ঘটনাটি কয়েক বছর আগের। তখন কলেজে পড়ি। একদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বাম কানে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম। পর্দা ফেটে গিয়েছিল। তখন ভাল ডাক্তার অর্থাৎ প্রাইভেট ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য ছিল না, তাই বাধ্য হয়ে সিলেট সরকারী ওসমানী মেডিকেলে চার টাকার বিনিময়ে টোকেন নিয়ে ভেতরে গেলাম। দেখলাম আমার মত হতভাগ্য অনেক লোক লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ডাক্তার মশাই এত ব্যস্ত যে, রোগী দেখার সময় পাচ্ছেন না। এদিকে আমার কানে প্রচন্ড ব্যথা করছে। কষ্ট করে একটু উকি ঝুঁকি দিতেই দেখি ভেতরে ডাক্তার মহাদেব ঔষধ কোম্পানীর দু'জন রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়ে মহা ব্যস্ত। ঘন্টা দেড়েক পর উনার দয়া হল। একে একে রোগীরা ভেতরে যাওয়া শুরু করলেন।
আমার যখন ডাক আসলো ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুঁকলাম। না জানি ডাক্তার কী বলে? আমার সমস্যা বিস্তারিত শুনে পরীক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, " তুমি কী পড়াশুনা করো? উত্তরে হ্যাঁ বলতেই একটা ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে বল্লেন, পড়ালেখা করে কী করবা, তুমি তো চাকরি পাবা না; এমনকি কেউ তোমাকে বউও দেবে না! তোমার কানের পর্দা আর ভাল হবে না। শুনে ভয়ে ও অপমানে চোখে পানি এসে গেল।
একজন ডাক্তার রুগীকে এভাবে তিরস্কার করতে পারে? অপমান করতে পারে? আমার অপরাধটা কী ছিল, তা আজও জানি না। হয়ত বিকেল বেলা উনার প্রাইভেট চেম্বারে গেলে অনেক ভাল কথা বলতেন, অভয় দিতেন। কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পাঠাতেন। সময় মতো অপারেশনও করতেন!!
ভয়ে অপমানে পরে আর কোন ডাক্তারের কাছে যাইনি। বাম কান দিয়ে কিছুই শুনতাম না। যখন এই ডাক্তারের চেহারা চোখের সামনে ভাসতো খুব ভয় লাগত, এখনো ভয় পাই। কয়েক বছর পর লন্ডনে যখন যাই তখন জিপিতে ভর্তি হই। জিপি (GP) হলো ইংল্যান্ডের স্থানীয় ডাক্তাখানা। প্রতিটি এলাকায় মাুনষের আনুপাতিক হারে একটি করে 'জিপি' আছে। বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে জিপিতে ভর্তি হতে হয়। এটা সম্পূর্ণ ফ্রী। সরকার দ্বারা পরিচালিত এনএইচএস (National Health Service) ইউকে-তে সকল স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকে। অসুখ-বিসুখ হলে প্রথমে এখানে আসতে হয়। জিপিতে সব রোগীর আলাদা আলাদা ফাইল থাকে। প্রয়োজন মনে করলে ডাক্তাররা বড় হাসপাতালে রোগীকে পাঠিয়ে দেন।
একদিন মনে মনে ভাবলাম, এখানে তো ডাক্তার দেখাতে পয়সা লাগে না। ডাক্তাররাও খুব ভদ্র ও ফ্রেন্ডলি। অনেক ভাবনার পর একদিন এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে জিপিতে গেলাম। ডাক্তার কান পরীক্ষা করে টেনশনে পড়ে গেলেন; সাথে সাথে একজন ইএনটি সার্জনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বল্লেন। উভয় ডাক্তার মিলে সিদ্বান্ত নিলেন আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট করতে হাসপাতালে যেতে হবে। জিপি আমাকে বল্লেন, হাসপাতাল থেকে আমার ঠিকানায় চিঠি আসবে সার্জনের সাথে এপোয়েন্টমেন্টের জন্য। চিটিতে সময় ও তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে। আরো বল্লেন, এর মধ্য কানে কোন অসুবিধা দেখা দিলে অবশ্যই যেন উনাকে অবগত করি। জিপিতে যাই।
