আপনাকেই বলছি।
আমরা ভাবছিলাম ঠিক এমন একটা বিজ্ঞাপন দেবো-
উন্নতি বলতে যদি অধিক হাটা এবং অধিক বলা - এ বিশ্বাস আপনার থাকে তাহলে আপনি এগিয়ে আসতে পারেন । কন্ঠ? গমগমে হলে ভালো, মিনমিনে হলে অবিরাম বলার অভ্যাস থাকতে হবে। কান তীব্র এবং সংবেদনশীল হওয়া চাই। একটা কিছু শুনামাত্র দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরবর্তী দায়িত্ব কি হবে। শরীরের সৌন্দির্য নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। প্রকৃতি প্রাপ্ত স্বাভাবিক গঠনই যথেষ্ঠ। মুখের ত্বক সহজে ঘেমে উঠলে সঙ্গে একটা রুমাল রাখবেন। আলাপি হওয়া অন্যের দৃষ্টিতে মন্দ হলেও, কেউ বাচাল বলে গালি দিলেও এক্ষেত্রে আলাপি হওয়ার সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অপনার জ্ঞান থাকবে বহু বিষয়ে। তবে গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সামান্য কার্পাস তুলা থেকে কাপড় বুনুন পর্যন্ত যে সব জটিল স্তর অতিক্রম করতে হয় আপনাকে এর সবটা জানার দরকার নেই। যদিও এটা উদাহরনের জন্য বলা। তবে আপনাকে কথা বলতে হবে এমন কৌশলে যেনো শোনামাত্র শ্রোতা মনে করবে আপনি ঐ বিষয়ে যথেষ্ট জানেন। বলতে পারেন একধরনের চাতুরী । চাতুরী শুনে হীনমন্যতায় ডুবে যাওয়ার কোন কারণ নেই। আপনি ল্য করবেন পণ্য বিক্রির কৌশল মানেই একটু চাতুরী। বাঁচতে হলে চতুর হতে হবে এটা দোষের কিছু নয়। আপনি কিন্তু কাউকে ঠকাচ্ছেন না। জনগণের পকেটের টাকা নামাতে হলে তাদের হাতে একটা কিছু তুলে দিতে হয় । তবে জনগণ সহজে একটা কিছু নিতে চায় না। তাকে ভুলাতে হয় , ডুবাতে হয়। ভুলতে ডুবতে জনগণ পছন্দ করে। ভুলানো এবং ডুবানোর কাজটায় সামান্য যুক্তি থাকলে তো কথাই নেই।
আপনি সরাসরি চলে যাবেন । একাই যাবেন। কুমিল্লা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে, ট্রেনের যাত্রাপথটা বেশ সুন্দর। ফকির হাট- রাজাপুর- শশীদল- গঙ্গা সাগর- মন্দবাগ- আখাউড়া- ব্রাহ্মণ বাড়িয়া- ঘোড়াশাল তারপরই ভৈরব। আপাকে ভৈরবই যেতে হবে। সেখানে একজন আপনার জন্য অপো করছে। সে এ লাইনে আপনার চেয়ে পোড় খাওয়া। তবে আমরা ধরে নিয়েছি আপনি সমস্যাটা সমাধান করতে পারবেন। যা হোক, যেখানের সমস্যা সেখানে গিয়ে ভাবা যাবে। এখন আপনি ভাবছেন , গঙ্গা সাগরে গঙ্গাও নেই সাগরও নেই, মন্দবাগে কি মৃধুমন্দ বাতাস বহে? শশীদলের (রেল লাইনের) পাশে একটা এলাকার নাম তেতাভূমি, এতো কাছাকাছি স্নিগ্ধ আর উষ্ণের এমন সহ অবস্থান! আখাউড়ায় কল্লা শহীদের মাজার, শাহজালালের সহগামীরা সারা পুর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ লক্ষ্য করবেন ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নিয়াজ কলেজের টার্নিংটায় (প্রায় আশি নব্বই ডিগ্রি কোনে বাঁক) রেলের অনেক যাত্রী উত্তর