যেকোন চিকিৎসা পদ্ধতিতে একটু ব্যতয় ঘটলেই, এখন ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা, ডাক্তারের অবহেলা নামক উপাধি জুড়ে দেয়া যেন খুব সহজবোধ্য আর সহজলভ্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। এটি যে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা, তা নয়, বরং বিশ্ব জুড়েই প্রচলিত। এটার পেছনে সবচাইতে বড় কারণ লেখক বা সংবাদপত্রের সাংবাদিকের মেডিকেল বিষয়ক জ্ঞানের স্বল্পতা। চিকিৎসা সেবায় সব ভুলই যে ঢালাওভাবে অস্বীকার যোগ্য তা বলছিনা, কিন্তু স্পর্শকাতর কিছু বিষয় থাকে, যেখানে রিপোর্ট বা কোন কিছু মন্তব্য করার আগে, আবেগের উর্ধ্বে উঠে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করা প্রয়োজন। ধরা যাক, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনা হলো, পরে প্রমাণিত হলো যে তিনি আসলে এ বিষয়টিতে ভিক্টিম হয়েছেন। পত্রিকা তার কাটতি বাড়ানো জন্য নিসন্দেহে প্রথম অভিযোগটিকে যেভাবে ফলাও করে, পরে প্রমাণিত সত্যের বিষয়ে তার সমান ট্রিটমেন্ট দিতে ঠিক ততটুকুই কুন্ঠিত হয়। কারণ আগের নিউজটার লিড ভ্যালু প্রচুর, আর পরেরটা পাব্লিক খাবেনা। কিন্তু তার ইমেজের যতটুকু ক্ষতি হবার, তাতো হয়েই গেল।
চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কিছু একটা লিখে দিলে পাঠক সমাজে তার লিড ভ্যালুও অনেক। কারণ চিকিৎসকরা মানুষের খুব সন্নিকটবর্তী থাকেন। ঢাবির এক উচ্ছৃঙ্খল মেয়ের হাতে লাঞ্ছিত হয়েও উল্টো চরিত্র হনন করে রিপোর্ট করা- বাংলাদেশের মেডিসিনের অন্যতম দিকপাল, সহস্র চিকিৎসক তৈরীর কারিগর অধ্যাপক ডা, রফিকুদ্দিনও এর হাত থেকে নিস্কৃতি পাননি। যার মূল্য তাকে দিতে হয়েছে অকালে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। আরেকটি ঘটনা হচ্ছে কিডনী ট্রান্সপ্লান্টেশনের বিরুদ্ধে একাধারে যেভাবে রিপোর্ট করা হলো, সব ডোনার নাকি একমাত্র দালালের মাধ্যমে আনা হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এমন প্যানিক সৃষ্টি করা হলো, ফল যা হল বাংলাদেশে স্বল্প খরচে যেখানে কিডনী ট্রান্সপ্লান্টেশন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছিল, সেখানে আত্মীয় স্বজনের দান করা কিডনী হবার পরেও ট্রান্সপ্লান্টেশন অসম্ভব হয়ে পড়ল। রোগীরা সব লাইন দিয়ে পাশ্ববর্তী রাস্ট্রের দিকে ছুটতে লাগলেন, লাখ লাখ ডলার বের হয়ে গেল দেশ থেকে। বলতে পারবেন, তাতে প্রকৃতপক্ষে কার লাভ হয়েছে?
একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরী করতে একটি দেশের অনেক ঘাম ঝরাতে হয়, অনেক বছরের সাধনার ফলে রাস্ট্র পায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। যখন তিনি তার পূর্ণতায় পৌছেন, তখন তার সেবার বিরুদ্ধে যেকোন দায়িত্বহীন মন্তব্য বা প্রচারনা, শুধু কি একজন ব্যক্তির ইমেজকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে? রাস্ট্রের সম্পদহানির কারণ কি হয়না?
চিকিৎসা শাস্ত্রে ভুল শব্দটির নানা ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু অভাগা এই দেশে Misconduct, mistake, negligence শব্দগুলোকে একটি বাংলা দিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়। 'ভুল চিকিৎসা'। যিনি বা যাহারা এটি বলেন বা লিখে থাকেন, এই জবাবটি স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিকট প্রত্যাশিত যে, তাহলে বলুন, সঠিক চিকিৎসার সংজ্ঞা কি অথবা ঐ ক্ষেত্রে কি করলে সঠিক চিকিৎসা হোত বলে মনে করেন? অনেক সময় দেখেছি, মাকে বাঁচাতে গিয়ে গর্ভের সন্তানকে সেক্রিফাইস করতে হয়েছে, কিন্তু বাচ্চাকে কেন বাঁচানো গেলনা, এত চিকিৎসক অবহেলা করেছেন বলা হলে পাল্টা প্রশ্ন করাই যায় সবকিছুই কি চিকিৎসকের ক্ষমতার মধ্যে? তিনি তো আপনাদের মতই রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ। তারও নিশ্চয়ই আবেগ অনুভূতি, কষ্ট-কান্না, মায়া মমত্ববোধ সবই আছে। সব অভিযোগের তীর কেউ তারদিকে মারতে হবে?
