ঈদের ছুটিটা শুধু দাওয়াত খেয়ে নষ্ট না করে, ঢাকার কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যাব ভাবছিলাম। এ সময়টা সব হাইওয়ে মোটামুটি ফাঁকা, যেতে আসতে সময়ও কম ব্যয় হবে। তিনটি পরিবারের সম্মিলিত আইডিয়া প্রয়োগে, ঠিক হলো মাতৃভান্ডারের শহর কুমিল্লা যাব। সকালে বেরিয়ে যাব, রাতে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (BARD) থাকব পরদিন বিকেলে আবার ঢাকার পথে রওয়ানা হব। এই সময়টুকুতে শুধুই কুমিল্লাকে ঘুরে দেখা।
২৭ তারিখ সকাল ৯.০০ টায় আমাদের গাড়ি ছাড়ল, আমরা আটজন চললাম কুমিল্লার পথে। ঢাকা থেকে গাড়িতে গ্যাস নিয়ে, চা-টা খেয়ে কাঁচপুর ব্রীজ পেরিয়ে গেলাম দশটায়। এরপরে শীতলক্ষ্যা, মেঘনা-গোমতি পেরিয়ে বারোটাতে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করলাম যেই, গাড়ীর চাকা পাংচার হলো সেই! পথে অনেক অনেক কাশবন পেরিয়ে এলাম, দু’চোখ ভরে শুধু দেখলাম আর দেখলাম। ফেরার পথে নামব, ছবি তুলব এই ভরসায় আর গাড়ি থামানো হয়নি। চাকা পাংচার হবার আর যেন জায়গা পেল না! কাশবনের সামনে হলে কী এমন ক্ষতি হতো!! দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। ভাগ্যিস মাথায় হিজাব পরা ছিল, তাই অবোধ চুল বেচারাগুলো এবারে বেঁচে গেল।
দশ থেকে পনের মিনিট পরেই আমাদের আবার যাত্রা হলো শুরু। যে দিকে তাকাই শুধু মাতৃভান্ডার আর মাতৃভান্ডার (মিষ্টির দোকান)। এক মাতৃভান্ডার নামেই হাজারো দোকান! প্রথম বিরতি কুমিল্লার বিখ্যাত নূরজাহান হোটেল। দুপুরের খাবারের জন্য বসে গেলাম বড় একটা টেবিলে। খাবার মেন্যু চারজনের বোয়াল মাছ, তিনজনের গলদা চিংড়ি, একজনের গরুর মাংস কালাভূনা আর সাথে বেগুন দিয়ে শুটকি মাছ চচ্চরি, আলু ভর্তা, সবজি, ডাল। ঈদের এ দু’দিন গরুর মাংস খাবার পরে, এই খাবার যেন অমৃত সম!
নূরজাহান হোটেল- এ দুপুরে খেলাম
খাবার টেবিলে আমাদের বেড়ানোর রূটীন ঠিক করে নিলাম। রওয়ানা হলাম বার্ডের (BARD) পথে। ওখানে পৌছে যে যার রুমের চাবি নিয়ে চলে গেলাম রুমে। ডাবল বেডের রুম পেলাম মাত্র একটা, আর পাঁচটা সিঙ্গেল বেডের রুম। একটু ফ্রেশ হয়ে, জোহরের নামাজ পড়ে, বেরিয়ে পড়লাম ময়নামতি শালবনবিহার দেখতে।
ওখানে যে ইতিহাস পেলামঃ পূর্বে এই প্রত্নস্থানটি শালবন রাজার বাড়ী নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু খননের পর ১১৫টি ভিক্ষুকক্ষ বিশিষ্ট ৫৫০X ৫৫০ বর্গফুট পরিমাপের একটি বৌদ্ধ বিহারের ভূমি নকশা উন্মোচিত হয়েছে।তাই ইহাকে শালবন বিহার নামে অভিহিত করা হয়। বিহারটির মধ্যভাগে একটি মন্দির ও উত্তর বাহুর মাঝামাঝি স্থানে প্রবেশ তোরণ ইহার বিশেষ আকর্ষণ। বিহারটিতে ৪টি ও কেন্দ্রীয় মন্দিরে ৬টি নির্মাণ যুগের প্রমান পাওয়া গেছে। খননে প্রাপ্ত একটি পোড়ামাটির মুদ্রক থেকে জানা যায়, এই বিহারটি দেব বংশের ৪র্থ রাজা শ্রী ভবদেব খৃষ্টীয় আট শতকে নির্মাণ করেছেন। সুতরাং ইহার আসল নাম ছিল “ভবদেব মহাবিহার”। এই বিহারে খননে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ প্রত্নবস্তু ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
শালবন বিহারে তোলা কিছু ছবিঃ-
