এক জিগরী দোস্ত ড়াজু সেমি-ছ্যাকা খেয়েছে। তার গার্লফ্রেন্ড জেরিন ঝগড়ার একপর্যায়ে ফিচ ফিচ করে কাঁদতে কাঁদতে চিকন গলায় বলেছে, “তুমি দেখতে মহিষের মত কালাপাঁঠা (?) ; আবার মোছটাও রাখসো মুরগী মিলনের মত, চিঃ চিঃ…! ডাকু বীরাপ্পনের মত মোছ হইলেও চলত!...ঈঈই…তোমার মন মানষিকতাও ঠিক গন্ডারের এর মত! (এই উপমাটা আমরা ঠিক বুঝি নাই)!” তারপর গন্ডা খানেক হিক্কা তুলে বললো, “তুমি এমন জানলে আমি কখনোই তুমার সাথে ইইইইই ঈঈঈ……ফিচ ফিচ…ইঈইঈ…।” এত শক্তিশালী সব উপমার তোড়ে আমার বন্ধু উপমিত কর্মধারয় হয়ে গেল। অথচ সম্পর্কের শুরুতে এই মোচ নিয়ে জেরিনের আদিখ্যেতার শেষ ছিল না। একসাথে ট্রেনে ঢাকায় যাবার সময় তাদের আহলাদী আর আদেখলাপনায় তিতি বিরক্ত হয়ে মটকা মেরে কানে হেড ফোন দিয়ে ঘুমানোর ট্রাই করতাম। একদিন আমি নিজের হেডফোন ঢুকানো কানে শুনলাম, জেরিন গদ গদ গলায় ড়াজুকে বলছে, “এএই শোন, তোমার মুছুটা যে কী কিউট…আমার এত্ত ইয়ে লাগেএএ…! শোন, আমি না বিয়ের পর তোমার মুছুটা ধরে দোল খাব…(কিম্বা এইরকমই কিছু একটা)!” তার এহেন সাধের ও একদা জানপছন্দ মোচের সাথে মুরগী মিলনের তুলনায় আমার বন্ধু ড়াজ়ূ মনমরা হয়ে গেল। এমতাবস্থায় উহাকে অবসাদের পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে আমি আর আরেক জিগরী দোস্ত মাছু ব্রতী হইলাম।
শুরুতেই জগতের অনিত্যতা ও নারী জাতির ছলনায় দিন দুনিয়ার কত কীর্তিমান পুরুষ যে মাঝি বিহীন নৌকার মত একূল ওকুলে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ বয়ান দিলাম। তারপর ওর মন ভাল করতে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এলাম মধুবনে! লুল’রা লোল ফেলবেন না। এই মধুবন সেই মধুবন নহে। ইহা একটি রেস্তোরা। এখানে ঘরোয়া পরিবেশে শিক কাবাব, নান, চা খাওয়া যায় আর ধুমায়া বিড়ি টানা যায়। উদরপূর্তির পর আমরা প্রিয় বন্ধু ড়াজ়ূর কাধে হাত রেখে অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে বললাম, জানিস; মনীষিরা মন খারাপ হলে কি করতেন? উদার হাতে টাকা খরচ করতেন আর কাছের বন্ধুদের খাওয়াতেন। আক্কেলমান কো লিয়ে ইশারাই কাফি। আর আমাদের বন্ধু মাশাল্লাহ, অনেক আক্কেলমান।
এরপরেই কাহিনী শুরু…
চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী চানপুইরা মাছু তার নোয়াখাইল্যা ভাইদের স্মরণার্থে খাওয়া দাওয়ার পরেই চামে বাসায় চলে গেল। আমি আর ড়াজু অনিশ্চিত গন্তব্যে উদাসী হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাকতালীয়ভাবে আমার বাসার সামনে চলে এলাম। চলমান বিষন্নতার হাত থেকে আসন্ন মুক্তির সম্ভাবনায় গাঢ় গলায় ড়াজুকে “আয় দোস্ত, বুকে আয়…তোর দুঃখে আমার বুকটা ফাইট্যা যাইতাসে” বলে বুকে জড়িয়ে ধরতেই পাশে এসে ঘ্যাচ করে থামলো এক পুলিশের গাড়ি। কানে এল নাকি গলায় কে যেন বলছে, “এই…তোরা এই গভীর রাইতে (রাত ১১ টা) দুইটায় মিল্যা জাবড়া জাবড়ি করতাসস কেন রে ?? বাংলা টানসস; না? অই, উঠা গাড়িতে।” তাকিয়ে দেখি শুকনা চিমসা খাওয়া এক ওসি মিশা সওদাওগরের মত লুক দিয়ে আছে। বাংলা সিনেমার আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না ভঙ্গিতে গুটগুট করে দুটি কনস্টেবল হাজির হোল। আমি আম্মাআআ বলে চিতকারের উদ্দেশ্যে মুখ আ করতেই নাকি গলা বলে উঠল, অই! অই!! আমরা এক লাফে গাড়ীতে উঠে পড়লাম। চলতি পথে গাড়িটা লোকাল বাসের মত জায়গায় জায়গায় স্টপেজ দিল আর ওসি আর কনস্টেবল হাক ডাক করে লোক তুললো। যাত্রী বেশিরভাগই আমাদের বয়সী পুলাপান। একটু পর আমরা থানায় নেমে গেলাম কোন ভাড়া না দিয়েই।
লাইন দিয়ে দাড় করান হলো সবাইকে, প্রায় ১৫/১৬ জন হবে। নাকি গলা আর তার দুই স্যাঙ্গাত হাতে বাশের মত মোটা এক লাঠি নিয়ে কুশল বিনিময় আর আপ্যায়ন শুরু করলো। অত্যন্ত “বিণীত ভাবে” জিজ্ঞেস করলো থানায় আগমনের হেতু! একজন বিগলিত হেসে উত্তর দিল,“স্যার, আমি তো স্যার নিজের ইচ্ছায় স্যার আসি নাই স্যার, আমাকে স্যার নিয়া আসা হইসে স্যার।“ নাকি গলা নাকি গলায় গর্জন করলো, “কোন, **র পুত নিয়া আসছে তোরে?” তারপর সে কি বাড়ি...! এবং বাড়ির পর তাকে ইনপুট করে দেয়া হোল হাজতে। পরের সিরিয়াল এক সিরিয়াস পাঙ্কু’র। হাতে চূড়ী, পায়ে চূড়ীদার জিন্স, কানে দুল আর বিরাট বড় বড় চুল! তিন ব্যাকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ওসি এসে দাড়াতেই সোজা ওসির বুটের ওপর, “স্যার আর জীবনেও খামু না, কসম স্যার, জীবনেও খামু না।“ ওসি তাজ্জব, “কি খাবি না?” পাঙ্কু ডাবল তাজ্জব, “কি খামু না?!!” কনস্টেবল দুইজন সার্চ করে পাঙ্কুর চিপা জিন্স থেকে আবিস্কার করল; গাঁজার পোটলা আর রেডীমেড স্টিক। আক্ষরিক অর্থেই পশ্চাদদেশ থেকে ধূলো উড়িয়ে গেডী ধরে চালান করে দেয়া হল হাজতে। এভাবে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, স্মার্ট, আনস্মার্ট, ধনী, গরীব, সাদা, কালো ইত্যাদি বিনা পক্ষপাতে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়িত করে লাঠির বাড়ি দিয়ে সিল লাগিয়ে হাজতের ভিসা ধরিয়ে দেয়া হতে লাগলো। আমাদের পালা এগিয়ে আসতে থাকলো। আমি মনে মনে “আম্মুর কাছে যাবোওও” বলে দুই হাত দিয়ে চোখ ডলতে লাগলাম। ড়াজুর কাল মুখ ফর্সা হয়ে গেছে আতঙ্কে। গার্লফ্রেন্ড চলে যাবার দু;খ সে ভুলেছে কবে...!
বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, নাকি গলার ওসি আমার সামনে এসে ভদ্র ভাবে জিজ্ঞেস করল, “কি সমস্যা?”, আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম।
আবার জিজ্ঞাসিত হলাম,
: কি পড়?
: ইন্টার পাস করসি, সামনে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা দিব।
: হুম...(চিন্তিত ভঙ্গীতে), আচ্ছা, বল দেখি, “বন্ধু বিহনে কেউ সুখী হতে পারে না” – ইংলিশ কি?