চিটি পাওয়ার পর উল্লেখিত তারিখ ও সময়ে হাসপাতালে হাজির হই। রিসিপসনিস্ট আমার চিটি এন্ট্রি করে সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সার্জন আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনলেন এবং কিছু রিপোর্টের জন্য অন্য একটি কক্ষে চেকাপের জন্য পাঠালেন। কক্ষটি খুব পরিপাটি ও বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামে পূর্ণ। একজন ভদ্র মহিলা প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। তিনি এত যত্ন সহকারে কাজটি করলেন মনে হল আমার চিকিৎসা করাটাই উনার আজকের একমাত্র কাজ। আজো শ্রদ্ধা ভরে স্বরণ করি এই ভদ্র মহিলাকে। যত দিন বাঁচবো এই কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে। পরে জেনেছি তিনিও ডাক্তার।
রিপোর্ট পেয়ে সার্জন ভয় পেয়ে গেলেন। বল্লেন, বাম কানে কোন পর্দা অবশিষ্ট নেই। এতদিন কেন ডাক্তার দেখালাম না? আমি লজ্জায় দেশের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারিনি। তিনি বল্লেন, আপনার জন্য দু'টি পথ খোলা আছে। প্রথমটি অপারেশন, আর অন্যটি কানে মেশিন লাগানো। তবে অপারেশন করলে সফলতার হার ২০% এর বেশি নয়। অনেক ভেবে চিন্তে অপারেশনের সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। সার্জন কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে বল্লেন অপারেশনের তারিখ চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।
অপারেশনের দিন একা একা হাসপাতালে গেলাম। কিছুক্ষণ পর যিনি অপারেশন করবেন সেই সার্জন আমার ফাইল নিয়ে এসে আবার কানের কিছু পরীক্ষা করলেন এবং বল্লেন, আজ আমি আপনার কানের অপারেশন করবো। কোন চিন্তা করবেন না। এটা খুব সহজ একটা অপারেশন। অল্প সময়ে আমার কান ভাল হয়ে যাবে এই অভয়ও দিলেন।
যথা সময়ে অপারেশন শেষ হল। আসলে এটা ছিল খুব বড় ও ব্যয়বহুল অপারেশন। যা পরে জানতে পেরেছি। আমার টাকা পয়সা লাগবে না বলে টেনশনটা কম ছিল। এক ঘন্টা আমাকে রেস্টরুমে রেখে নার্স প্রয়োজনীয় ঔষধ ও ডাক্তারের নির্দেশনা বুঝিয়ে দিলেন। আমি একা যেতে পারব কি না তাও জানতে চাইলেন। সার্জনের সাথে আবার কোনদিন দেখা করতে হবে তা জানিয়ে দিলেন। তবে কোন প্রেসক্রিপশন দিলেন না, বাড়তি কোন ঔষধও না।
ঠিক দুই সপ্তাহ পরে তারিখ মতো গেলাম আগের সেই সার্জনের কাছে। যে ভদ্র মহিলা (ডাক্তার) আগে চেকআপ করেছিলেন তিনি আবারো একই চেকআপ করে সার্জনের নিকট রপোর্ট জমা দিলেন। সার্জন রিপোর্ট পেয়ে মহা খুশি। বল্লেন, অপারেশন শতভাগ সফল। আমার বাম কানের অবস্থা ডান কানের সমান। খুশিতে ও শ্রদ্ধায় চোখে পানি চলে এল। মনে হলে সার্জনকে জড়িয়ে ধরি, কৃতজ্ঞতা জানাই। যথা সম্ভব আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে উনাকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিলেন। আসার সময় বল্লেন, বেস্ট অব লাক।
যে দেশে জন্ম নিলাম, দেশের হাওয়া বাতাসে বড় হলাম, প্রতিনিয়ত যে দেশের দিন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি, যে দেশটাকে মায়ের মত ভালবাসি সে দেশের ডাক্তার আমার সাথে এমন আচরণ করলেন কেন? তিনি তো সরকারী মেডিকেলে পড়াশুনা করে গরীব মানুষের টাকায় ডাক্তার হয়েছেন। সরকার থেকে বড় অংকের বেতন পান, সরকারী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নেন, অবসর নিলে মোটা অংকের পেনশনও পাবেন। পাশাপাশি প্রাইভেট প্রেকটিসও করেন। হাপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এদের অনেকের মালিকানা আছে। নিজেরা বাড়ি-গাড়ি ও অঢেল টাকা-পয়সার মালিক। তারপরও কোথায় যেন একটা ঘাটতি আছে এদের আচরণে, মানসিকতায়।
