আমি স্যার আছি মহা যন্ত্রনায়। হৃদয়ঘটিত ব্যাপার তো স্যার; খুব অস্থির অস্থির লাগে। আমার ৫ টা না, ১০ টা না, একটাই প্রেমিকা স্যার। আমার এই মনের মানুষটীকে ছাড়া আমি একেবারে শূণ্য একজন মানুষ। তাকে নিয়েই হয়েছে বিপদ। এখন আপনিই একমাত্র ভরসা স্যার।
স্যার, কাহিণী টা আপনাকে বলি; ঘটনা কেমনে যে কী হয়ে গেছে কিছুই বলতে পারবোনা, তবে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, সে আমার প্রেমে পড়েছে।
গত বইমেলায় হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে ঝালমুড়ী খাচ্ছিলাম। স্যার, বিশ্বাস করেন হিমুর হলুদ পাঞ্জাবীর সাথে আমার পাঞ্জাবীর মিল অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। আমি ঝালে হুসহাস করছি আর অপেক্ষা করছি আমার খালাত বোনের। যেদিন আপনার বই বেরুবে সেদিনই তাকে কিনতে হবে, কিন্তু ভীড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করতে পারবে না!! তার ধারনা, লোকাল বাসে যেহেতু আমি ধাক্কধাক্কি করে উঠতে পারি, তাই বইমেলার স্টলেও আমি সমান কার্যকরী। মেয়ে মানুষ, বোঝেনই তো স্যার, সাজগোজ করে ঘন্টাখানেক পর হাজির হোল। কিন্তু সাথে এ কে?
বড় বড় চোখ মেলে মেয়েটি তাকিয়ে ছিল আমার দিকেই! এত্ত সুন্দর কারো চোখ হয়? তখনি তার সাথে আমার প্রথম দেখা।
আপনি কি হুমায়ুন আহমেদের হিমু? সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি, দুষ্টুমি মাখা হাসিতে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমি হুমায়ুন আহমেদের হিমু হতে যাব কোন দুঃখে?
স্টলের সামনে কঠীন যুদ্ধ করে হিমুর দুটী বই কিনে ফেললাম। স্যার জানেন, আমি আপনার হিমু হতে চাইনি কোনদিন। কিন্তু বইটি তার হাতে তুলে দেবার সময় তার মুখের যে হাসিটি দেখেছিলাম, তাতে সেদিন খুব করে ভাবছিলাম, ইস! আমি যদি এই হিমু হতাম!
স্যার, আপনি আমার জায়গায় হলে ঘটনা সুন্দর করে বুঝাতে পারতেন; হয়তো আরেকটা উপন্যাসও লিখে ফেলতে পারতেন। কিন্তু আমি হলাম, একেবারে হত দরিদ্র একজন। শব্দের দিক দিয়েও, টাকা পয়সার দিক দিয়েও। নায়কদের মত আবেগী হয়ে ভালবেসে ভালবেসে ফতুর হতে পারিনা তার জন্য । আবার তাকে বসুন্ধরার শাড়ীর দোকান থেকে ঝলমলে শাড়ী, কিম্বা ডায়মন্ড প্যালেস থেকে গয়নাও কিনে দিতে পারিনা। আমি স্যার, আক্ষরিক অর্থেই ফতুর। নতুন করে হইনি। বংশপরম্পরা থেকেই আমরা ফতুর। আমরা ফতুর বংশ। হাহাহাহা।
কোত্থেকে কই চলে গেলাম। যা বলছিলাম। স্যার, আপনার সময় নষ্ট করছিনা তো? আপনি কত ব্যাস্ত মানুষ। কিন্তু আমাকে এই মহা বিপদ থেকে উদ্ধার না করে স্যার আপনি যেতে পারবেন না। আপনি স্বীকার করেন বা নাই করেন, আপনার উপর আমার একটা দাবী আছে। স্যার, আর বেশী দিন এভাবে চলতে থাকলে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাব। আপনি কি চান, আমি রাস্তায় দিগম্বর হয়ে ট্রাফিকগিরি করি, কিম্বা দৌড়ে এসে আপনার গাড়ীর সামনে পড়ি? সত্যি বলতে কি, আমাকে এই যন্ত্রনা থেকে বাচানো আপনার নৈতিক দায়িত্ব। স্যার, আফটার অল, আপনার কারনেই আজকে আমার এই বিপদ...
