২০১৯ এর এপ্রিল মাসে ঠিক করলাম ইন্ডিয়া যাবো। এবার যাবোটা কোথায়! আমাদের দু'জনেরই সিদ্ধান্ত কাশ্মীর দেখতে যাবো, বিশেষ করে আমার। কারণ এপ্রিল মাসে শ্রীনগরের টিউলিপ বাগান দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। বাসার কাউকে বলিনি কাশ্মীর যাবার কথা, কারণ কেউ যেতে দিবে না। বলেছি," দিল্লি, আগ্রা ঘুরতে যাবো।" তার ওপরে ইন্ডিয়ায় তখন ইলেকশন চলছিলো। ইন্ডিয়ান এক বাঙালী বন্ধু বললেন,"এ সময়ে আসাটা আপনাদের ঠিক হচ্ছে না।" ধুর, কে শোনে কার কথা! আল্লাহ যা কপালে রেখেছেন, তা' হবেই।
কাশ্মীর পর্যটকদের স্বপ্নের নিকেতন। পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণি উপত্যকাকে সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কাশ্মীর হিমালয়ান পর্বতমালার সবচেয়ে বড় উপত্যকা, কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। চারপাশে তুষারধবল শৃঙ্গরাজি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এক অনন্য রূপ তৈরি করেছে। মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর কাশ্মীরকে প্রথম তুলনা করেছিলেন স্বর্গের সঙ্গে। মোঘল সম্রাটরা দিল্লীর গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে নিস্তার পেতে অবকাশ যাপনের জন্য ছুটে আসতেন কাশ্মীরে। চশমেশাহী, পরিমহল, শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, ইত্যাদি তারই স্বাক্ষ্য বহন করছে। বর্তমানে সমস্ত পৃথিবী থেকেই ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা ভূস্বর্গ কাশ্মীর দেখার জন্য প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন এখানে।
ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো। প্লেনের টিকেট পেতে কিছুটা ঝামেলা হলো। ঢাকা-কলকাতা, কলকাতা-দিল্লি, দিল্লিতে রাত কাটিয়ে ভোরে শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা। দশ দিনের ট্যুর প্ল্যান আমাদের হাতে দেয়া হয়েছে।
এক সকালে পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর এয়ারপোর্টে। প্লেন থেকেই দেখলাম কাস্মীরের অনেকাংশই বরফে ঢাকা। এয়ারপোর্টে কোন ঝামেলা না হলেও অনেকটা সময় চলে গেলো ফর্মালিটি সারতে। ইন্ডিয়ান ভিসা থাকলেও কাশ্মীরে অবস্থান করবার অনুমতি নিতে হলো সব পর্যটকেরই।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে পেলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত ড্রাইভার বিলালকে, যে আমাদের সাথে থাকবে কাশ্মীরে অবস্থানকালীন দিনগুলোতে। প্রথমেই সে আমাদের স্বাদরে বরণ করে নিলো। আমাদের হাতে দিলো কাশ্মীরের একটা মোবাইল সিমকার্ড। সেদিনের ট্যুরপ্ল্যান হলো প্রথমেই যাবো টিউলিপ গার্ডেন, সেখান থেকে ফিরে দুপুরের খাবার ডাল লেকের বোট হাউজে, একটু রেস্ট নিয়ে ডাল লেকে ঘোরাঘুরি করে রাতে বোট হাউজে থাকবো। পরদিন সকালে যাত্রা করবো গুলমার্গের উদ্দেশে।
যাত্রার শুরুতেই মনটা জুড়িয়ে গেলো। এয়ারপোর্টের চতুর্দিকেই ফুলে ফুলে সাজানো। শ্রীনগরের তাপমাত্রা তখন খুব চমৎকার, না শীত, না গরম। অল্পক্ষণেই পৌছে গেলাম ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল টিউলিপ গার্ডেন এ। রাজধানী শ্রীনগরের জাবারওয়ান অঞ্চলের ফুটহিলসে অবস্থিত এ বাগান। এর পাশেই রয়েছে বিখ্যাত ডাল লেক। বাগানটি সিরাজবাগ নামে অধিক পরিচিত। এটিই এশিয়ার সর্বোবৃহৎ টিউলিপ বাগান।
বাগানের বেরোনোর গেইট প্রথমে পেলাম, ওখান থেকে অনেকটা হেঁটে ঢোকার গেইট পেলাম। আমার হাঁটতে বেশ কষ্টই হলো। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকতেই বিস্ময়ে অভিভূত আমি! পথের সব ক্লান্তি আমার কোথায় উবে গেলো! মনে হলো স্বপ্নের দেশে চলে এলাম! যা এতদিন ছবিতে, মুভিতে দেখেছি সেই রূপকথার রাজ্য এখন আমার সামনে! আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি যেন কী এক স্বপ্নের ঘোরে! চারিদিকে লাখো বিচিত্র রঙের ফুল! কোনটা রেখে কোনটা দেখি!
১৫ হেক্টর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে প্রায় ৫০ প্রজাতির ৩৫/ ৪০ লাখ টিউলিপ এখন ফুলে ফুলে স্বর্গের সৌন্দর্য ছড়িয়ে চলেছে। এপ্রিলের শুরু থেকেই শ্রীনগর ফুলের অরণ্যে পরিণত হয়। এই একটা মাসই খোলা থাকে টিউলিপ বাগান। এপ্রিল মাসই কাশ্মীরের উপত্যকায় টিউলিপ ফোটার উপযুক্ত সময়। এ সময় বিশাল বাগানের প্রায় সমস্ত সবুজ, নানা রঙের টিউলিপের চাদরে ঢাকা পড়ে যায়।
এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্যই কাস্মীরকে ভূ-স্বর্গই বলা হয়। বৃষ্টিতে টিউলিপ ফুলের অনেক ক্ষতি হয়। আমি থাকাকালীন বেশ ঝুম বৃষ্টি হলো কয়েকদিন। ভেবেছিলাম হয়তো আর টিউলিপের দেখা পাবো না। কিন্তু আমি তো আমিই! শেষদিন কাশ্মীর ছেড়ে আসার শেষ মুহুর্তেও আবার টিউলিপ বাগানে ঘুরেছি। টিউলিপ ফুলের কুঁড়ি এবং ফুল, এই দুটোই বেশ আকর্ষণীয়।
২০০৮ সালে তখনকার রাজ্য প্রধান গোলাম নবী আজাদ বাগানটি কাশ্মীর উপত্যকায় পর্যটকদের জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন। নয়নাভিরাম, ভুবন মাতানো আর মন ভোলানো সৌন্দর্য্যের জন্য কাশ্মীর পূর্বের সুইজারল্যান্ড হিসেবেও খ্যাত। শীতের শেষ, শ্রীনগরের বরফ গলে গেছে, মাটি ফুঁড়ে আরো অনেক রকমের ফুল উঁকি দিচ্ছে। সত্যিই কাশ্মীরের সৌন্দর্য্য শুধু দু'চোখ ভরে দেখার মতো, প্রাণভরে উপভোগ করার মতো, বর্ণনা করে বোঝানোর মত নয়।
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★