Newham University Hospital, London. (এখানেই আমার কানের অপারেশন হয়)।
শুনা যায়, এদের অধিকাংশই বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানী ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বড় অংকের কমিশন খায়। তারপরও দায়িত্বের প্রতি এত অবহলা কেন? যাদের ট্যাক্সের পয়সায় ডাক্তার হলো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ নেই কেন? টাকার প্রতি এত লোভ কেন? নেশা কেন? বুঝতে পারি না। হয়তো লোভ আর অবৈধ অর্থ বিত্ত মনুষ্যত্ব নষ্ট করে দেয়। মানুষকে বিবেকহীন ও বেপরোয়া করে তোলে।
অপরদিকে আমি ভিনদেশী হওয়ার পরও কত মমতা দিয়ে ইংল্যান্ডের ডাক্তাররা আমার চিকিৎসা করলেন। এতে সরকারের অনেক টাকা খরছ হলো আমার চিকিৎসায়। ইংল্যান্ডের ডাক্তারদের আয় তো আমাদের বড় বড় ডাক্তারদের চেয়ে অনেক কম। তারা প্রাইভেট প্রেকটিস করেন না। কোন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খোলার অনুমতি ও তাদের নেই। তারপরও নির্দিষ্ট বেতনের উপর তাদের আস্থা আছে, দায়বদ্ধতা আছে, ডাক্তার হিসাবে নীতির মাপকাঠি আছে।
তারা নিজেদের জনগণের সেবক ভাবেন, প্রভু নয়। এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের দেখলে সম্মান করতে মন চায়। আমাদের দেশটা এমন কেন? মানুষের মধ্যে এতো লোভ কেন? অতি লোভী মন আর মানুষকে মানুষ হিসাবে সম্মান না দেওয়াটাই কী এজন্য দায়ী? না আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক কাঠামো? জানি না।
ইউকে-তে যদি প্রমাণ হয় ডাক্তারের খামখেয়ালি ও ভুল চিকিৎসায় রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কিংবা মারা গেছেন তাহলে ডাক্তারকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন তিনি। ডাক্তারী লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হয়। আর অন্যান্য চাকরির মতো একটা নির্দিষ্ট বয়স হলে অবসর নিতে হয়। যতই অভিজ্ঞতা থাক কোন কাজে আসবে না। কোন প্রাইভেট প্রেকটিসেরও সুযোগ নেই।
আসলে পার্থক্যটা হলো মানসিকতার। আমাদের দেশের বাবা-মা সন্তানদের ডাক্তার বানায় টাকা কামানোর নেশায়। সন্তানটিও পড়ালেখা শেষ করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর বাবা মায়ের চাওয়ার প্রতিদান দিতে সত্যিকারের ডাক্তার হতে পারে না, হয় একজন লাইসেন্সধারী কসাই। কসাইদের তো ইথিক্স থাকতে নেই। কারণ, তাদের পশুর প্রতি প্রেম থাকলে আমরা মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হতাম। আর ইংল্যান্ডে এরা ডাক্তারী পড়ে মানব সেবার অভিপ্রায়ে; পাশাপাশি শেখে ডাক্তারদের দায়বদ্ধতা আর পেশার প্রতি একাগ্রতা। এজন্য পাশ করে তারা ডাক্তার হয়, কসাই নয়।
এত কিছুর পরও আশায় বুক বাঁধি একদিন আমরা সবাই দেশের প্রতি এবং নিজের দায়িত্বের প্রতি যত্নবান হবো। মানুষকে তার সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য নয়, তার মানবিক গুণের জন্য সম্মান দেব। লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে কাজ করবো। হয়তো সে দিনটি আমি দেখে যেতে পারবো না, তারপরও আশাবাদী হই। আর আশা না করে যে উপায়ও নেই। কারণ দেশটাতো আমাদের, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর দেশপ্রেম দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আরো উন্নত, সহনশীল, দারিদ্র্যমুক্ত একটা সুখি ও সমৃদ্ধ দেশের পথে।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৮ দুপুর ২:০৩