেন তিনি। কম্পিউটারে ভাল টাইপও জানতেন।
কাজ করতে করতে কখন যে আসলাম বেপারীর শিকারে পরিণত হলেন আজো ভেবে পান না তিনি। এ বিয়েতে রেবেকার কোন মত না থাকলেও পরিবারের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হন। বিয়ের আগে আসলাম লাগামহীন জীবনযাপন করলেও পরবর্তীতে রেবেকা তাকে অনেকটা কন্ট্রোলে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু রক্তে বহমান নিষিদ্ধ আসক্তি শেষ পর্যন্ত কাল হল তার। স্বামী নামের লোকটার জন্য তেমন মায়া নেই রেবেকার, তবে আছে কৃতজ্ঞতাবোধ আর কিছু অম্ল-মধূর স্মৃতি।
রেবেকা ম্যাডামের একমাত্র ছেলে পার্থ অস্ট্রেলীয়ায় পড়াশুনা করে। হলিডে হলে বছরে দু'বার দেশে আসে। মা কখনো চান নাই ছেলেটা বিদেশে পড়তে যাক। শেষ পর্যন্ত ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। বাবার সম্পত্তি, ব্যাবসা-বাণিজ্য কোন কিছুর প্রতি ছেলেটির তেমন আগ্রহ নেই। ভয় হয় যদি ছেলেটি ফিরে না আসে? ছেলেকে নিয়ে বেশী ভাবতে পারেন না রেবেকা। ইদানিং কি যেন হয়েছে তার; একটু টেনশন হলে প্রেসারটা হাই হয়ে যায়। মাথা ভন ভন করে ঘুরায়। চোখে অন্ধকার দেখেন।
ছোটবেলায় টিভি দেখার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল তার; তবে নিজেদের বাড়িতে কোন টিভি ছিল না। যখন নানু বাড়িতে বেড়াতে যেতেন তখন ফিলিপ্সের সাদা কালো ১৪ ইঞ্চি একটি টিভি দেখার সুযোগ পেতেন। বহু আকাঙ্খিত ছিল সেই টিভি দেখা। এছাড়া প্রতিদিন পাড়া প্রতিবেশি অসংখ্য মানুষ টিভি দেখতে ভীড় করতো নানা বাড়িতে। শুক্রবার বিকালে বিটিভিতে বাংলা ছায়াছবি দেখানো হত বলে পাড়া প্রতিবেশী থেকে প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটতো। ব্যাপারটি বেশ ভাল লাগত রেবেকার।
কিশোরী রেবেকার স্বপ্নগুলো ছিল খুব সাদামাটা। একটি রঙিন টেলিভিশন। একটি দুই কামরার ছোট্ট টনশেডে ঘর। দুই বেলা পেট ভরে ডাল ভাত। একজন ট্রেন ড্রাইভার স্বামী। তিনটি ফুটফুটে বাচ্চা। একটি স্টাইলিশ চায়নিজ কালো চশমা। সুন্দর লাল পাড়ের একটি বেনারসি শাড়ি। সিলেটের জাফলং, খুলনার সুন্দরবন আর কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি।
এখন তার বাসায় সনির ৬২ ও ৪০ ইঞ্চি দু'টি স্মার্ট টিভি আছে, কিন্তু দেখা হয় না। উত্তরায় আট বেডরুমের ডুপ্লেক্স ভিলা তার। এ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় বিশ-বাইশটি দেশ ঘোরা হয়ে গেছে। কিন্তু অবাকের বিষয় এত প্রাচুর্য্যও তাকে আকৃষ্ট করতে পারে না, সুখ দিতে পারে না। বাসায় গেলে একাকীত্ব আর ভালবাসার আকাঙ্খা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। প্রাসাদপম এ অট্টালিকাকে কখনো কখনো তার কাছে নরক মনে হয়।
-- আপা, আসতে পারি?
-- হুম, আসো; কিছু বলবে শেফালি?
চোখের ইশারায় রিসিপশনিস্ট শেফালিকে সম্মতি দিয়ে জানতে চাইলেন।
-- আপনার নতুন যে ড্রাইভার আসার কথা ছিল উনি এসেছেন। আপনি অনুমতি দিলে ভেতরে নিয়ে আসবো।
-- ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও।
ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হাতে নিয়ে রেবেকা চমকে উঠলেন, নামটি খুব পরিচিত তার। কিন্তু লোকটিকে তো পরিচিত মনে হচ্ছে না।
-- ম্যাডাম?
হাতের ইশারায় উনাকে সামনের চেয়ারে বসতে বল্লেন। সাথে প্রশ্ন জুড়ে দিলেন-
-- আপনি আগে কোথায় কোথায় চাকরি করেছেন?
-- ম্যাডাম, আমি গত বিশ বছর কুয়েতে এক শেখের বাড়িতে গাড়ি চালিয়েছি। এর আগে দুবাইতেও কয়েক বছর ড্রাইভিং করেছি।
-- পড়াশুনা কতদূর আপনার?