বেশ কিছুদিন আগে পড়েছিলাম Theonlywayisdhaka.woprdpress.com এ আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডা. মৃনাল সরকারের বিরুদ্ধে এমা বার্টন নামী একজন বিভিন্ন অভিযোগে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ডা. মৃনাল প্রায় ত্রিশ বছর ধরে গাইনী-অবস আর নিসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সতের কোটি মানুষের বাংলাদেশে নিসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসা করেন, এমন সংখ্যা দু হাতের আঙ্গুল-ও পেরোবেনা। দেশের মানুষকে স্বদেশে রেখেই তারা বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা পৌছে দিতে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। লেখক আবেগময়ী ভাষায় যা লিখে গিয়েছেন, তার সারমর্ম হচ্ছে, তার সন্তান ভ্রুনীয় অবস্থায় তার ওজন নিয়ে চিকিৎসকদের নানা ধারনা (আল্ট্রাসাউন্ড এর মাধ্যমে অনেকগুলো রিপোর্ট নিয়ে গড় বের করতে হয়), ভ্রুনের সুস্থতা অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকদের মন্তব্য, প্রসব পরবর্তী সেবা নিয়ে তার অভিজ্ঞতার মর্মম্পর্শী বর্ণনা। একজন চিকিৎসক হিসাবে লেখাটি পড়া শেষ করবার পর মনে হবে এ লেখাটি কেন লেখা হল? এটি কি একজন উদ্বিগ্ন মায়ের মনের না বলা কথা নাকি চিকিৎসকের প্রতি অকৃতজ্ঞতার একটি দলিল? এটি পাওয়া না পাওয়ার উপাখ্যান নাকি একজন রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কিছু হালকা বক্তব্য? হৃদয়ের আকুতি প্রকাশই যদি মুখ্য হবে, তবে কেন নিজের ভেবে নেয়া কথা গুলো অক্ষরে সাজিয়ে অন্যের ইমেজ হননের এমন কূট প্রয়াস? স্বাভাবিক অবস্থাতেই একটি ভ্রুন মায়ের গর্ভে থাকাকালীন তার সর্ম্পকে সুনিশ্চিত ধারনা, তার ওজন, তার অবস্থা পুরো পুরি একজনের চিকিৎসকের আয়ত্তে থাকেনা। আর কৃত্রিমভাবে যেসব ভ্রুণ নিয়ে কাজ করা হয়, সেখানে তো বলাই বাহুল্য। চিকিৎসক তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা দিয়ে তা ধারনায় নেবার চেষ্টা করেন। একজন মা যেমন তার সন্তানকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, তেমনি টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে কাজ করেন, এমন চিকিৎসক নিসন্দেহে তার চাইতে কম উদ্বিগ্ন থাকেন না। সন্তানহীনা মা-কে ''মা'' ডাক শোনাবার এই দুর্লঙ্ঘনীয় যাত্রায় সবকটি এপিসোডই তার নিকট একেকটি চ্যালেঞ্জ। একটি সুস্থ সবল বাচ্চা জন্মদান নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তিনি সেভাবেই তার প্ল্যান নির্ধারন করেন। এটি কারও কাছে ব্যবসায়িক, কারও কাছে অতিরিক্ত। বিশেষ করে যারা অ্যাপোলো হাসপাতালের মতো চিকিৎসা কেন্দ্রে যান, তারা তো সুপার ভিআইপি, চিকিৎসকের মাথা ব্যথার কারণ। কিছু হলেই তো ঘাড়ে মাথা থাকবেনা। ভুল চিকিৎসার এই দেশে, সেখানেও নাকি অবহেলা হয়েছে? কিন্তু সবচাইতে বড় সত্য এটিই যে, শেষ পর্যন্ত তিনি একটি প্রি ম্যাচিউর বাচ্চা, কম ওজনের কারণে যেখানে মৃত্যুই ছিল নিয়তি, সেখানে আমার শ্রদ্ধেয় স্যার তার মাকে একটি সুস্থ প্রাণোচ্ছল শিশু বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন। অনেক অকৃতজ্ঞতার কষাঘাতের পরেও হয়ত এটি তার জন্য একমাত্র সান্তনা।
