পাঠান বলতে আমরা সাধারনতঃ আফগানিস্তানের অধিবাসী বুঝি।পাঠান জাতি বেশীরভাগ বাস করে আফগানিস্তানে, আর এর পরেই পাকিস্তানে। আফগানিস্তানের সরকারী নাম আফগানিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র। (পশতু ভাষায়ঃ দে আফ্গানিস্তান্ ইস্লামি জোম্হোরিয়াৎ; ফার্সি ভাষায়ঃ জোম্হুরীয়ে এস্লমীয়ে অ্যাফ্গ়নেস্তন্।) আফগানিস্তানকে অনেক সময় দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অংশ হিসেবেও গণ্য করা হয়। আফগানিস্তানের উত্তর সীমানায় তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান; পূর্বে চীন এবং পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর; দক্ষিণে পাকিস্তান এবং পশ্চিমে ইরান। আফগানিস্তান শব্দটির অর্থ- "আফগান (পশতুন) জাতির দেশ"।
আফগানিস্তান একটি রুক্ষ এলাকা - দেশটির অধিকাংশ এলাকা পর্বত ও মরুভূমিতে আবৃত। পর্বত উপত্যাকাগুলি আর উত্তরের সমভূমিতেই কেবল গাছপালার দেখা মেলে। এখানকার গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া গরম ও শুষ্ক এবং শীতকালে এখানে প্রচণ্ড শীত পড়ে। কাবুল দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। কাবুল আফগানিস্তানের পূর্ব-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত। অন্যান্য প্রধান শহরের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণের কান্দাহার, পশ্চিমের হেরাত এবং উত্তরের মাজার ই শরীফ। ছোট শহরগুলির মধ্যে আছে পূর্বের জালালাবাদ, কাবুলের উত্তরে অবস্থিত চারিকার, এবং উত্তরের কন্দোজ ও ফয়েজাবাদ।
আফগানিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চল সুউচ্চ পর্বতময় এলাকা। দেশটির প্রায় অর্ধেক এলাকার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২,০০০ মিটার বা তার চেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। ছোট ছোট হিমবাহ ও বছরব্যাপী তুষারক্ষেত্র প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ৭,৪৮৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট নওশাক আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এক সময় 'কাবুলিওয়ালারা' আমাদের দেশে ব্যবসা করতে আসতো। পেস্তা, বাদাম, কাজুবাদাম, কিসমিস, আখরোট, নানা রকমের রঙিন মুল্যবান পাথর নিয়ে আসত, যা অলংকারে ব্যবহৃত হতো।
আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিস্থল হিসেবে পরিচিত। বহু প্রাচীন বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণ এই দেশের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে চলাচল করেছেন, এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। দেশটির বর্তমান জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। আফগানিস্তানে বসবাসরত সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী হল পশতুন বা পাঠান জাতি। এরা আগে আফগান নামেও পরিচিত ছিল। তবে বর্তমানে আফগান বলতে কেবল পশতুন নয়, জাতি নির্বিশেষে রাষ্ট্রটির সব নাগরিককেই বোঝায়।
আফগানিস্তান প্রশাসনিকভাবে ৩৪টি প্রদেশ বা ওয়েলায়েত-এ বিভক্ত। প্রতি প্রদেশের নিজস্ব রাজধানী আছে। প্রদেশগুলি আবার জেলায় বিভক্ত। একেকটি জেলা সাধারণত একটি করে শহর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত।
ধর্মই আফগানিস্তানের বিভক্ত জাতিসত্তার দৃঢ়তম বন্ধন। আফগানদের প্রায় ৯৯ শতাংশই মুসলিম। এদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ সুন্নি এবং প্রায় ১৫ শতাংশ শিয়া মুসলিম। শহরগুলিতে অল্পসংখ্যক হিন্দু, শিখ, পারসিক ও ইহুদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে অনেক আফগান ইহুদী ইসরায়েলে পাড়ি দিয়েছেন। হযরত আলির (রাঃ) কবর মাজার-এ-শরিফ অনেক মুসলিমের তীর্থস্থল।
প্রথম দেখা কাবুল।
ছাত্রীরা স্কুলের পথে