-- পড়াশুনা তেমন করতে পারি নাই ম্যাডাম। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় পরিবারের হাল ধরতে দুবাই চলে যাই। এক বছর হলো একেবারে দেশে চলে এসেছি। আমার ইচ্ছা ছিল না, ছেলে-মেয়েরা জোর করে নিয়ে এসেছে। আমার ওয়াইফও চাচ্ছিলেন আমি দেশে চলে আসি। আপনাদের দোয়ায় বউ বাচ্চা নিয়ে অনেক সুখে আছি, ম্যাডাম।
-- ভালো। দেশে থাকলে পরিবারকে আরো বেশি সময় দিতে পারবেন।
-- হোম ডিসট্রিক্ট?
-- বাড়ি ম্যাডাম গাইবান্ধা।
-- গাইবান্ধা?
-- জি।
-- ইন্টারমিডিয়েট কারমাইকেল কলেজ, রংপুর?
মুখের দিকে চেয়ে চট করে বলে উঠলেন, রেবেকা ম্যাডাম।
-- কেমনে জানলেন ম্যাডাম, লাইসেন্সে তো কলেজের নাম লেখা নেই?
-- এখন কি আপনি কোথাও চাকরি করেন?
-- হ্যা, ম্যাডাম। একজন ডাক্তারের প্রাইভেট কার চালাই। কিন্তু সুযোগ সুবিধা তেমন পাই না। বুঝেনই তো সংসারে খরছ বেড়ে গেছে। বড় কোন কোম্পানীতে কাজ করলে হয়তো বেশি সুযোগ সুবিধা পাব এজন্য এসেছি।
-- ঠিক আছে। আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটি রিসিপশনে রেখে যান। আপাতত আমাদের কোন ড্রাইভার লাগবে না। প্রয়োজন হলে অবশ্যই কল করব।
-- ঠিক আছে ম্যডাম। আসি।
৩.
মোবাইল নাম্বারটা স্বচ্ছ ভারী কাঁচের টেবিলের নীচে রাখা হলেও টানা টানা হাতের লেখা সংখ্যাগুলো দেখলেই প্রতিনিয়ত চোখ আটকে যায় রেবেকার। মনের অজান্তে কাজের ফাঁকে চোখ দু'টি ঠিকই সংখ্যা দু'টিকে খোঁজে ফেরে। ০১ দিয়ে শুরু হয়ে নাম্বারটা শেষে হয়েছে ০৭ দিয়ে। জুলাই মাসের প্রথম দিনটি হলো রেবেকার জন্মদিন; হয়তো এজন্য সংখ্যাগুলো তাকে টানে!
আনমনে পত্রিকার পাতা ওল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ ছোট্ট একটি সংবাদের দিকে দৃষ্টি পড়লো রেবেকার, "আজ সন্ধা ছয়টায় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে দেশের সেরা লাইব্রেরিয়াকে সংবর্ধনা দেবে সরকার।" অনুষ্ঠানে রেবেকা ম্যাডামেরও উপস্থিত থাকার কথা; দেশের প্রথম সারির করদাতা হিসেবে সরকার তাকে সিআইপি মর্যাদা দিয়েছে। অথচ ইদানিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসয় বেমালুম ভুলে যান তিনি। তবে আজকে যাবেন, এমন গুণী মানুষটির সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া কম কথা নয়।
ছয়টা বাজার বিশ মিনিট আগেই রেবেকা ম্যাডাম হলরুমে গিয়ে উপস্থিত। অতিথিরা তখনো আসছেন; মঞ্চের সামনে ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত একটি আসনে বসতে বসতে চোখে পড়লো সোনালী মলাটে আবৃত একটি খাম। খামটি খোলতেই দৃষ্টিগোচরে আসলো সংবর্ধিত অতিথির সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি।
সুধী,
তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন; তাঁকে একটি প্রতিষ্ঠান বললেও কম বলা যাবে। প্রচার বিমূখ এ মানুষটি জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন বই কেনার পেছনে। লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তার কথা মানুষের মাঝে প্রচার করতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি খুব বেশি পড়াশুনা করতে না পারলেও জ্ঞান পিপাসু একজন গুণী ব্যক্তি। তিনি বিশ্বাস করেন-
"কেবলমাত্র বই পড়েই সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব; বই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাবিত করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে। নিজের চিন্তা-চেতনা ও বিবেককে শানিত করে। এছাড়া বই সমাজের পারষ্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো মজবুত করে। একটি জাতি যখন শিক্ষিত হয় তখন দেশের মর্যাদাও বিশ্ব দরবারে উপরের দিকে থাকে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু পাঠ্য বই পড়লে চলবে না, এজন্য প্রয়োজন অপাঠ্য বইয়ের প্রয়োজনীয় অনুশীলন। আর প্রয়োজনীয় বইয়ের অন্যতম ভান্ডার হলো লাইব্রেরি।"
