১.
আফায় মনে অয় আমায় চিনতে ফারেন নাই? রিক্সায় প্যাডেল মারতে মারতে আড়চোখে পেছনে থাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ড্রাইভার ময়নু মিয়া। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জবাব না পেয়ে প্রশ্নটি আবার রিপিট করলো................
-- আফায় কী মোর কথাটি হুনতে পাইছইন? অ-আফা!!
-- আমাকে বলছেন?
-- হো, আপনারেই তো বলছি; রিক্সায় তো আফনে ছাড়া অন্য কেউ নেই।
-- কেন, কিছু বলবেন?
গভীর মনোযোগে ড্রাইভারকে পর্যবেক্ষণ করে মোনা সিদ্ধান্ত নিল লোকটি তার পরিচিত কেউ না। এর আগে এই রিক্সায় কোনদিন উঠেছে বলেও মনে পড়ছে না। পরনে নীল রঙের কালো আর সাদা ক্রস করা একটি লুঙ্গি, উপরের অংশে একটি নাইকি লেখা সাদা গেঞ্জি তবে পেটের সাইডে কিছুটা ছেঁড়া, বুকের কাছে গেঞ্জিতে মাকড়শার জালের মত ছোট ছোট ছিদ্র। পায়ে বাটা কোম্পানির একটি পুরাতন স্যান্ডেল আর রোদ থেকে বাঁচার জন্য মাথায় ঘামে জবজবা একটি রাউন্ড ক্যাপ। বয়স বড় জোর চল্লিশ হবে; রোদে পোড়ে হাতের খালি অংশ আর মুখমণ্ডল কালচে আকার ধারণ করেছে। তবে লোকটি কালো নয়, অনেকটা বাদামী কিসিমের। এর আগে এভাবে কোনদিন কোন রিক্সার ড্রাইভারকে পর্যবেক্ষণ করে নাই, মোনা।
একটু দম নিয়ে ময়নু মিয়া আবার বলে উঠলো, "গত কালকেও এই সময় আপনি আমার রিক্সায় উঠেছিলেন। মনে আছে আফনার?
হয়তো বা হবে, কিন্তু মনে পড়ছে না মোনার। জীবনের তেইশটা বসন্ত পার করলেও রিক্সার ড্রাইভারদের চেহারা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করে নাই কখনেো। অনেক চেষ্টা করেও গত কয়েকদিনের কোন রিক্সা ড্রাইভারের চেহারা মনে করতে পারলো না। নাহ, সৃতি শক্তি এই বয়সে এতো দূর্বল হওয়ার কথা নয়!
একটু ভেবে, লজ্জিত মুখে মোনা উত্তর দিল, "হ্যা, হ্যা, খুব মনে পড়েছে! আসলে একটি পার্সনাল বিষয়ে আজ একটু টেনশনে আছি এজন্য চিনতে একটু লেট হয়েছে আপনাকে।"
তবে মনে মনে বললো, "আমি মোটেও তোমাকে চিনি নাই ছোকরা, তুমি কোন জমিদারের পোলা যে তোমাকে চিনতে হবে? চালাও রিক্সা আর ভাব মারো, তাই না!"
আজ সকালেও দুইবার রিক্সা ব্যবহার করেছে মোনা। একবার বড় ভাইয়ের ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতে; আরেকবার বিসিএস কোচিং করতে যেতে। ড্রাইভারগুলো খাটো না লম্বা, কালো না ফর্সা, যুবক না বৃদ্ধ কিছুই মনে করতে পারলো না। শুধু রিক্সায় উঠা-নামা, ভাড়া নিয়ে দামাদমি করা, ফাইনালি কত টাকা ভাড়া মিটিয়েছে তা মনে করতে পারলো।
-- আফা, পার্সনাল সমস্যার কথা কী যেন কইলেন?
