পত্রিকার পাঠ চুকিয়ে ফেসবুকে একবার ঢু মারা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস । মার্ক জুকারবারগের ‘ফেসবুক’ এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে আমাদের মাঝে । পৃথিবীর গন্ডি পেরিয়ে ফেসবুক এখন ঝড় তুলেছে দূর ভিনগ্রহবাসীদের মাঝেও । এখনকার ফেসবুক অবশ্য আগেরমত নেই । ফেসবুক দিয়ে এখন 'অনেক কিছু' করা যায় । সে কারনে জন্মহার নিয়ন্ত্রনের জন্য বড় বড় বিলবোর্ডে লেখা থাকে ‘ফেসবুক কম ব্যবহার করুন’-প্রচারে বাংলাদেশ সরকার । ছেলে-মেয়েদের চোখে চোখে রাখতেই আজকাল অভিভাবকদের নাভিশ্বাস ।
এক সকালে ফেসবুকে ঢু মারতেই দেখি ‘ডেল্টা-7’ গ্রহ থেকে কুৎসিত প্রোফাইল পিকচারওয়ালা একটা ভিনগ্রহবাসী আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে । নাম ‘কিক্রি’ । অদ্ভুত এবং জঘন্য নাম । প্রোফাইল পিকচার দেখে এখনো বুঝা যাচ্ছেনা এই চিজ ছেলে না মেয়ে । অবশ্য, ছেলে মেয়ে বলতে আদৌ কোনকিছু তাদের সমাজে আছে আছে কিনা সে ব্যাপারে আমার জানা নেই ।
আমি কিক্রির রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলাম । তার ইনফো থেকে জানতে পারলাম সে ‘f1’ লিঙ্গের অধিকারী । ‘f1 রেসের’ কথা শুনেছি কিন্তু f1 লিঙ্গের কথা এই প্রথম শুনলাম । গুগল মামার কাছে বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলাম । গুগল মামা আমাকে সংক্ষেপে জানালেন ‘ডেল্টা-7’ গ্রহের বাসিন্দারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন । ছেলেদের জন কোড m আর মেয়েদের জন্য f । যে সকল মেয়েরা এখনো কুমারি, এখনো বিয়ে হয়নি তাদের কোড f1 , যাদের বিয়ে হয়ে গেছে তারা f2 । f3 মানে যাদের বিয়ে হয়নি কিন্তু... থাক ঐ বিষয়গুলো এখন না জানলেও চলবে ।
পৃথিবীর নারীরা আমাকে ভুলেও কখনো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়নি । এই গ্রহের নিষ্ঠুর মেয়েরা চিনতে না পারলেও দূর গ্রহের মেয়ে পেরেছে । তাই হটাত করেই কিক্রির নাম আর প্রোফাইল পিকচার আমার কাছে ভয়ংকর সুন্দর মনে হলো।
২.
পৃথিবীর সার্বজনীন ভাষা যেমন ‘ইংরেজি’ তেমনি মহাবিশ্বের সার্বজনীন ভাষা হচ্ছে ‘কিংরেজি’ । এই ভাষা ব্যবহার করে মহাবিশ্বের যে কোন গ্রহের প্রাণীদের সাথে ভাব বিনিময় করা যায় । কিংরেজি ভাষায় চ্যাট করতে করতে দুএক দিনের ভেতরেই কিক্রির সাথে আমার ভাব জমে গেল ।
চ্যাটবক্সে কিক্রিকে পটাবার জন্য আমি সেই চিরায়ত পদ্ধতি ব্যবহার করলাম । পাঠকদের সুবিধার জন্য চ্যাটবক্সের সেই গোপন কথা গুলো হুবুহু তুলে দিলাম ।
আমিঃ হ্যালো কিক্রি , কেমন আছো ।
কিক্রিঃ আমি ভাল , আপনি ?
আমিঃ : খুব ভাল , তোমার চুল অনেক সুন্দর ।
কিক্রিঃ LOL
আমিঃ তোমার চোখ খুব সুন্দর...
কিক্রিঃ LOVL (laughing out VERY loud)
আমিঃ তোমার ঠোঁট খুব সুন্দর ।
কিক্রিঃ lotml (laughing out Too much loud) এর পর আপনি কি বলবেন আমি জানি...
আমিঃ তাই নাকি ? তোমার বু (এন্টার বাটনে প্রেস পড়ে গেল)
অশ্লীল কোন ইঙ্গিত ভেবে কিক্রিও সাথে সাথে অফলাইন হয়ে গেল...
আমি সাথে সাথে কিক্রির ইনবক্সে ম্যাসেজ দিলাম- ‘তোমার বুদ্ধি ভাল’ আমি এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম...’