: আমি কিছুটা ভড়কে গিয়ে উত্তর দিলাম, “None can be happy without friend.”!
: (হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে)...হইলো না। none কোন word হইলো? আসল উত্তর হইল – no man is happy with no friend!! বুজলা কিসু?
: (আমি মাথা নাড়ি)...জ্বী স্যার। ভয় পাইয়া মিসটেক কইরা ফেলসি। আসলে থানাতে আগে কখনো আসি নাই তো!!
: হুম...যাও, হাজতে ঢুইক্যা পড়।
সিল ছাড়া ভিসা পাওয়াতে আমি ওসির প্রতি কৃতজ্ঞতায় প্রায় নুয়ে পড়লাম।
স্যান্ডেল খুলে পবিত্র হাজত ভূমিতে প্রবেশ করেছি। মানিব্যাগ জমা দিয়েছি কনস্টেবলের কাছে। আফসোস, কয়টাকা ছিল গুনতে পারি নাই। প্রায় ২০/২৫ জন হাজতবাসীতে গিজগিজ করছে ১৫ ফুট X ১০ ফুট ঘরটি। লাগোয়া ছোট্ট একটি টয়লেট, যার দরজা নিখোঁজ এবং কমোড হাউসফুল হয়ে পুরোপুরি টয়লেটফুল। বিকট সুগন্ধে হাজত মৌ মৌ করছে। যার প্রয়োজন পড়ছে; সে আর টয়লেটে যাবার কষ্টটুকু স্বীকার করছে না। ভদ্রতা করে টয়লেটের দিকে হালকা ইঙ্গিত করে হালকা হয়ে যাচ্ছে। পুরাতন অধিবাসীরা নতুনদের স্থান ছেড়ে দেবার কোন লক্ষন না দেখানোয় আমরা একপাশে লোহার গ্রীলের সাথে গাল লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর পদার্পন ঘটলো কমরেড ড়াজু’র। সিল দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে সে ফের উদাস হয়ে গেল।
রাত ১২.৩০টা। আমরা এতিমের মত বসে আছি এক কোনায়। খেয়াল করলাম, এক মুরুব্বিকে। সাদা,লম্বা দাড়ি। সুফি ভাব প্রবল। পাশে কয়েকজন সেবায়েত’ও আছে দেখলাম। মুরুব্বি বিড়ি’র ধোয়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হঠাত দেখি হাত বাড়িয়ে ডাকছেন, এগিয়ে গেলাম, হাতের বিড়ি এগিয়ে দিলেন, না করলাম, কোমরের কোঁচর থেকে বের করলেন দুটি গোল্ডলীফ, এবার না করলাম না। পরে জানলাম, উনি একজন অবসরপ্রাপ্ত খুনী। হাজতের নিয়মিত ক্লায়েন্ট। থানা হাজত, কারাগার, জামিন ফের হাজত- এভাবেই জীবনের অনেকাংশ কাটিয়ে তিনি আজ অত্র এলাকার একজন সম্মানিত মুরুব্বি।
বাসায় সবাই আমার চিন্তায় অস্থির ভেবে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। ছোট্ট এই নোংরা ঘরে বিনা কারণে আর বিনা দোষে আমাকে আটকে রেখেছে; আমি বন্দী- ভাবনাটা মাঝে মাঝেই বিদ্রোহী করে তুলছে মনটাকে। একটা অব্যাক্ত ক্রোধ অস্ফুট রয়ে যাচ্ছে, আর অসহায়বোধটা রূপান্তরিত হচ্ছে বিষাদে। মাঝে মাঝে উকি দেয় কিছু মানুষ; তারা হাজতীদের দিকে তাকিয়ে মজা দেখতে থাকে; ঠিক যেমন আমরা চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার দিকে তাকিয়ে মজা নেই আর কিছু সরস মন্তব্য ছুড়ে দেই। আমি মাথা নিচু করে রাখি লজ্জায় আর অচেনা এক রাগে।