পশ্চিম দিকে মুখ করে সমস্ত রেলটা দেখে নিচ্ছে। সামনে লেভেল ক্রসিং হওয়াতে দুলে দুলে রেলটা যাচ্ছে আর আপনারও তখন ধৈর্যটা কমে আসছে। কখন ভৈরব পৌঁছবেন সেই চিন্তায় আপনি বিভোর। অথবা ধৈর্য উবে যাওয়ার ব্যাপারটা মন্দবাগ অথবা গঙ্গা সাগরের আগেই ঘটেতে পারে। নতুন চাকরি তো, অন্তরগত চাপটা ফুলে ওটা তেলের পিঠা বা ভাপা পিঠার মতই আপনাকে বুক বরাবর অথবা মাথার নিউরন সেলে একধরনের উত্তেজনা তৈরি করবে । আপনি নিজের অজান্তে দীর্ঘ নিঃশ্বাসগুলেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে ফেলবেন। ফলে আপনি ঘামতে থাকবেন। আবার হঠাৎ করেই আপনি ল্য করে দেখবেন, ব্রাহ্মণ বাড়িয়ার কাজী পাড়ার স্বপন অথবা আব্বাস অথবা মহিম অথবা তাদের বন্ধুদের যে কোন একজন (যে এক সময় আপনারও বন্ধু ছিল) আপনাকে দেখে কথা বলার জন্য উসখুস করছে । এই অবস্থায় আপনিও কথা না বলে পারবেন না। তখন দুজনের দৃষ্টি একেই সময়ে পরস্পরকে বিদ্ধ করবে। অলাপ না করে কি থাকা যায়? ততণে আলাপ শুরু হয়ে যাবে। আলাপের এক পর্যায়ে প্রাইভেট কোম্পানির সেল্সম্যানের চাকরির কথা শুনে আপনার বন্ধু আপনাকে তেমন একটা পাত্তা দিবে না। সে চমকে ওঠবে: ‘‘ আহ! কি কষ্ট, কোম্পানিগুলো রাতদিন মোটা হতে থাকে, আর কর্মচারীর অস্থিমজ্জা শুকিয়ে কাঠ। একটু আনন্দের- বিশ্রামের সুযোগ নেই।”
আপনি তখন মুখ খুলবেন: আনন্দ জিনিসটা একেক জনের নিকট একেক রকম। কোম্পানির কাজে আনন্দ পাওয়া কষ্টকর নয়, যদি কাজটাকে আনন্দ ভাবা যায় তাহলেই হলো। বড় একটা পার্টি পেলে , দুটা পার্টি পেলে, এভাবে দুয়ের অধিক পার্টি পেলে, বড় অঙ্কের সেল্ করতে পারলে মনে যে আনন্দটা আসবে তা উপভোগ করলে তি কি! আপনার বন্ধু আপনার কথা শুনে জিজ্ঞেস করবে – কতদিন এ লাইনে আছিস? আপনি আজই কাজে যাচ্ছেন এ কথা বলবেন না। যেহেতু আপনি টের পেয়ে গেছেন দ আলাপের তীব্রতা আপনার অভিজ্ঞতাকে দীর্ঘ সময়ের প্রমাণ করছে তাই হেসে হেসে বলবেন : হলো বেশ কয়েক বছর হলো। তখন বন্ধুটি চুপ করে একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করবে। আপনি ট্রেনের জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে কিছুণ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকবেন। বন্ধুর সিগারেটের ধোঁয়া আপনার নাকে লাগবে। তখন একটি দৃশ্যের মহড়ার জন্য আপনার মন উদগ্রীব হয়ে ওঠবে।
মহড়াটি চলতে থাকবে: বন্ধু আমি সিগারেট পান করি না, অন্যকে করতেও বলি না। তবে একটা অনুরোধ , যদি সত্যি তুই ধুমপান করিস তাহলে আমাদের কোম্পানির এই সিগারেটটা পান করে দেখতে পারিস। ভালো লাগবে । দাম মধ্যম মানের। নাম পিঙ্ক বার্জার