শালবন বিহার থেকে ফিরে রুমে ফিরলাম। সবাইকে সময় দেয়া হলো সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। এরপর আমরা যাব নীলাচল টিলায়। বার্ডের ভিতরে অনেক অনেক প্রজাতির বড় ছোট সব গাছ। অতীতে এটি পাখিদের অভয়ারণ্য ছিল। এখন অত পাখি আর দেখা যায় না। মাঝে মাঝে ছোট ছোট টিলা আছে, এরই একটির নাম নীলাচল। নীলাচলে আমরা দেখব সবুজ বনে গোধুলির আলো, আর তারপরেই আকাশে আগমন ঘটবে ‘সুপার মুন’-এর।
চমৎকার একটি সিড়ি বেয়ে আমরা চলে এলাম নীলাচল টিলায়। সবাই মিলে বসে আড্ডা চলছিল আর সাথে ছিল প্যাকেটজাত ঝালমুড়ি। আজকাল ঝালমুড়িও প্যাকেটজাত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই স্বাদ আর কই! কয়েক বছর আগেও ঢাকা আসতে, যমুনা নদিতে স্টীমার বা লঞ্চ, যে বাহনেই পার হই না কেন, উঠেই এক ঠোঙা ঝালমুড়ি আবার নেমে যাবার আগে আরেক ঠোঙা ঝালমুড়ি। আজ সবই অতীত! যাক যা বলছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই গোধূলির আলোয় চারিদিক আলোময় হয়ে গেল। দু’চারটে ছবি তুললাম, কিন্তু মনের মত হলো না। টিলার ওপরের অংশটা সবুজ ঘাসে ঢাকা।ইট সিমেন্টের বেঞ্চ করা আছে বসার জন্য, মাথার ওপরে ছাতাও তৈরী করা আছে। ঈদের ছুটিতে আমাদের মত অনেকেই এখানে বেড়াতে এসেছেন।
নীলাচলের কিছু ছবিঃ
নীলাচলে ওঠার সিড়ি
নীলাচলের সূর্য্য
এক সময় সূর্য্য ডুবে গেল। ততক্ষণে আকাশেও চাঁদের উদয় হয়েছে। কিন্তু এত গাছপালায় আমরা দেখতে পাচ্ছি না সে চাঁদ। শুধু জ্যোৎস্নায় আলোকিত আকাশটাই দেখছিলাম আর অপেক্ষায় ছিলাম। সেদিনের আকাশ ছিল মেঘ মুক্ত- পরিষ্কার, আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ করে এক সময় চন্দ্রদেবী দেখা দিলেন। ঘন গাছপালার মাঝে প্রায় পুর্ণিমার চাঁদটি ছিল চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো।(আমার জানা মতে ২৮ তারিখ ছিল পূর্ণিমা)। আর সব পুর্ণিমার চাঁদের চেয়ে সে রাতের চাঁদ বেশ বড়ও দেখাচ্ছিল। ততক্ষণে সে চাঁদের মিষ্টি আলোয় আমাদের কোরাস গান শুরু হয়ে গেছে, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে ----“ এরপরে “চাঁদের হাসির বাঁধে ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।-----“ । ছোট বড় সবাই মিলে গাইছিলাম আমরা। কী এক আকর্ষণে আজ পুর্ণিমার কাছে বন্দী হয়ে রইলাম আমরা, মনে হয় যেন সারা রাত এখানেই কাটাই! কিন্তু বেরসিক সিকিউরিটির বাঁশি বেজে উঠল একসময়,” আপনারা আর এখানে দেরী করবেন না। “ চলে এলাম আমরা লোকালয়ের কাছাকাছি। মাঝে মাঝেই কংক্রিটের বেদি করা আছে, কেন জানি না। হয়তো বসার জন্যই। আমরা ওখানে বসে, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে আসা চাঁদের আলো প্রাণভরে উপভোগ করলাম আরো কিছুক্ষণ।
এদিকে ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাবে রাত ন’টার মধ্যেই, তাই চলে যেতে হলো খাবার ঘরের দিকে। আজ এ বেলা রান্না হয়েছে কৈ মাছ আর মুরগী, সাথে সবজি আর ডাল। খাবার পরে কেউ কেউ চা-এর আবদার করলেন। চা খেয়ে, যে যার রুম-এ ফ্রেশ হয়ে, ঘুমের দেশে----।
কালকের প্রোগ্রাম কালকেই বলব, হ্যা?
সে পর্যন্ত বার্ড-এর কিছু ছবি দেখুনঃ
ড্রাগন ফল -এর গাছ
****************************************************************************
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩৭