গুলমার্গ থেকে চলেছি পেহেলগাম এর দিকে, যত দূরে চলেছি, বরফের রাজ্য আর পাহাড়ি রাস্তা ততই দূরে সরে যাচ্ছে। সামনে বিশাল উপত্যকা। এক সময় চলে এলাম আমরা এ সমতল ভূমিতে। রাস্তার দু'পাশে টহলরত সেনাদের কাছে মাঝেমধ্যেই থেমে নিজের পরিচয় দিতে হচ্ছে।
বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সরিষা ফুলের মাঠ। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশের কোন এক গ্রাম। বাংলাদেশের রবিশস্য সরিষা, এখানে চাষ হচ্ছে বসন্তকালে। তারমানে বাংলাদেশের শীত আর এখানকার বসন্তের তাপমাত্রা প্রায় একরকম।
কতশত জনপদ পেরিয়ে এলাম কোন বড় রকমের কল কারখানা চোখে পড়েনি। মাঝেমধ্যে চোখে পড়লো বাড়ি অথবা দোকানের ছাদে সমান টুকরো করে কাটা অনেক কাঠ সাজানো রয়েছে। ড্রাইভার জানালো এগুলো দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট বানানো হয়। কাশ্মীরের ক্রিকেট ব্যাট বিশ্ব বিখ্যাত। অনেক ব্র্যান্ডেড কোম্পানি এখান থেকে ব্যাট বানিয়ে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে অনেক অনেক ফুলভর্তি গাছ দেখে আমি হতবাক! এত্ত ফুল, কি গাছ এটা! আমাকে অবাক দশা থেকে মুক্তি দিয়ে ড্রাইভার জানালো, ওগুলো আপেল গাছ। থেমে ছবি তুলতে চাইতেই বললো,' আমরা চতুর্দিকে আপেল বাগানের মধ্যে দিয়েই যাবো। তখন থামবো।'
কাশ্মীরের অর্থকারী ফসলের মধ্যে আপেল ও জাফরান অন্যতম। অনন্তনাগ জেলায় সবচেয়ে বেশি আপেলের বাগান। পেহেলগাম অনন্তনাগ জেলায় অবস্থিত। প্রচুর পরিমানে জাফরানও চাষ হয় এই অঞ্চলে। আমরা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জাফরান মাঠ দেখলাম, কিন্তু তখনও জাফরান গাছ লাগানো শুরু হয়নি। হাইওয়ে সংলগ্ন ড্রাইফুড এর দোকানে জাফরান, কাজুবাদাম, আখরোট, কিসমিস ও নানান ধরনের মসলা কিনতে পাওয়া যায়।
একসময় চলে এলাম আমরা আপেলের রাজ্যে। চারিদিকে শুধু ফুলে ফুলে ভরা আপেল বাগান। প্রায় প্রতিটি বাগানে একটা করে রেস্টুরেন্ট আছে। ড্রাইভার গাড়ী ঢুকিয়ে দিলো তার পরিচিত এক রেস্তোরায়। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম প্রথম দেখা ফুলগুলোকে। ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। হিমাগারে রাখা বাগানের চমৎকার আপেল খেলাম। ওখান থেকে বেরোতেই মন চাইছিলো না। দুপুরের খাবার ওখানে খেয়ে আবার এগিয়ে চললাম এই ফুলের রাজ্যের মাঝ দিয়েই। আমাদের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী লীডার নদী। আবার ধীরে ধীরে শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা, মাঝে মাঝেই ছোট ছোট ঝর্ণা রাস্তা ক্রস করে মিশেছে লীডার নদীতে। এরকম ছোট ছোট ঝর্ণাই লোকালয়ের পানির প্রধান উৎস। ঝর্ণা, নদী থেকেই মানুষ পানি বয়ে নিয়ে চলেছে নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য। খাবার পানিও এই ঝর্ণারই।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে পাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া ঝর্ণা আর চিরসবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেল এ। হোটেলের সামনে দিয়েও বয়ে চলেছে এই লীডার নদী। এ নদী থেকেই পাইপের মাধ্যমে পানি যাচ্ছে আশেপাশের সব হোটেল আর বাড়ীগুলোতেও। এখানেই চতুর্দিক থেকে ছোট ছোট নদী এসে মিশেছে এক পথে, পরিনত হয়েছে বিশাল খরস্রোতা নদীতে। নদীর ওপাড়ে পাহাড়, পেছনের বড় পাহাড়গুলো বরফে ঢাকা।
আজ আর বাইরে কোথাও যাবো না। একটু রেস্ট নিয়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে গেলাম বেশ খানিকটা পথ। দেখা হলো নিজ দেশী, ভীনদেশী অনেক পর্যটকের সাথে। এই পাহাড় ঘেরা চমৎকার স্পটে আমরা আরো একটা দিন কাটাবো। ------
------------------------ আপেল গাছ ফুলে ফুলে ভরে আছে।