একবার দুইবার মহড়া শেষে পুনরায় আপনি ধাবমান প্রকৃতি দেখতে থাকবেন। তখন অনেক কথা মনে পরে যাবে: সেই কবে ট্রেনে চড়েছিলাম , ভৈরব পৌঁছার আগে রেলসেতুটির সে’কি গর্জন, গম্ গম্ ঝন্ ঝন্ - সেই গর্জন এখনো কানে বাজে। গর্জন নয় যেন সেতুর হুঙ্কার । আপনার পাশে তখন একটা অন্ধ লোক সুর করে ভিক্ষা চাইবে। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন , ট্রেনে ভিক্ষা করছে এমন অন্ধ লোকের সংখ্যা অনেক। বাংলাদেশে অন্ধ কল্যাণ সমিতি নামে একটি সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠনটির প্রথম ডোনার আবুল হাশিম, নিজের চোখের চিকিৎসা না করিয়ে তিনি টাকাটা সমিতির ফান্ডে দান করে সমিতিটির যাত্রা শুরু করান। এ বিষয়টি একটা কানা বা অন্ধ গলিতে ঢুকে গেলে আপনি যেন সে গলি থেকে বের হবার জন্যই অন্ধ লোকটির হাতে একটা কয়েন দিবেন। লোকটি তখন আপনাকে দোয়া করবে। কিন্তু আপনার মনে হবে আপনি দোয়ার জন্য টাকাটি দেননি। লোকটার গলার সুর খুব মিষ্টি, তার সুরে মুগ্ধ হয়ে আপনি টাকাটি দিয়েছেন। অনন্দ খুঁজতে জানলে একজন ভিুকের সুরের থেকেও আনন্দ পাওয়া যায়। এই কথাটি যখন আপনার বন্ধুকে অত্যন্ত যুক্তির সাথে দৃঢ় কন্ঠে প্রচন্ড বিশ্বাসের সঙ্গে বলবেন তখন আপনার বন্ধু হেসে উঠবে। কিন্তু আশপাশের কয়েকজন যাত্রী আপনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। তাদের দিকে তাকিয়ে আপনার বুক উষ্ণতায় ভরে যাবে। মনে হবে এ লোকগুলো অনেকদিন সত্য এবং সুন্দর কথা শুনে না। তার উপরে এমন প্রায়োগিক সত্য দেখে তাদের কেউ কেউ উসখুস করতে থাকবে। আপনার সঙ্গে আলাপটা কিভাবে শুরু করা যায,তাদের কারো কারো মুখে এমন একটা ভাবনা ফুটে উঠবে। টিক তখনি বাহিরে আওয়াজ হৈ চৈ, কখন ট্রেন পৌঁছে গেছে আপনি টেরই পাননি। আপনার বন্ধুও টের পায়নি। ট্রেন থেকে নেমে আপনি এনামুলকে খুঁজতে থাকবেন। ঐ দিকে এনামুলও আপনাকে খুঁজছে। প্লাটফর্ম যখন প্রায় ফাঁকা হতে শুরু করবে তখন একজন লোকের হাতে পিঙ্ক বার্জার সিগারেট কোম্পানির বিজ্ঞাপণ দেখে আপনি এগিয়ে যাবেন। গিয়েই বলবেন- আপনি এনামুল?
এনামুল বলবে- জী।
এনামুল আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিবে। আপনিও তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিবেন। আপনি তখন জানতে চাইবেন- কোথায় সমস্যা আছে । সমস্যা আছে এমন একটা কাছের দোকানে চলে যান। এনামুল আপনাকে নিয়ে চলবে। এনামুলের বিশ্বাস আপনি সমস্যার সমাধান করতে পারবেন । কিছুণ পথ চলার পর এনামুল আপনাকে সেই দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মিনমিনে গলায় বলবে- এই দোকান। মালিকটা বেশ রাগি, কোন কথা শুনতে চায় না। আপনি এনামুলকে কথার মাঝপথে থামিয়ে দিবেন। আপনি বিস্মিত হবেন । ছোট্ট একটা দোকান অথচ ক্রেতায় গম্ গম্ করছে। খুচরা পাইকারী সবরকম ক্রেতার হাট বসেছে । এমন একটা দোকান মালিকের সাথে ব্যবসা করতে না পারলে স্বস্তিতে থাকা যায়?
