রাজধানী ঢাকার কাকরাইল এলাকায় রমনা পার্কের পাশে অবস্থিত বিশাল মসজিদটিই কাকরাইল মসজিদ।
এটি বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের মারকায বা প্রধান কেন্দ্র। ১৯৫২ সালে এই মসজিদটি তাবলীগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত হয়। মসজিদটির পুরাতন নাম ছিল ‘মালওয়ালি মসজিদ’।
কাকরাইল মসজিদ সর্বপ্রথম কবে এবং কার দ্বারা নির্মিত হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে।
তবে কাকরাইল মসজিদের জৈষ্ঠ ব্যক্তিবর্গদের থেকে জানা যায়,
অনেকে মনে করে প্রায় ৩০০ বছর আগে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নবাব পরিবারের যে কোন একজন সম্মানিত ব্যক্তি মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি নবাবদের অন্যান্য স্থাপনার সাদৃশ্যেই নির্মিত ছিল। শুরুতে মসজিদটি স্বল্প পরিসরে ছিল। সামনে ছোট্ট একটি পুকুর ছিল।
মসজিদের সামনের দৃশ্য।
আবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহম্মদ এলতাসউদ্দিন জানান,
তিনি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ওসমান গনির থেকে শুনেছেন প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমদ ও সমমনা কতিপয় ব্যক্তি ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর মসজিদ নির্মাণের জন্য সরকারের অনুমতি ও জায়গা চেয়ে আবেদন পাঠালেও দীর্ঘদিনেও তৎকালীন সরকার থেকে কোনো অনুমতি পায়নি তারা। পরে সরকারের অনুমতি ছাড়া এক রাতেই শতাধিক লোক মিলে চারদিকে ইটের গাঁথুনি, বাঁশ ও টিন দিয়ে সেখানে মসজিদ তৈরি করে ফজরের নামাজও আদায় করেন তারা।
মসজিদের সামনের দৃশ্য। (আংশিক)
বিষয়টি সরকারের নজরে এলে ডা. টি. আহমদ ও তাঁর সহযোগীদের কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। পরে তিনি উকিলের মাধ্যমে জবাব দিলেন,
“All land belongs to Almighty Allah, and as such, the construction of House of Allah, in the land of Allah, does not require the permission of anybody”.
সহজ ভাষায়, “পৃথিবীর সব জমি আল্লাহর, আর এখানে আল্লাহর ঘরই তৈরি করা হচ্ছে। আল্লাহর ঘর তৈরির জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই”।
একথা শোনার পরে এ বিষয়টি নিয়ে আর কেউ কোন উচ্চ বাচ্চ্য করেনি। এভাবেই কাকরাইল মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।
মসজিদের সামনে দূর দূরান্ত থেকে আসা তাবলীগের লোকজন। প্রায় সর্বক্ষণই এখানের চিত্র এমন থাকে।
মসজিদের স্থাপত্যিক বিষয়ঃ
ষাটের দশকে কাকরাইল মসজিদের মুরুব্বিগণের সমন্বয়ে ইঞ্জিনিয়ার মরহুম হাজি আব্দুল মুকিত সাহেবের তত্ত্বাবধানে তিন তলা মসজিদটি পুনঃনির্মানের কাজ শুরু হয়। মসজিদটি অন্যান্য মসজিদ থেকে একটু নান্দনিক ও আকর্ষণীয় নকশায় তৈরি। এ মসজিদের ডিজাইন দেখলে মনে হবে ইঞ্জিনিয়ার মরহুম হাজি আব্দুল মুকিত সাহেব মনপ্রাণ ঢেলে মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। মসজিদের ছাদ সংলগ্ন ত্রিভুজ আকৃতির নকশা রয়েছে। পিলারগুলো চৌকোণা আকৃতির। মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়ালটি ঢেউ খেলানো। এছাড়াও মসজিদটির তিন দিকে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে।
দক্ষিণ ও উত্তর পাশে রয়েছে ওজুখানার জন্য ছোট্ট দুইটি পুকুরসাদৃশ্য হাউজ। এ পুকুরের চতুষ্পার্শে শতাধিক লোক একত্রে ওজু করতে পারেন। মসজিদের বাইরেও রয়েছে ওজুখানা। মসজিদ থেকে একটু দূরে উত্তর পাশে প্রশ্রাব ও বাথরুমের জন্য রয়েছে দোতলা একটি ভবন। মুলত মসজিদের মূল অংশটি তিনতলা। ডানপাশের অংশটি ছয়তলা। ছয়তলা ভবনটি হিফজখানা, ছাত্রাবাস ও তাবলিগের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা হয়।
মসজিদের ভিতরে নামজ আদায়রত মুসল্লি।
অন্যান্য মসজিদগুলা থেকে এই মসজিদটি ব্যাতিক্রম হওয়ার কারনঃ
এই মসজিদের বাহ্যিক কাঠামো চমৎকার হলেও এর ভেতরে তেমন কোনো জৌলুস নেই।
তাবলিগ জামাতের (প্রধান কেন্দ্র) হিসেবে বিশ্বজোড়া পরিচয় থাকলেও মসজিদটি একেবারেই সাদামাটা। নেই সুউচ্চ মিনার। মিনারের চূড়ায় আর সব মসজিদের মতো চারমুখী মাইক নেই। সারি সারি এয়ারকুলার বা দামী ফ্যান নেই। নরম গালিচা, ঝাড়বাতি, অজুখানা কোনো কিছুতেই বিলাসিতা নেই।
সব মসজিদে বেতনধারী ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেম থাকলেও এই মসজিদে নেই। তাবলিগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই পালাক্রমে এ দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি তাবলিগে অংশগ্রহণকারীদের জন্য মসজিদ আঙিনায় প্রতিদিন যিনি খাবার রান্না করেন তাঁরও কোনো বেতন নেই। এই মসজিদের সবথেকে বড় ব্যাতিক্রমটা হল, এটির কোন দরজা নেই। রাত দিন খোলা সবার জন্য। এমন আরও নানা কারণে এই মসজিদটি অন্য মসজিদ গুলা থেকে ব্যাতিক্রম।
মসজিদের জৌলুসহীন অজুখানা।
১৯৪৬ সালে মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেব কলকাতা থেকে বাংলাদেশে তাবলিগের কাজ নিয়ে আসেন। তারপর প্রথমে পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার উত্তর-পশ্চিম কোণের 'খান মুহাম্মদ মসজিদে দাওয়াতের কাজ চললেও ১৯৫২ সালের পর থেকে এখনো অবদি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা বিরতিহীন ভাবে দ্বীনের দাওয়াত চলছে এখানে। কখনো নামাজ, কখনো বয়ান, কখনো জিকির, তেলওয়াত, খেদমত, ও বিভিন্ন মহল্লার মানুষদের বিরামহীন ভাবে দ্বীনের দাওয়াত দেয়াসহ ধর্মীয় প্রায় সব কাজই চলছে এই মসজিদে, এখনো পর্যন্ত।
তথ্যসুত্রঃ উইকি, ইত্তেফাক, কালেরকণ্ঠ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১৮