শিশু যখন গর্ভে থাকে, তখন তার আগমন পিতা মাতার কাছে যতই আকাঙ্খিত থাকুন না কেন, নয়টি মাস অপেক্ষা করতেই হবে। তাড়াহুড়ো করে সময়ের আগেই তাকে জোর করে ভুমিষ্ট করাতে গেলে যা হবে, তা হলো মৃত শিশু প্রসব। আর যদিওবা শিশুটি বেঁচে থাকে, তাহলে তার পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী হবার সম্ভবনা প্রায় শতভাগ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেবার পর থেকেই সুধী মহল বারংবার সতর্ক বানী উচ্চারন করে আসছিলেন, যেন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হয়,আইনগত যত ফাঁক-ফোকর তা যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে সকল কর্ম সম্পাদন করা হয়। প্রয়োজনে আরও সময় নেয়া হোক, কিন্তু চল্লিশ বছরেও যে কাজটি করা সম্ভব হয়নি, তা যেন কারও নিবুর্দ্ধিতার কারনে ভেস্তে না যায়। এ বিচারকে দলীয় স্বার্থসিদ্ধীর বাহনে যেন পরিণত করা না হয়। কিন্তু সুধীজনের বলাই সার।
যা হয়েছে আর যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমকে যেভাবে নাগরিকত্ব মামলায় নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, আগামী দিনে এ সরকার নিজামী, মুজাহিদ, সাইদী, কামারুজ্জামান আর কাদের মোল্লাদের বিরুদ্ধে রাজাকার প্রচারণা মিথ্যা ছিল, লিখিত ও আইনসিদ্ধভাবে এই সার্টিফিকেট দেবার বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেছেন।
মাথা ঠান্ডা করে একটু ভাবুন পরের বিষয়গুলো নিয়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাবে সরকারের চরম নির্বুদ্ধিতা।
সরকারের নির্বুদ্ধিতাঃ
প্রথমতঃ
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাতিমান আইনজীবিদের বাদ দিয়ে অখ্যাত ও দলীয় আইনজীবিদের নিয়ে (আর্থিক সুবিধা দলের লোকই ভাগ করে খাক- এই উদ্দেশ্যে) করা হয়েছে আইনজীবি প্যানেল। যারা জীবনে আইন পেশায় জাতীয়ভাবে নাম করতে পারেননি, তারা নাকি জাতীয় ইস্যুতে লড়বেন জামায়াতের বাঘা বাঘা ব্যারিস্টারদের বিরুদ্ধে। হায়রে! পাগল। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দীকি বীর উত্তম তো ভবিষ্যত বানীই করেছেন, বাছুর দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়তঃ
বিতর্কিত হয়েছে স্বয়ং যে সংস্থা যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করবে, সেই সংস্থাটিও। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিরা বড় গলায় চেচালেন, পরিক্ষীত ব্যক্তিদের যুদ্ধাপরাধ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দুদিন না যেতেই রটে গেল 'সর্ষের মধ্যেই বসে আছে যুদ্ধাপরাধের ভূত'। অবশেষে মানুষের আস্থাকে দুমড়ে মুচড়ে রটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করলেন যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিটির প্রধান আব্দুল মতিন। এরপরে কোন অদৃশ্য কারণে প্রধান হিসাবে আজ পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ করা হয়নি। উল্টো আইন মন্ত্রীর মুখ থেকে শোনা গেল এতো বড় জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের তদন্ত কমিটির নাকি কোন প্রধান থাকার দরকারই নেই। (আমরা সবাই রাজা!! সবাই প্রধান!!) নির্বোধ কাকে বলে? ষোল কোটি মানুষের দেশে একটা তদন্ত কমিটির প্রধান করতে কাউকেই পাওয়া গেল না?