সমস্যা যা হয়েছে, তা হল প্রতিটি উন্নতি-অবনতি বাচ্চাটির অভিভাবককে তিনি জানাতে চেয়েছেন, তাকে মানসিক ভাবে তৈরী রাখতে চেয়েছেন, যাতে চরম কিছু ঘটে গেলেও ভুল বুঝাবুঝি না হয় আর ফলাফল যা হয়েছে, অভিভাবক ধৈর্য্যধারন না করে উল্টো চিকিৎসককেই ভুল বুঝেছেন। উদ্বিগ্ন চিকিৎসক তার পূর্ণ টিম নিয়ে বারংবার রোগী আর তার বাচ্চার দেখভাল করেছেন, এটিও মায়ের লাজুকতার বিচারে দৃষ্টিকটু লেগেছে? আর সেটি না করলে বোধ হয় লিখতেন, '' মৃনাল সাহেব তো দূরের কথা, তার কোন সহযোগীও আমার একটু খোঁজ নিতে আসেননি।'' অক্সিজেন সমস্যা, না বলে এন্টিবায়োটিক দিয়েছে, স্পেশাল ইউনিটে নিয়েছে, গাইনী আর পেডিয়াট্রিক্স বিশেষজ্ঞদের আনাগোনা অতিরিক্ত ছিল, কেন বুকের দুধ খেতে দেয়নি, নিউনেটাল আইসিইউতে নেয়া হল- আরও কত কি? এসব কথা শুনে মনে হতে পারে, তিনি বোধ হয় নিজেই বাচ্চাটির চিকিৎসার দায়িত্ব নিলে চিকিৎসার জন্য কোন কিছুই করা লাগতো না। একটি প্রিম্যাচিউর বাচ্চা, মুখ ফুটে আপনাতেই মা বলে ডেকে উঠতো।
যাই হোক না কেন? এসব দেখে, এই দেশে একজন চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতে, মনে যারপরনাই হতাশা কাজ করে। যা করা হয়, সবই ভুল!!! তবে মুখ বুঝে এই দেশে, কিভাবে সঠিক কাজ করা সম্ভব? জুনিয়র ডাক্তারদের কথা তো বাদই দিলাম, এত বছরের অভিজ্ঞ, নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসককে যখন এহেন আক্রমণ করা হয়, তিনি কেন রোগীর জন্য বাড়তি দায়িত্ব নেবেন? প্রিম্যাচিউর বেবি মরে গেলে এই রোগী নিশ্চয়ই আবার পরবর্তী ট্রায়ালের জন্য তার দারস্থ হবে। কারণ বাচ্চা তো তার চাই-ই চাই। সেটিই কি বরং ব্যবসায়িক দিক থেকে বেশি লাভজনক হতো না?
কোন এক মনীষি বলেছিলেন, যে দেশ গুনের কদর নেই, সেই দেশে গুনী জন্মায়না। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু অযথা দোষারোপ করে একটি আন্তরিক প্রচেষ্টাকে, অপব্যাখ্যা করে পরোপকারী একটি মনকে নষ্ট করার অপরাধ, একটি ভুল চিকিৎসার চাইতেও বেশি অপরাধজনক কর্ম বলে বিবেচিত হতে পারে। কারণ কোন চিকিৎসকই তখন রিস্ক নিয়ে মরণাপন্ন রোগীর জন্য ''ভুল চিকিৎসা''র দায়ভার নিতে চাইবেন না। তার পোস্টের জন্য একটিই জবাবই যথেষ্ট '' এত ঝামেলার পরেও প্রিম্যাচিওর বাচ্চা জন্ম লাভ করেছিল আর আপনি একটি সুস্থ সন্তানের মা হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন।'' ডা. মৃনালের পক্ষে এর চাইতে বড় যুক্তি আর দেবার প্রয়োজন নেই। তিনি আমার শিক্ষক, এই গর্ব, আরও উচ্চকিত হলো এই কারণে যে তিনি সত্যিই শেষ পর্যন্ত পেরেছেন। স্বল্পস্থায়ী সম্পর্কের এমা বার্টন নয়, দীর্ঘ সান্নিধ্যে থেকে আমরা জানি, তিনি কেমন? মানুষের জন্য তিনি কতটুকু অনুভব করেন? একজন পোস্ট দিয়ে ''চরম কৃতজ্ঞতা'' জানিয়েছে, কিন্তু প্রতি মাসেই তো তার চেম্বার নতুন বাবা-মা হওয়ার খুশীতে আনা ফুল আর মিস্টির প্যাকেটে নব সাজে সজ্জিত হয়। তিনি পারেন, তিনি পারবেন। এই দেশ আর মানুষকে ভালোবেসে, নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে তিনিই প্রতিবারই বিজয়ী হবেন। কারণ সবাই তো এমা বার্টন নয়। শ্রদ্ধেয় স্যারের জন্য অনেক শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:১৭