ততণে দোকান মালিক আপনাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে এনামুলকে চিনতে পারবে। আর আপনাকে ভাববে আপনি হয়তো ক্রেতা। আপনি সময়ের অপোয় আছেন, কখন কথা বলা যাবে। প্রায় পনের মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর ভিড় কিছুটা কমলে আপনি সালাম দিয়ে বলবেন- ভাই আমরা একটা নতুন কোম্পানি, একটা নতুন প্রডাক্ট নিয়ে এসেছি যদি দয়া করে দেখেন। মালিক এনামুলকে দেখে বলবে- পিঙ্ক বার্জার সিগারেট, চিনতে পারছি, না ভাই নতুন সিগারেট রাখবো না।
শুরুতেই ‘না’। আপনি জানেন ‘হা’ এবং ‘না’ পাশা পাশি থাকে। ‘হা’ বলাতে কষ্ট করতে হবে। তখন আপনি বিনম্র কন্ঠে বলবেন- সিগারেট রাখর প্রয়োজন নেই। আপনি দয়া করে আমার সঙ্গে যদি একটু কথা বলেন।
মালিক বলবে- বলুন, আপনি কি বলতে চান।
‘আমি আপনার একজন মেহমান । আপাদের এখানে মেহমান এলে কি তাড়িয়ে দেন? যদি এমন প্রথা থাকে আপনি তাড়িয়ে দেবার আগে আমি চলে যাব ।’
দোকান মালিক আপনার কথায় ফিক করে হেসে ফেলবে। আপনি তখন দেখতে পাবেন একটা বদ্ধ দরজার সামাণ্য ছিদ্র পথে এক বিন্দু আলো আসছে। এখন সমস্ত দরজাটা খুলে দিতে হবে। যাতে অনেক আলো এক সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে। যেন আলোর বন্যাতে সমস্ত ঘর ভেসে যায়। এনামুলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখবেন তার দুই চিবুকের পাশে দুইটি তৃপ্তি রেখা- একবার উজ্জ্বল হচ্ছে একবার নিভে যাচ্ছে।
মালিক হাসি থামিয়ে বলবে,আপনার যা ইচ্ছা বলেন। আপনি আমার মেহমান, বলেন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।
‘আপনি আমাকে বসতে বলেননি এখনো।’
‘আরে ভাই আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন , বসেন - বসেন।’
আপনি বুঝতে পারছেন লোকটা আপনার কথা শুনবে। কিন্তু যত সহজে বসতে বলেছে তত সহজে সিগারেট রাখবে না। সিগারেট সম্পর্কে কথা বললে মালিক শুনতেই চাইবে না। তাই আপনি সিগারেটে প্রবেশ না করে অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপণ করবেন। আপনি ভালভাবে জানেন, পৃথিবীর যে কোন প্রসঙ্গে কথা উঠুক তাতে কোন আপত্তি নেই, কারণ ঐ প্রসঙ্গ থেকে সিগারেটের প্রসঙ্গে চলে আসাটা কোন ব্যাপারই না। কথা বলতে জানলে কথার ভেতরের এ সুবিধাগুলো সহজে পাওয়া যায়। আপনি তখন মালিককে বলবেন- জানি ... ব্যবসা বাণিজ্যে ভালই আছেন , এখন সমস্যার কথা বলুন।
আপনি সমস্যা বলতে আপনার কোম্পানির সিগারেটের কথাই বলেছেন অথচ মালিক মনে করবে তার অন্য কোন সমস্যার কথা জানতে চেয়েছেন।
মালিকের মাথায় সাম্প্রতিক সমস্যা সমুহের মধ্যে চাঁদাবাজি কিলবিল করছে। চাঁদাবাজিতে মার্কেটের ব্যবসায়িরা অতিষ্ঠ কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোন সম্ভাবনা নেই। বিষয়টি সকলের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। আপাকে নতুন পেয়ে বিক্রয়ের ভারটা দুজন কর্মচারীর উপর কিছুটা ছেড়ে দিয়ে মালিক এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।
মালিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে- আর বলবেন না। এমনিতে একশ’টা সমস্যা , এখন একশ এক নম্বর সমস্যা হলো চাঁদাবাজি। আপনি তাৎণিক এবিষয়ে বলতে শুরু করবেন। চাঁদাবাজি এমন একটা বিষয় যার সঙ্গে বিভিন্ন কারন, বিভিন্ন ব্যক্তি নীতিহীন আদর্শ দল সমাজ রাষ্ট্র আলোচনায় ওঠে আসবে। আপনার মুখে তখন কথার খৈ ফুটছে। আর মালিক তখন গোগ্রাসে গিলছে। মালিকের মনে হবে আপনি তার মনের কথা বলছেন। ফাঁকে ফাঁকে মালিকও কথা বলবে। বিষয়টি যখন থিতু হয়ে আসবে তখন আপনি বলবেন- বলতে পারেন আমরাও চাঁদাবাজি করছি । পার্থক্য আমরা ভদ্র এবং কৌশলী চাঁদাবাজ।
‘ আরে না না , আপনি কি বলছেন? আপনি চাঁদাবাজ হতে যাবেন কেন? আপনি একটা প্রডাক্ট নিয়ে এসেছেন। ’
মালিকের কথা শুনে আপনার মনে হবে এইতো সুযোগ।
‘আচ্ছা ভাই আমাদের সিগারেট বিক্রিতে সমস্যাটা কোথায়?’