পুরো থানা খালি, কে কই কে জানে? হঠাত কোথেকে নাযিল হলো এক সাংবাদিক। হাতে বিশাল ক্যামেরা, কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ। আমি আর ড়াজু মনে মনে প্রমাদ গুনি (আসলে প্রমাদ কিভাবে গুনে আমরা জানি না)। দুর্ভাগ্যের 16 Banana Fillup. এখন ছবি তুলে পরদিন পত্রিকায় ছাপা হয়ে যাবে আমাদের হাসি হাসি মুখের ছবি; ব্যাস আমরা সেলিব্রেটি কিম্বা কারা নির্যাতিত নেতা হয়ে যাব!! সাম্বাদিক আমার চশমা পড়া সুশীল টাইপ চেহারা দেখে আকৃষ্ট হলেন। আমি খড়কুটো ভেবে সাংবাদিক ধরে বাঁচতে চাইলাম। উনি আমাদের ঠিকুজি কুলুজি জেনে বড়ই প্রীত হলেন এবং প্রাণখোলা হাসি হেসে বললেন, “পুলিশ দেহি আইজকাল শিক্ষিত পুলাপানেরও গু...সরি...সরি...পা* মেরে হাজতে ভরে দেয়। বাহ, বাহ!” কথ্য ভাষা ব্যবহার না করে উনি আমাদের সম্মান করলেন!! উনি আমাদের বাসার নাম্বার নিলেন, তারপর ওসি সাহেবকে অনুরোধ করলেন যার যার বাসায় আমাদের সৌভাগ্যের কথা জানিয়ে দিতে।
চিমসা বডি আর নাকি গলার ওসি সাহেব। প্রতি ৫ মিনিট অন্তর একটি বেনসন ধরাচ্ছেন আর কোম্পানীতে আগুন লাগার আগেই ফেলে দিচ্ছেন। বিরাট সৌখিন লোক। তিনি বাসায় দয়া করে ফোন দিলেন (একসময় তিনি দিতেনই)।
: হ্যালো...রুমীদের বাসা? আপনি কে? কি করেন? কেন করেন? হুম...রুমীর কি হন? হুম...রুমী আপনার কি হয়? হুম...আচ্ছা।...(হঠাত বিগলিত হয়ে)...হ্যা হ্যা...কোন চিন্তা করবেন না...রুমী ভালো আছে, নিরাপদে আছে।
: কোথায়??
: হাজতে।
(আলহামদুলিল্লাহ, আমার বাসার কেউ হার্ট এটাক করে নাই।)
রাত ৩টা। হাজতে গ্রীলের ওপাশে আমার বন্ধু শেখু’র বাবা; সাথে আমার বড় দুই খালাত ভাই। আমার হাতে হাত রেখে কাকা বললেন, “চিন্তা কোরনা, বাসায় সবাই ভাল আছে, একটু পরই তোমাকে নিয়ে বাসায় যাব।” আমার চোখে পানি চলে এল। ভাইয়ারা কি সিস্টেম করলেন ওসির সাথে আর কিভাবেই বা করলেন তা আর বিস্তারিত নাই বা বললাম। শুধু বিদায় নেয়ার সময় ৩২ দাঁত বের করে ওসি আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “আবার এসো...”! আমার পিলে চমকে গেল!!
ড়াজুর কি হোল?...পাইতাল মার্কা বড় ভাইকে ফোন দেয়ার পর সে উলটা ওসির সাথে এমন ফাঁপর নিয়েছিল যে, ওসি ড়াজুকে শাষিয়ে বলেছিল, “তুই শালা কিভাবে বের হোস, দেখে নিব...।” সেমি ছ্যাঁকা খাওয়া ড়াজু ফুল ছ্যাঁকা খেয়ে হাজত ছেড়ে ছিল পরদিন রাতে!!
আমার বাবা আর আমার বন্ধু সেই মাছু; কিভাবে পাগলের মত চেনা অচেনা সব মানুষের কাছে ধরনা দিয়েছে আর জায়গায় বেজায়গায় (থানা বাদে) সার্চ করে বেড়িয়েছে আমাদের খোঁজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই সংগ্রামের গল্প হয়তো বলবো আরেকদিন। তারা কিভাবে জানবে, এই অতি ভদ্র, বই পড়ুয়া, গোবেচারা, নাদান ছেলেটি পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে হাজতবাসী হবে?