জ্বী স্যার, কথা সত্য। আপনি কিন্তু রাগ করতে পারবেন না আমার উপর। স্যার, এত কিছু পারেন আপনি, মানুষের মন নিয়ে খেলতে পারেন, আবেগ নিয়ে বাজি ধরতে পারেন, মনের গহীন কোণের গোপন জায়গায় অনায়াসে আপনার আসা যাওয়া, শব্দ এঁকে আপনি মানুষকে হাসাতে পারেন, কাঁদাতে পারেন, বিস্ময়ে অভিভূত করে দিতে পারেন; আর আমাকে আমার কষ্ট টা থেকে মুক্তি দিতে পারবেন না, এ আমার বিশ্বাসই হয় না!
সমস্যার শুরুটা অনেক অনেক দিন আগে। যখন আমার প্রেমিকার মনের ভেতর আমি ছিলাম না, ছিল শুধু ভবঘুরে রোমান্টিকতার আলো ছায়ায় হিমুর আদলে অস্পষ্ট এক নায়কের কল্পনা। খোচা খোচা দাড়ী আর হলুদ পাঞ্জাবী পড়া ঝালমুড়ী খাওয়ারত আমার সাথে সেই কল্পিত নায়কের অদ্ভুত মিল, আমার কষ্টকল্পনাতেও সম্ভব না। কিন্তু মেয়েদের মন বলে কথা! তাই না স্যার?
বিপদ টা কিন্তু শুরু স্যার এখানেই। ওই যে বললাম, মিল। হিমুর মতো কখনো হঠাত ঘুঘু পাখির শান্ত বিলম্বিত টানাটানা সুর শুনলে আমারো বুকের ভেতর কোথাও মোচড় দিয়ে উঠে। ভরদুপুরে রাস্তায় জ্যামে পড়ে হিমু উদাসী হয়ে আকাশে তাকায়, কিন্তু আমি; রিকশায় বসে গম্ভীর হয়ে সিগারেট খাই, অদৃশ্য কাউকে গালাগালি করি কিম্বা বাসে বসে থাকলে ঝিমাই।
তীব্র শীতের রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হিমু চা খায় আর দূর আকাশের তারা দেখে ভাবে যেন শাদা শাদা বরফের কুচি। আমিও শীতের রাতে কাপতে কাপতে চা খাই আর পরদিনের অনাগত দুঃশ্চিন্তায় চিন্তিত হই। আমার ভেতর কাব্য আসেনা।
হিমুর মতো যখন তখন আউড়ে যেতেও পারিনা ওর্ডসওর্থের কোন কবিতা।
আমার প্রেমিকা চায় আমি শাদা বরফ খন্ড দেখি আকাশে, কাব্য করে চমকে দেই তাকে; কিম্বা তার বাড়িয়ে দেয়া হাতের তালুতে হিমুর মতো দেখি কোন ভবিষ্যতের রেখচিত্র; কিন্তু আমি দেখি শুধুই কোমল আদুরে ফর্সা হাত। স্যার, সবাই কি আর পামিস্ট হয়ে মেয়ে পটাতে পারে?
তারপর ধরেন স্যার, পুলিশ। লালবাগ থানার ওসি সাহেবের বাসায় দুপুরে দাওয়াত খায় হিমু আর আমি খাই রুলের বাড়ি। গভীর রাতে ঢাকা শহরের রাস্তায় হাটাহাটি করে বেড়ানোর মত সাহস আমার নেই স্যার। সেই যে একবার মোড়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় পুলিশ ধরে নিয়ে গেল আর হাজতে পুরে দিল! তারপরেও কি আর সাহস থাকে, বলেন? আমার গালে রাম থাবড়া দেয়ার পরেও টহল পুলিশের হাত ফুলে ঢোল হয়ে যায় না, কিন্তু হিমুর বেলায়?