এবার মোনার সত্যি সত্যি রাগে মাথা গরম হয়ে গেল। মেয়ে মানুষের পার্সনাল কিছু শুনলেই পুরুষ মানুষদের কৌতুহল চরমে উঠে! একটা সামান্য রিক্সা ড্রাইভারও পার্সোনাল বিষয়াদি জানতে চায়! এতো কৌতুহল কেন তোর? এরকম থার্ডক্লাস অশিক্ষিত লোকেরা মনে মনে ধরেই নেয় বিষয়টি প্রেম গঠিত কিছু একটা হবে! লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ আর চন্ডীদাস-রজকিনীর মত প্রেম কাহিনী এই লেভেলের লোকজনের কাছে দারুন হিট।
তবে রাগটি যথাসম্ভব চেঁপে মোনা বলে উঠলো,
-- এতো প্রশ্ন করছো কেন? রিক্সা জোরে চালাও আমার লেট হয়ে যাচ্ছে; বাসায় তাড়াতাড়ি পৌছিতে হবে। রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা? একটু অসতর্ক হলেই একসিডেন্ট ঘটার রিস্ক থাকে।
-- আফায় মনে অয় মোর কথায় রাগ করলেন? কিছু মনে করবেন না, স্যরি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে একটা সময় মোনা প্রশ্ন করলো-
-- বাড়িতে আপনার কে আছে?
-- আফা, আমার ছোট সংসার। আমার বউ ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে বগুড়ায় থাকে; আমি প্রতিমাসে একবার করে বাড়িতে যাই।
-- বাবা-মা, ভাই-বোন?
-- বাবা-মা ছোট কালেই মারা গেছে, আমার কোন ভাই-বোন নেই।
ততক্ষণে রিক্সা মোনাদের বাসার গেইটে থেমেছে। রিক্সার ভাড়া মেটাতে গিয়ে মোনা খেয়াল করলো লোকটির চোখ দু'টি ছলছল করছে।
-- কি হয়েছে, মন খারাপ?
-- না আফা কিছুই হয় নাই; হঠাৎ ছোট বোনটার কথা মনে পড়ে গেলে। দুই মাস হলো আদরের বোনটা মারা গেছে।
মোনা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, মারা গেছে মানে -
-- হো, আফা। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে এবার অর্থনীতিতে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছিল। বোনটার খুব সখ ছিল বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি বড় পদে চাকরি করার। এজন্য আমি বগুড়া শহরে একটি বিসিএস কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে প্রতিদিন বাসে করে আসা-যাওয়া করতো। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র পঁচিশ মিনিটের পথ। একদিন ট্রাকের সাথে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে.........................। একমাত্র বোনটাকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি আফা। ওর নিষ্পাপ মুখটা মনে পড়লে চোখের পানি আটকে রাখতে পারি না।
জানেন আফা, কোনদিন বোনটির কোন স্বাদ-আহ্লাদ বাদ রাখিনি। কোন অভাব বুঝতে দেইনি। এই রিক্সায় প্যাডেল দিয়েই তাকে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়াইছি। এখন ওর বয়সি কোন মেয়ে রিক্সায় উঠলে কথা বলি, ভালমন্দ খবর নেই। তবে অনেক সময় কেউ কেউ মাইন্ড করে। কোনদিন বিষয়টি কারো সাথে শেয়ার করিনি, আজই প্রথম আপনাকে বললাম।
কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না মোনা; আচমকা একটা ধাক্কা খেলো, হার্টবিট হঠাৎ বেড়ে গেল আর চোখ দু'টি ঝাপসা হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে লোকটিকে সান্তনা দিতে। লোকটির চোখের পানি মুছে দিতে। কিন্তু কিছুই করতে পারে নাই নিজে মেয়ে মানুষ বলে। অনেক আলাপ চারিতায় মানুষটার সাথে একটু মায়াও জন্মেছে তার। কোন মতে ভাড়া মিটিয়ে সস্তা শান্তনা দিয়ে ঘরের সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো।
ঘরে যেতে যেতে খেয়াল হলো লোকটির বোনের সাথে তারও অনেকটা মিল আছে। সে এবার ঢাকার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করেছে, পাশাপাশি বিসিএস কোচিং করছে। তাহলে কী লোকটি জানে আমিও বিসিএস কোচিং করছি? আরো মিল আছে! লোকটার মতো তারও বাবা-মা কেউ জীবিত নেই। এছাড়া মোনার একমাত্র বড় ভাইটিও ড্রাইভার। তবে রিক্সার নয়, বিমানের।
২.
পরদিন সকাল.........