আমার স্মার্টনেসে কিক্রি খুব দ্রুত পটে গেল । বুঝতে পারলাম মনের ব্যাপারে ভিনগ্রহবাসীরা এই গ্রহের নারীদের চাইতে অনেক উদার । পৃথিবীর নারীদের এখন চাঁদ এনে দেওয়ার কথা বললেই হয়না । তারা এখন উপহার হিসেবে আস্ত চাঁদই দাবী করে বসে ।
কিক্রির প্রেমে পড়ে আমি সারাক্ষন মুচকি মুচকি হাসতাম । গুনগুন করে গান গাইতাম ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো ভিনগ্রহবাসিনী...’। আমার ঘরের কাজের রোবটটাও আমার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসতো, এ যুগের রোবটগুলো অনেক বুদ্ধিমান । আমার নতুন প্রনয়ের ব্যাপারটা হয়তো সে খুব সহজেই ধরে ফেলেছে । তাছাড়া সেও ইদানিং আমার মতো সারাদিন ফেসবুকে বসে থাকে, হয়তো নতুন কোন প্রেমিকা খুঁজে পেয়েছে ।
কাজের মানুষ হিসেবে আমার এই রোবটটা খুবি ভাল। ঘর পরিষ্কার করা থেকে রান্নাবান্না সবক্ষেত্রেই তার জুড়ি মেলা ভার । এমন রোবট পাওয়া আজকাল ভাগ্যের ব্যাপার । দীর্ঘদিন ধরে সে একা একা বাস করছে । সিদ্ধান্ত নিলাম আমার একটা ‘গতি’ হয়ে যাওয়ার পরপরি রোবটের একটা বিয়ের ব্যবস্থা করে দেব ।
মনে মনে আমার ইচ্ছে ছিল বিয়ে না করেই যদি কিক্রির সাথে ‘একটা ব্যবস্থা’ হয়ে যায় তাহলে কি দরকার খামাকা টাকা পয়সা খরচ করার ? কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কিক্রি এই বিষয়ে মোটেও রাজি হলনা । বুঝতে পারলাম , মেয়ে হিসেবে সে ১০০ তে ৯৯ পাওয়ার যোগ্য । শেষমেশ আমি কিক্রিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম । কিক্রি রাজী হল । আমরা নিজেরাই নিজেদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেললাম । সিদ্ধান্ত হল বরযাত্রা নিয়ে আমি ‘ডেল্টা-7’ গ্রহে যাবো । সেখানেই ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হবে ।
বিয়ে উপলক্ষে আমি শপিঙে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম । দামী কার্ড ছাপিয়ে আত্নিয়-স্বজনদেরকে বিয়ের দাওয়াত দিতে থাকলাম । মনে মনে বিবাহ পরবর্তী সংসার জীবন নিয়ে বেশকিছু পরিকল্পনাও করে ফেললাম । যেমন, আমরা বেশি ঝগড়াঝাটি করবোনা । কারন বৌ যদি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যায় তাহলে দূর গ্রহ থেকে তার রাগ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে আসতে যাতায়াত খরচ বাবদ আমার মোটা অংকের টাকা খরচ হয়ে যাবে । তাই কিক্রিকে সর্বদা খুশী রাখাই থাকবে আমার বিবাহিত জীবনের প্রধান লক্ষ । পৃথিবীর সকল সুখী পুরুষরাই অবশ্য এই নীতি অনুসরন করেন ।
৩.
বিয়ের তিনদিন আগে ‘কমলাপুর মহাকাশ স্টেশনে’ ২ ঘন্টা লাইনে দাড়িয়ে আমি ‘ডেল্টা-7’ গ্রহে যাওয়ার আন্তঃগ্রহ রকেটের টিকেট করে ফেললাম । টিকেটের জন্য আমাকে মোটা অংকের ঘুষও দিতে হল । টিকিট প্রাপ্তির খবরটা আমার হবু স্ত্রী কিক্রিকে জানাতে গিয়ে দেখি আমার সুপার কম্পিউটারটা নষ্ট হয়ে গেছে । উপায় না দেখে আমি কাজের রোবটের ল্যাপটপটা চালু করলাম । রোবটটা তখন বিশেষ কোন কাজে ঘরের বাইরে ছিল ।
সেই ল্যাপটপ দিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই আমার আক্কেলগুরুম । আমার হবু স্ত্রী কিক্রির একাউন্ট সেই ল্যাপটপ থেকে লগ ইন করা ! মুহুরতেই কিক্রির আসল পরিচয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল । কিক্রির ভুয়া ফেসবুক একাউন্ট বানিয়ে ফাজিল রোবট এতদিন আমার সাথে ইয়ার্কি মেরেছে । আমার দিকে তাকিয়ে ফাজিলের মুচকি মুচকি হাসার কারণটাও ততক্ষনে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি রাগে কাঁপতে লাগলাম । দিনের পর দিন ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে আমি এই বদমাইশটাকে পুষেছি ? মানুষের ধোঁকা সহ্য করা যায় কিন্তু মানুষের তৈরি যন্ত্রের ধোঁকা কখনও সহ্য করা যায়না ।
ফাজিল রোবটের কপাল খুবই খারাপ ছিল । আমার রাগ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনি সে ঘরে প্রবেশ করলো । আমি আর নিজেক ধরে রাখতে পারলাম না । ষ্টীলের হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলাম । শরীরের প্রতিটা অংশকে গুরা গুরা করে দিলাম । এমন অবস্থার পর রজনীকান্তের রোবটেরও কামব্যাক করা মুশকিল ।
পরদিন আমি নিজেই খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে এলাম । একটা পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘কাজের রোবটকে নির্মম ভাবে হত্যা করলেন গৃহকর্তা ।’
আর রগরগে খবরের কাগজ গুলো শিরোনাম করলো এভাবে ‘রোবটের উপর জোর করে পাশবিকতা চালিয়ে হত্যা করল এক পাষন্ড যুবক।’
বিচিত্র এ দেশ সত্যিই সেলুকাস !!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:০৬