-তারপর? থামলে কেন?
রূপা গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে গল্পের পরের অংশ শুনার জন্য। এতোটা আগ্রহ নিয়ে সে আমার লেখা গল্প শুনছে- এটা আমার কাছে স্বপ্নের চাইতেও অবাস্তব কিছু। প্রচুর পড়াশুনা করা মেয়ে রূপা। বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে বিদেশী সাহিত্যে তার অবাধ আনাগোনা। প্রতিদিন রাতের বেলা বই না পড়লে নাকি তার ঘুম আসে না ঠিকমতো। কিন্তু দুঃখ তো এটাই যে আমার মতো লেখকের কোন গুরুত্ব তার কাছে নাই।
সেই ছোট বেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস আমার। লেখালেখি করে অনেক আনন্দ পাই। রূপার বই প্রীতিও আমাকে লেখালেখির চর্চা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন টুকটাক গল্প লেখি। এইতো সেদিন একটা কবিতা লিখে রূপাকে পড়ে শুনালামঃ
আচ্ছা তুমিই বল
আমার কি যে হল
হয়ে গেল সব এলোমেলো
তোমাকে দেখার পর।
প্রতিটা দিন কেটে যায়
শুধুই তোমার ভাবনায়
কাছে পাওয়ার আশায়
তোমাকে দেখার পর।
তুমি কেন আসো না?
কিছুই ভালো লাগে না,
সময় কাটতে চায় না
তোমাকে দেখার পর।
এতো সুন্দর একটা কবিতা শুনে সে কী বলল জানেন? এটা নাকি একটা কাঁচা হাতের লেখা। ছন্দে ভুল আছে। এক কথায় এটা নাকি কবিতার ‘ক’ ও হয় নি। আরে বাবা! আমি তো রবীন্দ্র নাথ হয়ে যাই নি যে তাঁর মতো কবিতা লিখতে পারবো। তবে আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে একদিন না একদিন আমি একজন বিখ্যাত লেখক হবোই হবো। তখন রূপা কেবল আমার লেখা বই পড়বে। বই পড়ে অবাক হয়ে বলবে, তুমি এইটা লিখলে কিভাবে!
রূপা যখন অবাক চোখে তাকায় তখন যে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগে! খুব আদর জাগে মনে। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তার চোখে তাকিয়ে থাকি। তবে রূপাকে এমন অবাক করা খুব কঠিন। একবারই তাকে সেরকম সারপ্রাইজ দিতে পেরেছিলাম।
তখন কলেজে পড়ি। আমি বোটানিতে আর সে ইংরেজীতে। অনার্স পরীক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট হয়ে কলেজের সবার নজর কেড়ে নিয়েছে সে। অন্যদিকে আমি বোটানির মতো সহজ সাবজেক্টে ফেল করে নাম কামিয়েছি বেশ। পরীক্ষায় সদ্য ফেল করা আমি অসীম সাহসে যখন তার সামনে গিয়ে বললাম, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই, রূপা ভীষন অবাক হয়ে বলেছিল, তোমার মতো একটা গবেট এ কথা বলার সাহস পেলো কী করে। সেই একবারই তার অবাক চোখ দেখেছিলাম। এতোটা অবাক হওয়া চোখ কখনো দেখিনি আমি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই স্যরি বলে কেটে পরেছিলাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রূপার অবশেষে আমাকেই বিয়ে করতে হয়েছিল। অন্য একদিন সে গল্প করা যাবে। আজকের গল্প বলি।
গল্প পড়তে পড়তে আমি ইচ্ছে করেই থেমেছিলাম। রূপার অবাক হওয়া চোখ দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। রূপা সত্যি সত্যি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি গোগ্রাসে তার চোখ গিলতে থাকলাম।
-আহ! পড় তো!
বাধ্য হয়ে গল্পের আরো কিছুটা অংশ পড়লাম।
রূপা শব্দ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অনেকবার দেখেছি বই পড়তে পড়তে সে যখন চরম উত্তেজনায় থাকে তখন এমন করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। আজ আমার গল্প শুনে তবে রূপা এতোটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে!
-আবার থামলে কেন? তাড়াতাড়ি বল তারপর কী হলো?
রূপার তাড়া খেয়ে আবার পড়া শুরু করলাম। এক টানে গল্পটা শেষ করে তারপর থামলাম। রূপার দিকে তাকালাম। বিষ্ময়ভরা চোখ দুটি থেকে কী যে এক গভীর মায়া বের হয়ে আসছে! কিছুটা কি শ্রদ্ধাবোধ দেখা যাচ্ছে সে চোখে? লেখক হিসেবে তবে সে আমাকে স্বীকার করে নিচ্ছে?
-অ’সাম!
-আমি ইংরেজী বুঝি না, বাংলায় বলো।
-চমৎকার গল্প। এই গল্প তুমি লিখলা কিভাবে? কিভাবে লিখলা তুমি এই গল্প?
আমি চুপ মেরে থাকলাম। তার অবাক হওয়া চোখের লোভে পড়ে বলতে পারলাম না, গল্পটা আমার লেখা না। নেট থেকে নেয়া। অথচ গল্পটা বলা শুরু করার আগে ঠিক করেছিলাম গল্প শেষে তারপর তাকে ব্যাপারটা জানাবো।