তৃতীয়তঃ
দশ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ কোটি টাকা নাকি বাড়ী সংস্কারেই চলে গেছে। টেন্ডারে যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তিনিও নাকি কোন মন্ত্রীয় নিজের লোক। (আপন লোক বলে কথা! রেট তো বেশি হবেই, কারণ যিনি কাজ নিয়ে দিলেন, তাকে তো কিছু দিতে হবে, নাকি!) পাঠক, আপনারাই বলুন পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে তো একটি নতুন বাড়ীই তৈরী করা সম্ভব। তার অর্থ হচ্ছে, জাতির আবেগ অনুভূতির জ্বালানী নিয়ে দলীয় কর্মীদের লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এ অর্থের হিসাব বের করতে নাকি আবার তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে (তদন্ত কমিটির কর্মস্থল নিয়ে টাকা লোপাটের রহস্য উদ্ধারে তদন্ত কমিটি)। অথচ যারা তদন্ত করবেন, তাদের গাড়ী নেই, থাকার বন্দোবস্ত নেই, অফিস নেই, পিয়ন নেই, প্রয়োজনীয় উপকরন নেই(হাওয়ায় ভেসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চলবে)।
চতুর্থতঃ
যুদ্ধাপরাধ বিচারে সরকার পক্ষে লড়ার জন্য নাকি বহু চেষ্টার পরেও আইনজীবি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বেতন মাত্র তিরিশ হাজার টাকা। এত কেউ রাজী হচ্ছেন না? এ যুগে একজন আইনজীবির নূন্যতম আয় যেখানে এক লাখ টাকা, সেখানে প্রাইভেট প্র্যাকটিস ফেলে সার্বক্ষণিক ভাবে এত বড় কাজে আসবে কোন পাগল? সংসার চালাবে কে? (চালের কেজি তো এখন চল্লিশ পার)। ষোল কোটি মানুষের টাকা নিয়ে মন্ত্রী-এমপি সবার বেতন ডাবল হয় আর তাদের জাতীয় ইস্যুতে টাকা আসে গুণে গুণে।
সরকারের অর্বাচীনতায় এবার বিতর্কিত হতে চলেছে স্বয়ং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল
সরকারে অর্বাচীনতা আর নির্বুদ্ধিতার আরও ছাপ আছে। অনুরোধ থাকবে মনোযোগ দিয়ে পড়ার। বিষয়টির বিপরীতে যুক্তিগুলো লক্ষ্য করলেই তা বেরিয়ে আসবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে হাইকোর্ট বিভাগের দু'বিচারপতির নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে গত ১৮ জুলাই,রোববার । আংশিক শুনানি শেষে সরকারের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী ২৬ জুলাই পর্যন্ত এই রিট আবেদনের শুনানি মুলতবি করা হয়েছে। বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি সৈয়দা আফসার জাহান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চে এই রিট আবেদনের ওপর আংশিক শুনানি শুরু হয়।
রিট আবেদনে ‘হাইকোর্ট বিভাগের দু'বিচারপতি কোন ক্ষমতাবলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন' তা জানতে চেয়ে রুলনিশি জারির আবেদন করা হয়েছে।
রিট আবেদনে স্বয়ং দুই বিচারক বিবাদী(!!!)ঃ
রিট আবেদনে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনারেল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং আইন সচিব ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে।
দেখুন যেসব যুক্তি দেয়া হয়েছেঃ
সংবিধানের ৯৪, ৯৬, ৯৯, ১০৯ ও ১৪৭(৩) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করে হাইকোর্টের দু' বিচারপতিকে ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৯৪(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা সুপ্রিমকোর্টে, হাইকোর্টের বিচারপতিরা হাইকোর্টে দায়িত্ব পালন করবেন। ফলে তারা কখনই কোন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হতে পারেন না।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। বিচারপতিদের নিয়োগ এবং চাকরির শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করবে সংবিধান। কিন্তু রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন সচিব সাধারণ আইনে অধীনে গঠিত ট্রাইবুনালে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন।
সংবিধানের পরিবর্তে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে।
ট্রাইব্যুনাল আইনে বলা হয়েছে নিয়োগকর্তা (সরকার) তাদের বরখাস্ত করতে পারবেন। ফলে উচ্চ আদালতের মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
তাদের নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তাদের চাকরির শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করবেন রাষ্ট্রপতি। এমন কি তাদের চাকরির মেয়াদ বা অপসারণের বিষয়ও রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করবেন।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট' নামে দেশে একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকবে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে এই আদালত গঠিত। যেকোন ট্রাইব্যুনালের উপরে হাইকোর্টের অবস্থান থাকবে। কিন্তু এক্ষেত্রে হাইকোর্টের বিচারপতিদের অধস্তন ট্রাইবুনালে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উদাহরন দেয়া হয়েছে, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ আজিজের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ গ্রহণের বিষয়ে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিলেন। ওই রায়ে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা অন্য কোথাও নিয়োগ পেতে পারেন না। তারা হাইকোর্টের বিচারপতি পদে থেকে অধস্তন ট্রাইব্যুনালে আসীন হয়েছেন । ফলে তাদের এই নিয়োগ সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ আমাদের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। এই নিয়োগের ফলে তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এমন কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর কুঠারাঘাত করা হয়েছে।
হাইকোর্টের দুই বিচারপতিকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে যিনি জুনিয়র তাকে আবার প্রধান করা হয়েছে ট্রাইবুনালের। এত করে মনে করা যেতে পারে অসুদুদ্দেশ্যে এ ধরনের নিয়োগ ও পদায়ন দেয়া হয়েছে।
যারা লড়ছেনঃ
সংবিধানের ১০২(২)(খ)(আ) অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি এডভোকেট নওয়াব আলী ও সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী গত ১১ জুলাই রিট আবেদনটি দায়ের করেন।
রিট আবেদনের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক শুনানিতে অংশ নেন। সরকার পক্ষে সহকারী এটর্নি জেনারেল রাশেদ জাহাঙ্গীর মামলা পরিচালনা করেন। শুনানিকালে সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও এডভোকেট নজরুল ইসলামসহ অর্ধশতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে শুনানিতে সহায়তা করেন এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিক।
দুইজন আইনজীবি বন্ধুর সাথে কথা বলার পর ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারনা, এ বিষয়টিতে হাইকোর্ট ট্রাইবুনালের বিপক্ষে রায় দেবার সম্ভবনা শতভাগ। তার মানে হচ্ছে আওয়ামী লীগের নিবুর্দ্ধিতায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালও বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। যা কিনা একটু বুদ্ধি খাটিয়ে নির্ধারন করলেই এড়ানো যেত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে আরও কতো নিবুর্দ্ধিতা অপেক্ষা করছে কে জানে?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১০ রাত ৯:২৫