খুব ইচ্ছা করে গভীর রাতে ফুল নিয়ে প্রেমিকার বাসার সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে চমকে দেই। কিন্তু পুলিশের বাড়ি আর হাজতখানার ভয়ে আমি যদি বাসায় বসে প্রেমিকাকে মিসকল দেই, তাহলে কি আমাকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায়; স্যার, আপনিই বলেন।
মেট্রিক, ইন্টার আর বিসিএস’এ আজ পর্যন্ত যতগুলো অবজেক্টিভ আন্দাজে দাগিয়েছি, কি আর বলবো স্যার, একটাও মিলে নাই। সেই আমার আন্দাজে ঢিল ছুড়ে Rab’এর মেজর কিম্বা সাইক্রিয়াট্রিস্ট ইরতাজউদ্দীনকে ভড়কে দিতে চাওয়া কি মানায়? স্যার, বড় কিছু একটা হতে চাওয়া স্বপ্নগুলোর ভবিষ্যদ্বানীই যেখানে ফললো না, সেখানে কি ইনট্যুশন ধুয়ে পানি খাবো?
স্যার, চলেন চা খাই। আজ আমার সব কথা আপনাকে শুনতেই হবে। স্যার, ভুলে যাবেননা, আমার কিন্তু দাবী আছে! হাহাহা
কিসের দাবী? স্যার..., কষ্ট পেলাম খুব।
মনে আছে স্যার, আপনার হিমু একবার ২ টাকার চা খেয়ে কিভাবে অবলীলায় ৫০০ টাকা দিয়ে চলে আসলো? হাহাহা। আধখাওয়া বেনসন ফেলে দিতে বাকি ৪ টাকার কষ্টে বুক ফেটে যায় আমার। খুব কষ্টের রোজগার কিনা।
ফার্মগেটের ফকির একলেমুর মিয়ার সাথে বসে ভাত খেতেও পারবোনা আমি। আমার আত্মসম্মান জ্ঞান আবার খুব টনটনে।
সরকারী অফিসের চক্করে পড়েছিলাম গতবছর। কি যে হয়রানি হতে হয়েছে! স্যার, খুব ইচ্ছা করছিল হিমুর মতো ওদের মুখের উপর বলে ফেলি, শালা ঘুষখোর!
নিয়ন আলোর শহরে থাকি, জোছনা কখন আসে, কখন আলো বিলিয়ে চলে যায়, টেরও পাইনা। হঠাত হঠাত চাদের আলোয় পুড়ে গেলে খেয়াল হয়, বাহ, আজ দেখি বিশাল একটা চাদ উঠেছে! পেটের ধান্দায় ব্যাস্ত থাকি স্যার। জোছনা যখন উঠে তখন হয়তো ঘর্মাক্ত লোকাল বাসে হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে আছি, আয়োজন করে চাদমামা’র শৌর্য দেখার কাব্যি তখন ঝলসে ঝলসে যায়।
গাড়ীতে চড়া মেয়েগুলো সবসময় সুন্দর হয়। আমিও ততক্ষন তাকিয়ে দেখি, হুশ করে পাশ কাটীয়ে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত। বড়লোক বন্ধুরা মাঝেমাঝে গাড়ীতে চড়িয়ে লিফট দেয়। আমি তাতে সিগারেট ধরাতেই সাহস পাইনা, আবার হিমুর মতো সিগারেটের আগুন দিয়ে শেভ্রলেটের ভেলভেট সিট কভার পুড়িয়ে ফেলার মত খামখেয়ালীপনা! স্যার, আপনি যা বলেন না! হাহাহা
একবার আমার প্রেমিকার সাথে কঠিন ঝগড়া লেগেছিলো, জানেন স্যার? হিমু পারলেও আমি রূপবতীদের সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারিনা।
আমি সেদিন রেগে গিয়ে বলেছিলাম, আমি তোমার সেই হিমু নই, কিন্তু তুমিও কি আমার সেই রূপা?
তার সে কী রাগ!
রূপা একদিনের নোটিশে কতজনের চাকরি যোগার করে দিল, তা জান? আর মামা-চাচা হীন এই আমি একশ জুতার তলি ক্ষয় করে এই চাকরীটি বাগিয়েছি। শুধু হাত ধরে বসে না থেকে দিলে না কেন তখন যোগাড় করে একটা চাকরি?