নিস্পাপ শিশুরা
জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবর ছিলেন মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর আর বাবার দিক থেকে তৈমুর লঙের বংশধর। তিনি ১৫০৪সালে কাবুল দখল করেন এবং তারপর ভারতে যেয়ে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।
১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে ভারতে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্য এবং পারস্যের সাফাউইদ রাজ বংশের রাজারা আফগানিস্তানের দখল নিয়ে যুদ্ধ করেন। সাধারণত মুঘলেরা কাবুলের দখল রাখত এবং পারসিকেরা হেরাত দখলে রাখত, আর কান্দাহারের শাসনভার প্রায়ই হাতবদল হত।
১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে, এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন । তখন থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান একটি রাজতন্ত্রছিল। অনেক হাতবদল হয়ে ১৯১৯ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধশেষে আফগানিস্তান দেশটি ব্রিটেন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিপ্রায়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং সোভিয়েত- আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং এর সাথে সাথে দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে তালেবান নামের একটি মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী কাবুলের দখল নেয়। তালেবান সন্ত্রাসবাদী দল আল-কায়েদাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়। ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ২০০১-এর শেষে তালেবানদের উৎখাত করে। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানের সংবিধান নতুন করে লেখা হয় এবং একটি রাষ্ট্রপতি-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত এই দেশটি এখনও অশান্ত। তালেবানদের গুপ্তহত্যা চলছেই।
বিভিন্ন গোত্রের সর্দারগন ।
মরু বাহন।
সবুজ কাবুল
বিধ্বস্ত রাজবাড়ী
বিধ্বস্ত রাণীমহল
বিধ্বস্ত দেশ
জাতিসংঘের তত্বাবধানে বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজ চলছে এখন। বাড়ী-ঘর, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবই ছিল বিধ্বস্ত। জাতিসংঘের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আমার হাসবেন্ড ছয় বছর আফগানিস্তানে ছিলেন। (তিনি পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার।) সেই সুযোগে আমি আফগানিস্তান গিয়েছিলাম, ছিলাম কিছুদিন। তখনই আফগানদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় আমার।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত পাঠানরা মনের দিক থেকে খুব পরিস্কার। আর বাংলাদেশী মুসলমানদের ওরা খুব পছন্দ করে। আফগানদের খুব অতিথীপরায়ন বলে মনে হয়েছে আমার। আমি কয়েকটি পরিবারে দাওয়াত পেয়েছিলাম। ওদের খাবার পরিবেশনটাও বনেদী। মেঝেতে ভারি কার্পেট বিছিয়ে বসা, পেছনে বড় বড় ফোম রাখা আছে। চাইলে হেলান দিয়ে, আরো আরাম করে বসা যায়। আফগানরা অতিথী আপ্যায়নে বিশেষ এক ধরনের পাত্র ব্যবহার করে, এতে সাজানো থাকে কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোট, কিসমিস, চকলেট সাথে চিনি বিহীন লাল চা। এটাই অতিথীকে প্রথম আপ্যায়ন। চা পরিবেশনার শেষ নেই। এক কাপ শেষ হবার আগেই ঐ কাপে আবারো চা ঢেলে দেওয়া হবে। আমি চিনি ছাড়া চা পানে অভ্যস্ত নই, তাই চা-এর সাথে চকলেট খেয়েছি।