মোনা সিদ্ধান্ত নিল আজ যতবার রিক্সায় উঠবে প্রতিবার ড্রাইভারদের খোঁজ খবর নেবে। তাদের বয়স, চেহারা, পোষাক-পরিচ্ছদ সবই খেয়াল করবে। অনেকটা এসাইনমেন্টের মতো।
বাসা থেকে বের হয়ে মোনার আজকের প্রথম গন্তব্য কলেজ। গলির শেষে বড় রাস্তার মোড়ে এসে দেখলো একটি রিক্সা রেস্ট নিচ্ছে। ড্রাইভারটি প্যাসেঞ্জার সিটে বসে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিমায় সিগারেট ফুঁকছে আর পা দু'টি ড্রাইভিং সিটে তুলে নাচাচ্ছে।
-- মামা যাবেন?
-- কই যাবেন, আফা?
-- মিরপুর।
-- কত নম্বার?
-- দুই।
-- একদাম চল্লিশ টেকা।
-- বিশটাকার ভাড়া চল্লিশ টাকা চাইলেন?
-- আফা সারা রাস্তা জ্যাম; শুধু যেতেই আমার একঘন্টার মতো লাগবে। তাছাড়া আপনি আমার পরতম পেসেঞ্জার; পরতম খেপটা ভালো না হলে দিনটি খারাপ যায়।
মোনা জানে জ্যাম-ট্যাম সব অজুহাত মাত্র। আর মেয়ে মানুষ দেখলে এরা ভাড়া তুলনায় কিছুটা বেশি চায়। লোকটি তার কাছে সুবিধার টেকলো না, তারপরও বলে উঠলো-
-- পঁচিশ টাকা দেব।
-- পারবো না, আফা। আমারে চল্লিশ টেকাই দিতে অইব।
অবস্থা সুবিধার মনে হলো না মোনার। একটু সামনে এগিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করতেই রাজি হয়ে গেল। তবে ড্রাইভারের কোন ডিমান্ড না থাকায় ভাড়ার বিষয়টি ফয়সালা হলো না। মোনা ভাবলো লোকটি ভদ্র নেমে পঁচিশ টাকাই দেবে। বিশ টাকা ভাড়া আর পাঁচ টাকা বকশিস।
এবার শুরু হলো মোনার গোপন মিশন।......... এসাইনমেন্ট..........।
ড্রাইভারের বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন হবে। গায়ের রং কালো। মাথায় সাদা একটি টুপি। মুখে ছাপ দাঁড়ি। একটি সবুজ পুরাতন ফতুয়ার সাথে ঢোলা প্যান্ট। পায়ে প্লাস্টিকের একটি স্যান্ডেল। গলায় নীল আর সবুজের মিশ্রণে একটি গামছা ঝোলানো।
-- আঙ্কেলের দেশের বাড়ি?
-- আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে মা?
মূল রাস্তা থেকে বামে মোড় নিতে নিতে প্রশ্ন করলেন মুরব্বি।
-- হ্যা, আপনাকে।
-- যশোর।
পিচকারি দিয়ে রাস্তার উপর পানের পিক ফেলতে ফেলতে উত্তর দিলেন তিনি।
-- ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন?
-- হ্যা, মা। বড় ছেলেটি একটি অফিসে পিয়নের কাজ করে। ছোট ছেলেটির পড়ালেখায় মন নেই, তবে ভাল ক্রিকেট খেলে। ঢাকায় একটি ক্লাবে প্রথম বিভাগে আছে। মেয়েটি এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। ক্লাস এইটের জেএসসি পরীক্ষায় এ+ পেয়েছে। ভাবছি কষ্ট হলেও মেয়েকে পড়াবো। অন্তত বিএ পাশ করাতে চাই।
-- আপনি কী সারাদিন রিক্সা চালান?
