রাতের খাবার খেতে বসেছে মীনা রাজু আর তাদের পরিবার । মীনা-রাজুর মা সবার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন । আজকের খাবারের মেনু হচ্ছে সবুজ শাক সবজি, ডিম, ডাল আর গরুর মাংস ভুনা । তবে খাদ্যবন্টন করতে গিয়ে তিনি সামান্য লিঙ্গ বৈষম্য করে ফেললেন । রাজুর পাতে দিলেন বেশী আর মীনার পাতে কম ।
তাই দেখে মীনা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে উঠলো ‘আমারে কম দিলা ক্যান ? আমি কি অপরাধ করছি ?’
মীনার মা তারচেয়ে জোরে জবাব দিলেন ‘তুমি কি করছ মানে? ঘরে তরকারী যাই আসে তার অর্ধেক তুমি চুলে আর মুখে ঘষাঘষি করো । তাই এইডা তোমার শাস্তি ।’
রাজু আরেক কাঠি সরেস হয়ে বলল ‘আহাহাহা , তোমার কি আর ঘরে খাওনের দরকার আছে ? তোমারে বাইরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়ানের মানুষের তো অভাব নাই...’
তবে মীনা সহজে দমবার পাত্রি না । সে খেতে খেতে হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকাদের মত ফুসফুস করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতে লাগলো ‘ এই দেশে মাইয়াগো কোন অধিকার নাই, আমাদের কেউ পাত্তা দেয়না , খাবারও দেয়না । বাইচা থাইকা কি লাভ ? মাইয়া হইয়া জন্মাইছি বইলা আইজ এই অবস্থা , ঘরে একটা ধামরী পোলা , কোন কাজ কাম করেনা , সারাদিন ঘুমায় সেই খাবার পায় বেশী ।‘
এটুকু শুনতেই রাজু চিৎকার দিয়ে জবাব দিল ‘কি কইলা তুমি ? আমি ঘরের কোন কাম করিনা ?’
মীনা বলল ‘ হ, ঠিকিই কইছি , সারাদিন খাস-দাস আর ঘুমাস , পারলে একটা দিন আমার কাম কইরা দেখ কত কষ্ট’
রাজু ততক্ষনাত প্রস্তাব লুফে নিল । বলল ‘আইচ্ছা কাইল তো কলেজ বন্ধ , আসো কাইল্কা আমরা দায়িত্ব পরিবর্তন করি । তুমি সারাদিন আমার কাজ করবা আর আমি তোমার কাজ করুম ।
মিনা এক সেকেন্ডও দেরী না করে রাজী হয়ে গেল আর পাশে থাকা টিয়া পাখী মিঠু উচ্চস্বরে বলে উঠলো ‘ওরে এত কথা বলেরে, শান্তিতে একটু খেতেও দিলনা’
(পরেরদিন)
সময় সকাল ৮.৩০
মাঃ ওই রাজু , রাজু । ঘরে আটা-ময়দা কিচ্ছু নাই, নাস্তা করবি কি দিয়া ? যা আটা নিয়া আয় । সাথে চা পাতা , চিনি , ডিম আর তেল লাগবো ।
রাজুঃ আমি পারুম না মা , আইজকে আমরা দায়িত্ব পরিবর্তন করছি । আমার কাজ মীনা করবো আর মীনার কাজ আমি ।
বাধ্য হয়ে মীনা দোকানে গেল আটা-ময়দা কিনতে । টুকটাক বাজার করতে করতে মিনা ভাবল ব্যাপারটা খারাপ না , বাজার থেকে সরানো টাকাগুলো মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করা যায় । আর এদিকে রাজু আরেকটু আরাম করে ঘুমিয়ে নিল... ভাবছেন চুলা ধরানো , ঘর ঝারু দেওয়া , মুরগিরে খাওন দেওয়া এগুলা কে করল ? আরে , মাস শেষে কাজের মহিলারে কি এমনি এমনি বেতন দেওয়া হয় ?