তুমি কি চাও আমি তোমার তীব্র আকর্ষন উপেক্ষা করে দূরে দূরে থাকি? হিমু যেমন সন্ন্যাসীর মত নির্লিপ্ত থাকে রূপার চাওয়া পাওয়ার? আমিতো পারবোনা আমার অভিমান বোধকে চাপা দিতে তোমার বিন্দুমাত্র অবহেলায়! তাহলে আমি কিভাবে সেই হিমু হব?
স্যার, আমি আসলেই পারবোনা।
হিমুর আছে একজন করিম মিয়া, যে সন্ধান দিতে পারে যেকোন হারানো মানুষের। প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেললে তো আমার কেউ নেই, তাকে ফিরিয়ে দেবার।
আপনি তো স্যার হিমুর গল্প লিখেই খালাস। আপনি কি একবারো ভেবেছেন আমার কথা? বাস্তবের হিমু’র কথা?
জ্বী স্যার, ঠিক ধরেছেন, আমিই হিমু। এই সাধারন বাস্তবের হিমু।
দরজার ওপাশে, পারাপার, দ্বিতীয় প্রহর, নীল পদ্ম আর ঝি ঝি পোকার হিমু নই।
আচ্ছা স্যার, আমি ময়ূরাক্ষীর হিমু হতে পারিনা কেন বলতে পারেন? আমার ধারণা, সাধারন মানুষ হতে হতে আমার ভালবাসাটাও সাধারন হয়ে গেছে।
স্যার, আপনিই বলেন, সাধারন মানুষ কি কখনো হিমু হতে পারে?
হিমু নায়ক যে প্রেমিকার, সেখানে প্রতিদ্বন্দী আমি কিভাবে হব?
আমার প্রেমিকাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার?
(লেখাটি সামুতেই প্রথম পাব্লিশ করেছিলাম আজ থেকে ৩ বছর আগে। আবারো দিলাম সেই সামুতেই পুরান বোতলে পুরান মদের মতো। খুব সম্ভবত "লেখকের মৃত্যু" ঘটিয়াছে, তাই নতুন কিছু আর লেখার ক্ষমতা নেই। এই লেখাটির সাথে খুব মন খারাপ করা কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সামুতে আসার পর বেশ কিছু পত্রিকা লেখাটি ছাপার আগ্রহ দেখিয়েছিল। আর সেই একই সময়ে বই মেলায় অপরবাস্তব ৭ প্রকাশিত হবার কথা, শুধু মাত্র হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখার সঙ্কলন হিসেবে। আমার এই লেখাটিও নির্বাচিত হয়েছিল সেই সঙ্কলনে। সেই সময় আমার কি ভাব !! মাটিতে পা'ই পড়তো না !! আমার লেখা একটি বইয়ে স্থান পেয়ে প্রকাশিত হচ্ছে বইমেলায় !! এরচে বেশি গর্বের ব্যাপার আমার মত অতি সামান্য এক লেখিয়ের জন্য আর কি হতে পারে !! কিন্তু আফসোস, কাদের মোল্লা ভি চিহ্ন দেখিয়ে সব ভন্ডুল করে দিল। উত্থান হোল শাহবাগ - গণজাগরণ মঞ্চের। সেই ডামাডোলে অপরবাস্তব ৭ আর আলোর মুখ দেখলো না !! আমি পড়েছিলাম বিচিত্র এক পরিস্থিতিতে। একদিকে শাহবাগের উত্তেজনা, আরেকদিকে বই প্রকাশ না হবার যন্ত্রনা। আমি আবার এদিকে দুনিয়ার সবাইকে বলে বেড়িয়েছি, "আমার না বই বেরুচ্ছে এবারের বইমেলায় !! ইয়ে, ঠিক বই না, একটা লেখা আরকি !! হেহেহে !!" সেই বই তো আর বেরোয় না, আর পাব্লিকের কি গা জ্বালানো তাচ্ছিল্য মার্কা হাসি !!
যাক গে, সেসব কথা। স্যারের জন্মদিনে পুরান লেখাই আবার দেয়ার উদ্দেশ্য আরো কিছু নতুন মানুষের কাছে পৌছানো, পুরানো অনেক মানুষের অসম্ভব ভালবাসার কথা স্মরণ রেখেই....)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪১