রাস্তার ধারে যখন মজমা বসে, বানরের খেলা, সাপের খেলা দেখায়; তখন অনেকেই ভীড় করে দাঁড়িয়ে মজা নেই, কিন্তু খেলা শেষে যখনই কিছু সম্মানী দেয়ার সময় হয়, তখনি চামে কেটে পড়ি। সাধারণত দর্শক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে আমরা বড় ভালবাসি। আমরা কেবল তখনি কোন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই বা প্রতিবাদী হই, যখন বিতর্কিত বিষয়টা নিজের ঘাড়ে এসে পড়ে বা নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। এবং কেবল তখনি আমরা রাস্তার ধারের মজমা থেকে নগদ পয়সা দিয়ে একটা বোতল খরিদ করি।
বাক স্বাধীনতা কিম্বা স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে আমরা কম বেশি সবাই সোচ্চার। “যা ইচ্ছা তাই বলবো, যা ইচ্ছা তাই শেয়ার করবো” - এই আমাদের মটো। কিন্তু এর ভেতরে ছোট্ট আরেকটা মটো লুক্কায়িত আছে; - “অন্যেরটা সহ্য করবো না।” এই কন্ট্রাডিকশনের নাম - হিপোক্রেসি; সোজা বাংলায় - মুনাফেকি।
সাধারন মানুষ বলতে এক্কেবারেই সাধারণ এই আমরা কবে থেকে বাক অধিকার সচেতন হয়ে গেলাম?
যেদিন আমরা ফেসবুক কিম্বা ইউ টিউবে লগ ইন করতে গিয়ে হঠাত বুঝলাম, এই প্রিয় সাইট দুটো ব্যান খেয়েছে।
যখন থেকে আমরা বুঝতে পারলাম স্বাধীন মতামতের প্ল্যাটফর্ম ব্লগ গুলোতে নিজের মত প্রকাশ কিম্বা এমনকি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়াও আর নিরাপদ না।
সরকারের কোন অবিবেচক সিদ্ধান্তে নিজের আক্ষেপ প্রকাশ যখন হামলা, মামলা, ঝামেলায় রূপান্তরিত হয়।
উন্মুক্ত প্লাটফর্মে মনের সুখ মিটিয়ে গালাগালি করার আফটারম্যাথ হিসেবে যখন পালটা গালি কিম্বা সুশীল যুক্তি হজম করতে পারিনা।
সৃষ্টিশীলতার নামে বিতর্কিত শিল্প নির্মান করতে গিয়ে যখন বাধার সম্মুখীন হই, তখন থেকে।
……………এবং ইত্যাদী নানাবিধ কারণে।
হিপোক্রেসির পারিবারিক সংস্করন -
“ফ্রিডম অব একপ্রেশন, সোশ্যাল মিডীয়া এন্ড ইন্টারনেট ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক ভয়েস আয়োজিত এক কর্মশালায় রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের সাংবাদিক সেলিম সামাদ বলছিলেন, “আমরা সবাই বাক স্বাধীনতার অধিকার আদায় নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আদতে আমরা কেউই বাক স্বাধীনতার প্র্যাকটিসে বিশ্বাস করিনা।” তিনি আমাদের বুকে হাত দিয়ে বলতে বললেন, আমরা কি আমাদের পরিবারের কর্তার কথার উপরে কথা বলার সাহস রাখি? তার কোন সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে কি আমরা প্রতিবাদ করতে পারি? ছোট ভাই বোন দের মতামতের মূল্য কি দেই আমরা, নাকি চাপিয়ে দেই নিজের সিদ্ধান্ত? কিম্বা বাসার কাজের মানুষটির একান্ত ইচ্ছাগুলোকে কি আমরা আমলে নেই? সে কি সেই স্বাধীনতাটুকু পায়, যা আমরা ভোগ করি? উত্তর, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই; না। নিজের ঘরে যেখানে বাক স্বাধীনতার প্রচলন নেই, সেখানে সমাযে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এই স্বাধীনতা?
সরষের ভেতর হিপোক্রেসি-
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের এক জরিপে দেখা গেল, আমাদের সংবাদপত্রে যেই ঘটনার খবর গুলো আমরা পড়ি, তার ৬০% ক্ষেত্রে ঘটনার পুরোপুরি সত্যটুকু প্রকাশ পায় না। খবরের পেছনে রয়ে যায় আসল খবর। এর কারন কি? সব সাংবাদিক খারাপ, ধান্দাবাজ - এই জন্য? না। কারন হোল, সত্য প্রকাশে ঝুকি এবং নিরাপত্তাহীণতা। আরো অসংখ্য খুনের মতো কোন সাংবাদিক হত্যার বিচারও আজ পর্যন্ত হয়নি। তাই, নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুকি নিয়ে ভয়ের সাথে বেচে থাকা কিম্বা কোনদিন খুন হয়ে যাবার অপেক্ষায় থাকার চাইতে কম্প্রোমাইজ করে নেয়াই বুদ্ধীমানের কাজ। ক্ষমতাশালীদের পেছনে; অন্ধকার ছায়ায় থাকা মেগা ক্ষমতাবানদের উপর আলোকপাত করার অপচেষ্টার চেয়ে জীবনের দাম অনেক বেশি। মনে রাখবেন, একটি দূর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না। তাহলে কেন আমরা সংবাদপত্রকে সরকারের বিবেক বলি? কেন বলি সত্যের জানালা? যখন দেখি একটি খবর একেক পত্রিকায় একেক রূপে প্রকাশিত হয় শুধুমাত্র ভিন্ন মতের দর্শনে?
হিপোক্রেসির উন্নত বিশ্ব সংস্করন-
আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বগুলো নাকি মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। ইনোসেন্স অফ মুসলিম নামক সর্বজনস্বীকৃত প্রপোগন্ডামূলক আবর্জনাটি এই কারনে তারা ইউটিউব থেকে সরিয়ে নিল না, অথচ ইসরাইল যখন ফিলিস্তীনিদের উপর নির্মমভাবে গণহত্যা চালিয়ে নির্বংশ করে দিচ্ছে কিম্বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিকা যখন মুসলিম বিশ্বে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে, তখন সিএনএন আর বিবিসি এই নৃশংসতাকে বৈধতা দিতে চালিয়ে যায় নির্লজ্জ মিথ্যাচার।
ভার্চুয়াল হিপোক্রেসি-
সুশীল নিক দিয়ে সুশীলগিরি এবং কুশীল নিক দিয়ে কুশীলগিরি, একমাত্র ব্লগেই সম্ভব। ছদ্মনামের আড়ালে থেকে এক নিক দিয়ে পিঠ চাপড়ানো আর এক নিক দিয়ে গালি দেয়া, ব্লগীয় হিপোক্রেসির সংস্কৃতি হয়ে দাড়িয়েছে। ভার্চুয়াল মুখোশের আড়ালে মুখ ঢেকে যা খুশী তাই বলে যাওয়া বাক স্বাধীনতা নয়। এ হচ্ছে বাক স্বেচ্ছাচারিতা।
হিপোক্রেসি পরম ধর্ম-
নাস্তিক শব্দটাই এখন গালি হয়ে দাড়িয়েছে কিছু নির্বোধ মুনাফেক নাস্তিকের কারনে। এরা নাস্তিকতার নামে শুধুমাত্র আক্রমন করে ইসলাম’কেই। গঠনমূলক, যুক্তিযুক্ত তর্ক এদের চালিত করে না, এরা চালিত হয় প্রবল ঘৃণাবোধ দ্বারা।
আর আছে ধর্মভারাক্রান্ত কিছু ধার্মিক নামের মুনাফেক। যারা স্রষ্টাকে খোঁজার চাইতে বেশি আগ্রহী স্রষ্টার অলৌকিকতা খুজতে। যারা ধর্মের অপমানের প্রতিশোধ নেয় ধর্মকেই অবমাননা করে। সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে যারা সমাজে তৈরী করে অস্থিতিশীলতা।
হিপোক্রেসির বৈধতা?
স্বাধীনভাবে কথা বলা যেমন মানবাধিকার, তেমনি বেশী স্বাধীনভাবে বেশী কথা বলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা খাওয়াও আমাদের রাজনৈতিক অধিকার। সেই সেমিনারে জানা আপু সাংবাদিক সেলিম সামাদ’কে প্রশ্ন করেছিলেন, আইন করা হয় কাদের জন্য? আইন প্রনেতাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য, নাকি সাধারন মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য? উলটো সেলিম সামাদ হাল্কা সুরে প্রশ্ন করেছিলেন, যেখানে অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা নিয়ে গঠিত কমিটীর নামই রেগুলেটরী কমিটী, যারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন নিয়ন্ত্রক হিসেবে, সেখানে আর বাকস্বাধীনতার অধিকার আসবে কোত্থেকে? অন্যমনস্ক শরত দিলেন আরো ভয়াবহ তথ্য। এই ডিজিটাল যুগে সব মানুষই কোন না কোন ভাবে নজরদারীর ভেতরে বসবাস করছে। ফেসবুক, মেইল, ব্লগ, জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল ফোন - যেখানে স্বেচ্ছায় সবাই ব্যাক্তিগত অনেক কিছু শেয়ার দিচ্ছে এবং যোগাযোগ বজায় রাখছে; সেখান থেকে কর্তৃপক্ষ যেকোন সময় যেকারো তথ্য নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারে এবং যেকারো অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে। তাহলে ব্যাক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা হোল কই?
আমরা বাংলা সিনেমার নায়ক নই। আমরা ভীতু। আমরা যেখানেই অন্যায় সেখানেই হাজির হয়ে গুন্ডাদের মেরে তক্তা বানাতে পারিনা চাইলেও। আমরা দূর থেকে প্রতিবাদ জানাই, অন্যায়কে ঘৃণা করি। আমাদের হাতিয়ার উন্মুক্ত মতপ্রকাশের প্লাটফর্ম - ফেসবুক, ব্লগ, ইউ টিউব, সংবাদপত্র। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নং ধারা স্পষ্টভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা নিশ্চিত করছে। কিন্তু এই প্লাটফর্মগুলোই যখন সুলেমানী ব্যান খাওয়ার হুমকীতে থাকে, যখন মতপ্রকাশকারীকে নির্যাতন করে তালাবন্ধ করে ফেলা হয়; তখন হিপোক্রেসিকেই মনে হয় - ইউনিভার্সাল ট্রুথ।
কৃতজ্ঞতাঃ আরজুপনি