-- নারে মা, সারাদিন কী আর শরীরে কুলায়? বসয়ও অনেক হয়েছে। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত রিক্সা চালাই। বিকাল থেকে রাত দশ-এগারোটা পর্যন্ত রোকেয়া স্বরণীতে চটপটি বিক্রি করি। এভাবেই চলে আমার প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধ।
রিক্সা ততক্ষণে কলেজের সামনে চলে এসেছে। রিক্সা থেকে নেমে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে দিলে আঙ্কেল মোনাকে ত্রিশ টাকা ফেরৎ দিলেন।
-- আঙ্কেল পঁচিশ টাকা রেখে দেন।
-- নারে মা। ভাড়া বিশ টাকা, আমি বাড়তি নেব না।
-- পাঁচ টাকা আপনার বকশিস।
-- লাগবে না, মা। আমারও তো একটা মেয়ে আছে। এজন্য ছাত্রীদের কাছ থেকে সব সময় ভাড়া কম নেওয়ার চেষ্টা করি। পাঁচ টাকা দিয়ে বিরতির সময় তুমি ঝালমুড়ি খেয়ে নিও। এবার আসিরে মা, ভাল থাকিও।
ধীরে ধীরে রিক্সাটি চলতে লাগলো। পেছনে হুডি থাকায় ড্রাইভার আঙ্কেলকে দেখা যাচ্ছে না। মোনা একপলকে রিক্সার প্রস্তানটা চেয়ে চেয়ে দেখলো অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত। রিক্সার পেছেনে সুন্দর একটা মডেলের ছবি আঁকা। মোনা নিজের অস্তিত্বকে আঁকা মডেলটির স্থানে বসিয়ে দিল। বাবা বেঁচে থাকলে এখন কী লোকটির বয়সি হতেন? আঙ্কেলের মেয়েটি নিশ্চয় অনেক লাকি। গর্ব করার মতো এমন একজন বাবা আছে তার।
কলেজ থেকে ফেরার পথে রিক্সায় উঠা হয়নি মোনার। এলাকায় কী যেন একটা গন্ডগোল হয়েছে। মানুষ বলাবলি করছে দু'টি রাজনৈতিক দলের মুখোমুখী সংঘর্ষে একজন নিহত, আর চারজনের অবস্থা গুরুতর। কয়েক ডজন কর্মী পিজিতে ভর্তি। এজন্য কলেজ এলাকার রাস্তাঘাট, দোকানপাট সব বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক কষ্ট করে প্রায় দুই ঘন্টা হেঁটে বাসায় ফিরতে পেরেছে মোনা।
৩.
বিকালে থিয়েটার দেখতে গেছে মোনা। আজ বিসিএস কোচিং বন্ধ। বেইলি রোডে আসার পথে বড় ভাইয়া গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে এয়ারপোর্টে গেছেন। তবে ফিরতে হবে রিক্সায় করে। ভাইয়া ফিরবে সকালে, ব্যাংককে বিমানের ফ্লাইট নিয়ে গেছেন।
থিয়েটার থেকে বের হতে হতে রাত সাড়ে সাতটা বেঁজে গেল মোনার। একটু সামনে এগিয়ে আসতেই একজন রিক্সাওয়ালা বললো-
-- আফা কই যাবেন?
-- ফার্মগেট।
-- এদিকটায় যাব না আফা, অন্য রিক্সায় চলে যান।
পানের ডিব্বা থেকে একফালি পানসুপারী বের করে মুখে দিতে দিতে আয়েশি ভঙ্গিতে উত্তর দিল ড্রাইভার।
-- একটু বাড়িয়ে দেব, যাবেন?
-- আমি রামপুরা যাব আফা; এটা আমার শেষ খেপ তাই বাসায় চলে যাব।
রিক্সাওয়ালার সাথে কথোপোকথন শুনতে পেয়ে পাশ থেকে বিশ বাইশ বছরের আরেকজন রিক্সাওয়ালা বলে উঠলো-
-- আমি যাব আফা। তবে একটু বাড়িয়ে দিয়েন।
-- কত বাড়তি?
-- যা ভাড়া হবে তার সাথে দশ টেকা বাড়তি দিলেই হবে।
-- রিক্সায় তো কোন মিটার নেই, তাহলে কেমনে বুঝবো ভাড়া কত আসে?
-- আপনি তো নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন; ভাড়া তো জানাই আছে আপনার। সাথে দশ টাকা যোগ করে দিলেই হবে।
লোকটির কথায় যুক্তি আছে। মোনা মনে মনে হিসেব করে দেখলো ভাড়া চল্লিশ টাকা, সাথে দশ টাকা যোগ করে পঞ্চাশ দিলেই চলবে।
রিক্সা চলছে............প্যাডেল ঘুরছে..........
মোনার এসাইনমেন্টও শুরু হয়েছে............
-- কোথায় বাড়ি তোমার?
-- জামালপুর।
-- কত বছর হলো রিক্সায়?
-- তিন সপ্তাহ হবে।
-- তিন সপ্তাহ! মাত্র তিন সপ্তাহ!!
-- হো, ঠিকই কইছি আফা। আগে গ্রামে ধান ভানার মেশিন চালাতাম। একমাস আগে মেশিনের চরকিতে লেগে বাম হাতটি কনুইয়ের কাছে ভেঙ্গে গেছে। চিকিৎসা করাতে প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে। উপায় না দেখে ঢাকায় এক বন্ধুর সহায়তায় রিক্সায় উঠি। এখনো রাস্তাঘাট ঠিকমতো চিনি না। গত তিন সপ্তাহে সাড়ে ছয় হাজার টাকা জমাইছি। ছয় মাস চালাতে পারলে অপারেশনের টাকার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে আশা করি।
মোনা লক্ষ্য করলো লোকটির বাম হাতের কনুই থেকে বাকি অংশটি ঝুলে আছে। একটা ফুল হাতা সাদা সার্ট পরনে থাকায় এতক্ষণ খেয়াল হয়নি তার। লোকটি ডান হাত দিয়ে রিক্সা চালাচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা; তারপরও পায়ে জোর কম।
-- আফা মাইন্ড না করলে একটি কথা বলি?
-- বলো।
-- খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে। কিছু মনে না করলে রিক্সা একটু সাইড করে সামনের চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস পানি খাব।
অন্যদিন হলে মোনা বিরক্ত হয়ে জোরে একটা ধমক দিত; তবে আজ দিল না। ছেলেটাকে খুব আপন মনে হলো তার; বিশ্বাস করতে মন চাইলো।
-- ঠিক আছে। শুধু পানি কেন? চাইলে চা-বিস্কুটও খেতে পার।
-- না আফা। শুধু পানি হলেই চলবে। দুই মিনিট অপেক্ষা করুন, এই যাচ্ছি আর আসছি।
না দুই মিনিট লাগেনি তার আগেই পানি পানের বিরতি শেষ। বড়জোর দেড় মিনিট লাগলো।
-- পানির সাথে ট্যাবলেট জাতীয় কিছু একটা মুখে দিলে মনে হলো, কী এটা?
-- হো, ঠিকই দেখছেন আফা। দীর্ঘ সময় ভাঙ্গা হাতটি ঝুলিয়ে রাখলে ব্যথা করে। এজন্য ট্যাবলেট খেতে হয়।
-- এখন কী ব্যথা কমছে?
-- হো আফা কিছুটা কমেছে।
-- খুব জোরে চালানোর প্রয়োজন নেই, আস্তে আস্তে গেলেই চলবে।
-- আফা কিছু মনে না করলে রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েন, আমি এই এলাকায় আগে কখনো আসিনি।
-- এইতো আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। সামনের ওভার ব্রীজ পার হয়ে বামদিকে মোড় নেবে, তারপর ভেতরে ৬৫/৩ টুনটুনি কটেজ।
বাসার সামনে এসে মোনা পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে দেখলো পার্সে সর্বসাকুল্য দুইশত ত্রিশ টাকা আর খুচরা দুই টাকার ছয়টি কয়েন আছে।
-- এই নাও তোমার ভাড়া চল্লিশ টাকা, প্লাস দশ টাকা বকশিস। আর বাকি দুইশত বিয়াল্লিশ টাকা তোমার হাতের চিকিৎসা বাবদ আমার পক্ষ থেকে সামান্য সহযোগিতা মাত্র। প্লীজ, টাকাটা রাখো।
কথাটি বলেই এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে গেইট পার হয়ে বাড়ির লিফটের সুইচ টিপে অপেক্ষা করতে লাগলো মোনা। গন্তব্য নয় তলার ছত্রিশ নম্বর ফ্ল্যাট। ড্রাইভার বাকরুদ্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে মোনার লিফট আসার অপেক্ষা পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। মোনা একটি বারও পেছন পানে থাকালো না। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে টিস্যুর প্যাকেট খুঁজতে মনযোগী হলো।
(এটি সামুতে লেখা আমার প্রথম পোস্ট ছিল, গল্পটি যাতে সবাই আবার পড়তে পারেন এজন্য রিপোস্ট করলাম)
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
উৎসর্গ: আমার প্রথম পোস্টের প্রথম কমেন্টকারী সামু ব্লগের অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্লগার প্রিয় মনিরা সুলতানা আপুকে গল্পটি উৎসর্গ করলাম।
চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে পঠিত, লাইক ও কমেন্ট প্রাপ্ত পোস্ট।
গল্প লেখার সহজ পাঠ।
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ২:১৮