বই পড়া আর লাইব্রেরির প্রতি ভালবাসার টানে তিনি কখনো সংসারমুখী হন নাই। তিনি যে টাকা উপার্জন করতেন তার সবটুকু বই কেনার পেছেনে খরছ হয়ে যেত। তাঁর ধারণা ছিল সংসারি হলে যে সামান্য টাকা তিনি উপার্জন করেন তা থেকে সংসার খরছ বাদে বই কেনার কোন টাকা অবিশিষ্ট থাকবে না। আজ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ''আলোর পথে, বইয়ের সাথে" লাইব্রেরিতে দেশি বিদেশি প্রায় পঁচিশ হাজার বই আছে। এটি এখন দেশের অন্যতম বড় পাঠাগারের মর্যাদা পেয়েছে। এজন্য তাকে অভিনন্দন জানাই।
"শুভেচ্ছান্তে, আয়োজক কমিটি।"
রেবেকা ম্যাডাম এক নিঃশ্বাসে বায়োগ্রাফিটি পড়ে শেষ করতেই মঞ্চের পেছনের বড় পর্দায় চোখ আটকে গেল!! হঠাৎ খেয়াল হলো অতিথি আসনে সবার মধ্যমনি হয়ে চুপচাপ বসে আছেন আজকের সংবর্ধিত ব্যক্তি। কখন যে উনি এসে আসনে বসেছেন খেয়াল নেই। শত শত মানুষের করতালির শব্দে তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন উপস্থাপক।
উপস্থাপক বলতে লাগলেন, " ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় জীবিকার সন্ধানে পরিবারের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন আরবের মরুভূমিতে। সারাদিন সেখানে উট চরাতেন। তবে রাতের বেলা সময় কাটতো না তার। দেশে থাকতে বইয়ের পোঁকা হলেও বিদেশে বাংলা বই পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। দিন যতই গড়াতে লাগলো নিজেকে তিনি রোবট ভাবতে শুরু করলেন। দেশে থাকতে সৃজনশীল যে মন মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে পরিচর্যার অভাবে মরিচা ধরতে শুরু করলো। নরক যন্ত্রণায় পুড়তেন; মনে হত তাঁর নিজের কোন অস্তিত্ব নেই, কোন জিজ্ঞাসা নেই, স্বাদ-আহ্লাদ নেই, কোন মগজ নেই। গাঁধা আর নিজের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতেন তিনি।
সংকল্প করলেন দেশে ফিরে জমানো সব টাকা দিয়ে বই কিনে মানুষের মাঝে বিতরণ করবেন, লাইব্রেরি দেবেন, মানুষকে শিক্ষা অর্জন করার তাগিদ দেবেন। আর কোন মানুষ যাতে পরিবারের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করতে বিদেশে কামলা দিতে না হয়। তিনি আমাদের আজকের সম্মানিত সংবর্ধিত অতিথি জনাব জয়নাল আবেদীন; বাড়ি গাইন্ধা জেলার পলাশ বাড়ি উপজেলায়। আসুন সবাই দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে আমাদের আজকের সংবর্ধিত অতিথিকে বরণ করে নেই। তাকে অভিবাদন জানাই।
রেবেকার দু'গাল বেঁয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো; অনেকটা উঁচু সুইচগেট দিয়ে আটকানো সর্বনাশা বড় কোন নদীর জল যেমন বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে অল্প অল্প গড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনই। এ অশ্রু আনন্দ নাকি বেদনার, নাকি জোর করে ছাই চাপা দিয়ে আটকানো কোন তুষের আগুনের তা বলা মুশকিল। জয়নাল আবেদীন নামে সবাই তাকে চিনলেও রেবেকা মারুফ বলে ডাকতো। গাইবান্ধায় বাড়ি বলে রেবেকা প্রায়ই তাকে 'গাই গরু' বলে খেপাতো। কারমাইকেল কলেজের মাত্র দেড় বছররের সহপাঠি হলেও তিনি ছিলেন রেবেকার পৃথিবী। এক টুকরো কিশোরী মনের আলপনা-কল্পনা; বাকি জীবনটা এগিয়ে নিয়ে চলার গীতিকাব্য। হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া ধূমকেতু।
তাহলে ড্রাইভারের ইনটারভিউতে কেন তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন? তিনি কি প্রিয়তমা রেবেকাকে চিনতে পেরেছিলেন? নাকি নিজের গিফট করা পিতলের আংটিটা রেবেকার হাতে দেখতে পেয়েছিলেন?
জানা নেই রেবেকার।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত পোস্ট।
অনুবাদ গল্প-(দি নেকলেস)
দি গিফট অফ দ্যা ম্যাজাই
গল্প লেখার সহজ পাঠ
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আধুনিক কবিতার পাঠ (সমালোচনা)
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৫