মেয়ে মহলে পুরুষ অতিথীদের প্রবেশ নিষেধ। আমাকে এক সময় নিয়ে যাওয়া হলো মহিলা-মহলে। সেখানে পরিবারের মহিলা সদস্যারা আমাকে সালাম জানিয়ে বসতে দিলেন। বসার ব্যবস্থাও মেঝেতে, চেয়ারে নয়। তারপর শুভেচ্ছা বিনিময়। কিন্তু মেয়েরা বিপাকে পড়ল ভাষা সমস্যায়। ওদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন পঙ্গু করে দিয়েছিল তালেবানরা, মেয়েদের স্কুল-কলেজ সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিল। ওই পরিবারের একটি মেয়ে এইচ,এস,সি পাশ। সে কোনরকম ইংরেজি বলতে পারে না, তাদেরকে শেখানোই হয় না। আমাকে ওদের পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যের সাথে কথা বলতে হলো, সে আবার মেয়েদেরকে আফগান ভাষায় ট্রান্সলেট করে দিল। সব মেয়েরাই অসম্ভব রকমের সুন্দরী!!!! আফগান পুরুষরাও সুন্দর।
অতিথীকে প্রথম আপ্যায়ন। চা, বাদাম ও কিসমিস দিয়ে।
আফগানরা অতিথী আপ্যায়নে বিশেষ এক ধরনের পাত্র ব্যবহার করে, এতে সাজানো থাকে কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোট, কিসমিস,চকলেট সাথে চিনি বিহীন লাল চা। চা পরিবেশনার শেষ নেই। এক কাপ শেষ হবার আগেই ঐ কাপে আবারো চা ঢেলে দেওয়া হবে।
আফগান পরিবারের মহিলা সদস্য
ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন। আফগানরা এ ভাবেই মেঝেতে বসে খাবার খায়।
বিধ্বস্ত আফগানিস্তান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। যেমন সবুজ, তেমনি বিরান মরুভূমি। পাথরের পাহাড়, বরফে আবৃত পাহাড়, পাহাড়ী স্রোতস্বিনী নদি আবার কোথাও নীল পানির প্রাকৃতিক লেক। পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন। রাজধানী কাবুলে বাগ-এ-বাবর নামক একটি বাগানে মোঘল সম্রাট বাবর-এর সমাধী অবস্থিত। বাগ-এ-বাবর একটি বাগান, ১৫২৮ সালে সম্রাট বাবর, বাগ-এ-বাবর নামে বাগানটি তৈরী করেন।
১৫১৯ সালে সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মাদ বাবর ইউসুফজাই উপজাতীয় আফগান সর্দারের কন্যা বিবি মুবারিকাকে বিবাহ করেন। ইতিহাস থেকে জানা জানা যায় বিবি মুবারিকাকে বিবাহ করার বিষয়ে একটি চমৎকার গল্প আছে। বিবি মুবারিকা একজন দানশীলা মহিলা ছিলেন। একদিন বাবর ছদ্মবেশে ফকির সেজে বিবি মুবারিকার কাছে যান আর ছদ্মবেশী বাবরকে একজন কামেল লোক মনে হওয়ায় তিনি (বিবি মুবারিকা) বাবরের জুলুম থেকে বাঁচার জন্য তাঁর (বাবর) কাছ থেকে দোয়া চান। তখন সম্রাট বাবর সেখান থেকে চলে যান ও বিবি মুবারিকার কথা থেকে বুঝতে পারেন যে ইউসুফজাই উপজাতীয় সম্প্রদায় ভারত বা হিন্দুস্থান অভিযানের বিপক্ষে। যুদ্ধপ্রিয় ইউসুফজাই উপজাতীয় সম্প্রদায়কে হাত করার জন্য সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মাদ বাবর আফগান সর্দারের কন্যা বিবি মুবারিকাকে বিবাহ করেন।
আগ্রায় যমুনা নদীর পূর্ব দিকে তাজ মহলের বিপরীতে প্রচুর বাগান থাকায় ঐ জায়গাটিকে আগ্রাবাসী কাবুল বলত। জানা যায়, সম্রাট নাসিরুদ্দিন মোহাম্মাদ হুমায়ুন তাঁর পিতার শেষ ইচ্ছার রহস্য জানতেন। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মাদ বাবর আগ্রার পুরানা কিল্লায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পরে সম্রাট বাবর, তাঁকে কাবুলে সমাহিত করার জন্য ওছিয়ত করে যান। সম্রাট বাবরকে যমুনা নদীর পূর্ব দিকে তাজ মহলের বিপরীতে আরাম বাগের চারবাগে অস্থায়ী ভাবে সমাহিত করা হয়, সেখানে কয়েক বছর তাঁর দেহাবশেষ ছিল। কাবুল বলতে সম্রাট বাবর আফগানিস্তানের কাবুলকে বুঝান নি, তিনি আগ্রায় যমুনা নদীর পূর্ব দিকের কাবুলকে বুঝিয়েছিলেন। সম্রাট বাবরের ওছিয়তের ভুল ব্যাখ্যা করে, নয় বছর পরে বাবরের স্ত্রী বেগা বেগম তাঁর দেহাবশেষ আফগানিস্তানের কাবুলে পাঠিয়ে দেন। কাবুলের বাগ-এ-বাবর-এ পুনরায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। পরবর্তিতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী (আফগানী) মুবারিকাকে তাঁর পাশে সমাহিত করা হয়।
মোগল সম্রাট বাবরের কবর। কাবুলের বাগ-এ-বাবর-এ অবস্থিত।
এমনই পাহাড়ে বেষ্টিত কাবুল
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৬