‘ভাই একেতো নতুন সিগারেট তার উপরে মানুষ এ সিগারেটের নাম শুনেনি। তাছাড়া এ সিগারেট খেয়ে দু একজন বলেছে তাদের কাশি হয়ে গেছে। গন্ধটাও নাকি ভাল লাগে না।’
তখন আপনি বলবেন , নতুন সিগারেট সত্য কথা, কিন্তু সব সিগারেটই তো এক সময় নতুন থাকে তারপর পুরাতন হয়। আর কাশির কথা বলছেন- হা কাশি হতেই পারে। যে জলে আপনি প্রতিদিন গোসল করেন, যে জলে গত দশ বছর গোসল করে আসছেন সে জলের পরিবর্তন হলে জ্বর হবে সর্দি হবে কাশি হবে । আমি বলছি না আমাদের সিগারেট পান করলে কাশি হবে না। হতেই পারে। কিন্তু একটু অভ্যস্ত হয়ে ওঠলে কাশি থাকবে না। সেই সঙ্গে গন্ধের সমস্যাও থাকবে না। আর নাম বা প্রচারের কথা বলছেন। আমরা দ্রুত বিজ্ঞাপণে যাচ্ছি। রেডিও টিভিতে পত্রিকায় শিঘ্রই বিজ্ঞাপণ শুরু হবে। ’
মালিক তখন বলবে ঠিক আছে বিজ্ঞাপণ শুরু হলে আসেন।
তখন আপনি কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণুতা অনুভব করবেন। আপনার মনে হবে লোকটা বেশ জটিল। কিন্তু আপনি জানেন ব্যবসায়িরা এমনি হয়। আপনি তখন আরো নামবেন। এবার নাম ধরেই বলবেন (দোকানের সাইন বোর্ড অথবা এনামুল থেকে ততণে আপনি মালিকের নাম জেনে গেছেন)- ছবির ভাই আমি আপনার পদধূলি নিতে চাচ্ছি। যখন এই সিগারেট মার্কেট হিট করবে তখন বলতে পারবেন , অ- এই সিগারেট- পিঙ্ক বার্জার ,পায়ে ধরে গছিয়ে দিয়ে যেতো। আমিই তো মার্কেট চিনালাম।
লোকটি তখন বলবে না ভাই আমি সামাণ্য ব্যবসায়ী, আমার পদধূলী নিয়ে আপনার কোন লাভ হবে না। তারচেয়ে অন্য কোন দোকনে চেষ্টা করেন।
ততণে আপনার জামার নিচের পাতলা গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে জব্ জব্ । ঘামটা আরো বৃদ্ধি পাবে। আপনার মনে হবে লোকটা খেজুর গাছের মত রু। কিন্তু সঠিক সময়ে গর্দান কাটতে পারলে রসের আস্বাদন পাওয়া যেতে পারে।
আপনি এনামুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, এই ছেলেটার সামনে হেরে যাবো? তার সামনে আরো কতো নিচে নামতে হবে? তখনও আপনি হাল ছাড়বেন না। আপনি বলবেন ,ছবির ভাই আমরা লেখা পড়া করে কি অন্যায় করেছি? বলতে পারেন সঠিকভাবে লেখা পড়া করিনি- করলে আজ সিগারেট কোম্পানিতে কাজ করতে আসতাম না, অন্তত মাঠ পর্যায়ে কাজ করতাম না। এখন মনে হয় লেখা পড়া না করে দু’নম্বরি কোন কাজ করলে ভাল থাকতাম।
ছবির আপনার কথা শুনে ঠায় দাঁড়িয়ে, জোর হাত, মুখে কোন কথা নেই। আপনি বুঝতে পারছেন ছবির মাল চাচ্ছে। এনামুলের দিকি তাকিয়ে দেখবেন এনামুল বিবর্ণ, তার তৃপ্তি রেখায় বিন্দু বিন্দু ঘাম । কপালের দুদিক কেমন কালো হয়ে গেছে।
আপনি তখন ছবিরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিবেন , এনামুলকে মুখে বলবেন- চল।
এর মধ্যে কখন ছবিরের হাত থেকে আপনার হাত চলে এসেছে আপনি টেরও পাবেন না। লজ্জায় ছবিরের দোকানের সামন থেকে চলে গেলেই যেন বেঁচে যান ।
‘ ... আহ! সিগারেটের চাকরি, কত বিরোধিতা করেছি , আর এখন...,’
আপনার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত উঠা নামা করবে । কিছুটা পথ অতিক্রম করারপর আপনার মনে হবে কোথাও বসলে ভাল হতো। ডান বা বাম দিকের কোন একটি চা দোকানের দিকে তাকিয়ে এনামুল বলবে- চলেন এ চা দোকানটায় বসি। দোকানটা আমার পরিচিত। এনামুলের আস্বস্ততা পেয়েও আপনি উসখুস করতে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত এ চা দোকানে বসেই দুজনের জন্য দু’কাপ চা অর্ডার দিয়ে আপনি চা দোকানটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিবেন, না কিছুটা নিরিবিলি, কথা বলার মতো পরিবেশ আছে।
ধুমায়িত দু’কাপ চায়ের সামনে দু’জন নিস্তব্দ। এনামুল আপনার মুখের দিকে একবারও তাকাবে না। চা পানের শব্দ ছাড়া আর সব যেন মৃত।
এনামুল তুমি কোথায় থাক?
আপনার প্রশ্ন শুনে এনামুল বলবে - মেসে।
প্রতিদিন কখন ফিরো?
রাত দশটায় , কখনো এগারোটায়।
টিভি আছে?
আছে । দেখি না। আট্টা অথবা দশটার সংবাদের একটু আগে যদি পৌঁছতে পারি তখন ঝট পট খেয়ে নেই। তারপর সংবাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে এমনিতে আমার ঘুম এসে যায়।
দেশের বাড়িতে যাও?
না, যাই না, যেতে খুব মন চায়। আসা যাওয়ায় যা খরচ সেই টাকাটা মা’র হাতে দিতে পারলে সংসারের একটু উপকার হয়।
বাড়িতে আর কে আছে?
মা আছে ভাই আছে বাবা আছে বোন আছে। বোনটারে দেখতে মন চায়। বড় হয়েছে । কখন কার সাথে পালায়...। ভাল কারো সাথে পালালে বাঁচি।
এনামুলের কন্ঠ ভারী হয়ে আসছে। সে আর কথা বলতে পারছে না। তার চোখে জল চিকচিক করছে। কিন্তু চোখের জলটা ফোটা হয়ে ঝরার আগেই মুখ কপাল ও গালের ত্বকের এমন একটি কসরৎ সে করবে - ফলে চোখের জলটা চোখের ভিতরেই থেকে যাবে। আপনার মনে হবে এনামুলের দিক থেকে আরো কি যেন এসে আপনার মুখমন্ডলে লেপ্টে গেলো। মনে হবে কিছু লোক দু’টি লজ্জিত মুখ দেখছে। নাক মুখ চোখের গর্ত থেকে ধোঁয়ার উদগিরণে লোকেরা বলা বলি করছে - চেয়ারে বসা মানুষ দু’টির ভেতর পুড়ে যাচ্ছে।
আপনি তখন ধুমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা গিলতে পারবেন না। মনে হবে ভেতর থেকে বমি আসছে। টেবিলের নিচে রাখা প্লাস্টিক বালতিতে মুখের চা টুকু ফেলে দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছবেন। এক শীতল মৌনতা দুজনকে গ্রাস করবে। ঠিক তখন একটা দশ বারো বছরের ছেলে দৌড়ে আসবে । এসেই বলবে-আপনাদেরে ছবির চাচা যাইতে কইছে। আপনি তখন বলবেন - কোন ছবির চাচা?
ছেলেটি বলবে- দোহানদার ছবির চাচা।
আপনি এবং এনামুল একে অন্যের মুখের দিকে তাকাবেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করবেন । ভাববেন কেন ডেকেছে। তারপর আপনি যখন এনামুলকে বলবেন- চলো, দেখা যাক কেন ডেকেছে। তখন উঠতে গিয়ে টেবিলের পায়ের সঙ্গে হোঁচট খেয়ে দেখবেন আপনি একটা সিগারেট এজেন্সি থেকে বের হতে গিয়ে পরে গেছেন। আপনার সঙ্গে ছবির নামের কোন মালিকের দেখা হয়নি। এনামুল নামের কাউকে নিয়ে আপনি কোন মার্কেটে যাননি। সর্বোপরি আপনি ট্রেনেই উঠেননি। আপনার হাতে একটা দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপণ । আপনাকে মেঝ থেকে তুলে দিতে দিতে এজেন্সির একটা লোক জিজ্ঞেস করছে- আপনি কি চাকরিটা করবেন?