রাজুর কার্যকলাপ (সকাল ১০ টা- সন্ধ্যা ৬টা )
সকালে রাজু পাশের বাসার রহিমের মায়ের সাথে গল্প করতে গেল । এই সময়টাতে মীনা সাধারনত হবিজাবি গল্প করতে প্রতিবেশিদের বাসায় গিয়ে বসে থাকে । তারপর একটার দিকে বাসায় ফিরলো । এমনিদিন দুপুরে খাওয়ার পর মীনা বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে তার বয়ফ্রেন্ড দিপুর সাথে দীর্ঘক্ষণ ফোনে আলাপ করে । ফালতু টাইপের আলাপ । এই যেমন ‘কি খাইলা, কি করলা ? কেমনে খাইলা? কোন হাত দিয়া খাইলা? ’ এই টাইপের কথা বার্তা । রাজুর তো আর গারলফ্রেন্ড নাই , তাই সে তার বন্ধু কুদ্দুসরে ফোন দিয়া আলাপ শুরু করলো কি খাইলা, কি করলা ? কেমনে খাইলা’ কুদ্দুস বিরক্ত হয়ে বললো ‘খা****** (গালি) তোর খাওয়ার *****, তোরে ******* ।‘ এরপরে তো আর প্রেমালাপ যায়না । তাই রাজু সুন্দর করে লাইনটা কেটে দিল ।
মীনার কার্যকলাপ (সকাল ১০ টা- সন্ধ্যা ৬ টা )
সকালে নাস্তা খাওয়ার পর রাজু গলির মোরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে । রাস্তায় যে সকল মেয়ে যাওয়া আসা করে তাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । মীনা তাই রাজুর মত করে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে রাস্তায় দুচারটা ছেলেকে ইভটিজিং করলো । মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনে লুকিয়ে একটা সিগারেট খেল । দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচের কিছু অংশ দেখল । খাওয়ার পর ‘একটু আসি’ বলে আবার জানি কোথায় বের হয়ে গেল । বাসায় ফিরল সন্ধ্যার পর ।
সন্ধ্যার পর
সন্ধার পরে রাজু সবার জন্য চা বানালো । আর মীনা পড়তে বসল । এখন রাজুকে একটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে । মীনার মত করে এখন তাকে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে হবে । রাজু দাত কিরমির করে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে বসল । আর মীনা পড়ার টেবিলে বসে পড়ার ভান করে মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে চার পাঁচটা ছেলেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালো । দু তিন জনের ছবিতে সুন্দর সুন্দর লাইক-কমেন্ট দিল (রাজু ফেসবুকে মেয়েদের সাথে যা করে আরকি) ।
এদিকে ঘন্টাখানেক হিন্দি সিরিয়াল দেখার পর রাজু নিজেরে আর ঠিক রাখতে পারলনা । এসে মীনার পায়ে ধরে বললো ‘আমারে তুমি মাফ কইরে দ্যাও বইন । আইজ থাইকা আমার পাতের খাবারও তোমার ... তাও তুমি আমারে এই শাস্তি দিওনা ।’ মীনা মুচকি হেসে বললো ‘দেখলাতো রাজু আমরা সারাদিনে কত্ত কষ্ট করি । আগে আগে মাফ চাইয়া ভালই করছো, নয়টার সময়ে আবার ‘কিউকি সাস ভি কাভি বহু থি’ দিব আর আমি লাইভ টেলিকাস্ট দেখতে পারুম না ভাইবা চউক্ষে পানি চলিয়া আসছিলো ।‘ রাজু চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো ‘যাও ভইন যাও , গিয়া টিভি দেখ’ মীনা বললো ‘এইতো ভাইয়ের মত ভাই’
মিনার সাথে বসে মিঠুকেও এইসব সিরিয়াল দেখতে হয় বলে মিঠু মন খারাপের সুরে বিড়বিড় করে বলল ‘ঠাটা পড়া কপাল আমার , একটুও শান্তি নাই’
অতঃপর ব্যাকগ্রাউন্ডে গান শুরু হল ‘আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে... আমি বড় হই সকলের...’
যাবতীয় সমালোচনার দাবীদারঃ
নাসিফ চৌধুরী
[email protected]