১
বহরমপুর। ভারত। সময়টা ১৯৭১।
বোঝায় যাচ্ছে বড় সরো ঝড় উঠতে যাচ্ছে। বড় ঝড় উঠার আগে আকাশ অদ্ভুত এক লাল র্বণ ধারন করে। মেঘ গুলো প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়। একটা ঠান্ডা ভাব থাকে চারিদিকে। রেজা এসেছে। আয়েশা শুনে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারে নি। আয়েশাদের পরিবার যারা এই এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী শুধু বিত্তের কারনে না বিদ্যা অনুরাগের জন্যও। আয়েশা নিজেও বি.এ পাশ। পত্রিকায় লেখালেখি করেন। দু'চারটা গল্পের গুনে কোলকাতাতেও তার বেশখানিকটা পরিচয় আছে। সেই আয়েশার স্বামী রেজা এটা বাড়ির দারোআন চেহেরা দেখে মানতে পারছিল না। বিধস্ত অবয়ব। শরীরও কঙ্কালসার। মুখে অযত্নে বেড়ে উঠা কাচাঁপাকা দাড়ি। আবার ভাষাতেই বোঝা যাচ্ছে ওপার বাংলার। তাই বাইরে দাড় করিয়ে রেখেই বড় দিদি মনিকে বলতে এসেছিল ভোলা।
ভোলা যতই অবাক হোক রেজায় আয়েশা বেগমের স্বামী। ১৯৫৭ সালের কোন এক মাঘের রাতে তাদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই রেজা নিরুদ্দেশ হয়। লোক মুখে শুনা গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্থানে তার গ্রামের বাড়ী চলে গিয়েছে। সেখানে বিয়েও করেছে। বেশ ক’জন সন্তানও আছে। আয়েশার অবশ্য সে কারনে কোন আক্ষেপ নেই। বিয়ে ব্যাপারটাই তার কাছে অপচ্ছন্দের ছিল। রেজাকেও তার ভাল লাগেনি কোনদিন। মনে মনে যে স্বপ্ন পুরুষের স্বপ্ন সে বুনেছিল তার কোনটাই রেজা পূরণ করতে পারে নি। তার উপর ১৯৫৭ এর প্রেক্ষাপটে মুসলমান নারীদের মধ্যে সে ছিল যথেষ্ট বেমানান। যে আর চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকতে চাই না। ছোটবেলায় বেশ ক বছর কোলকাতায় থাকার কারনে এমন হতে পারে। বাবা বেথুন কলেজের লেকচারার ছিলেন। চাকরী সুবাদেই কোলকাতায় থাকা পড়েছিল। আশে পাশে সবই শিক্ষিত পরিবার। হিন্দু পরিবারই সব। মাঝখানে ওরা মুসলিম ঘর। বাবা রক্ষিনশীল ছিলেন না। ওবাধ মেলামেশার সুযোগ ছিল। আর প্রতিবেশীরাও জুটেছিল এমন কিছু যারা জাত পাতের ধার দিয়ে যেত না। কলকাতায় অবশ্য বেশিদিন থাকা পড়ে নি। বাবার আর চাকরী করা হলো না। দাদা মারা গিয়েছে। নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা দেখার কেউ নেই। অগ্যতা সব ছেড়ে ছুড়ে বাবাকেই ছুটতে হল বহরমপুর। এ এক নতুন পরিবেশ আয়েশার জন্য। যেখানে কিছুতেই খাপ খাওয়ানো যায় নি। মন পড়ে থাকে কলকাতায়।
বাবা-মা আর মুরব্বীদের চাপে এক রকম জোর করেই রেজার সাথে বিয়ে করেছিল আয়েশা। রেজার প্রথম স্ত্রী গত হয়েছে। কোলের একটা শিশু সন্তানও আছে। স্ত্রী বিয়োগের যন্ত্রনা ভুলতে বাড়ীতে শিশু সন্তান মামীর কাছে রেখে চলে এসেছিল ভারত। এদিক সেদিক ঘুরে শেষ মেষ বহরমপুরে আয়েশা বেগমদের বিশাল কাপড়ের ব্যবসায় ম্যানেজার হিসাবে নিয়োগও পেয়ে যায়। রেজার মামীর বাড়ির দিক থেকে আত্বীয়তা ছিল আয়েশাদের সাথে। ছেলে হিসাবে অমায়িক। বংশ ভাল। আয়েশা বেগমের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছিল। শিক্ষিত মেয়েদের নিয়ে নানা গুজবের কারনে ঠিক মত সমন্ধও আসছিল না। কোলকাতায় থাকা মেয়ে। স্কার্ট পড়ে সাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। সিনেমা দেখতে যায়। কানাঘুসা বেশ চলত পাড়া মহল্লায়। সে অবশ্য অনেক কাল আগের কথা। এখন কার পরিস্থিতি আলাদা। লেখিকা হিসাবে আয়েশা বেগমের আলাদা এক ভাবগম্ভীর্যতা আছে। পাড়ায় ক্লাবে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথিও করা হয়।
ওপার বাংলায় যুদ্ধ চলছে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দলে দলে লোক আসছে ভারতে। আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প চলছে সীমান্তে সীমান্তে। এ সময় রেজা কি পালিয়ে এল? যুদ্ধ করতে ট্রেনিং নিতে আসার মত লোক সে না। সে কি বউ বাচ্চা সমেত এসেছে। নাকি একা। এসব বিচ্ছিন্ন ভাবনায় আয়েশা বেগম বেশ অস্থিরতা বোধ করছে বহুদিন পড়ে। রেজার সাথে দেখা হবে। কি বলবে? বিয়ের আগে রেজার সাথে কালে ভদ্রে দু একবার কথা হয়েছে। বিয়ের পর এক বছরের সংসার। যার অর্ধেকের বেশী সময় কেটেছে ঝগড়া করে। ঝগড়া করার মানুষ অবশ্য রেজা ছিল না। নিতান্তই সাদাসিধি গোবেচারা টাইপ। সাত চড়ে কথা বলে না। সেটা আয়েশাকে আরও বেশী রাগিয়ে তুলত। ঝগড়ার বিষয় বস্তুও ছিল বেশ ছোটখাট। হয়ত পা না মুছে বিছানায় উঠে পড়েছে। কিম্বা লুঙ্গি উচূ করে পড়েছে। এমন রং এর একটা শার্ট পড়েছে যাতে দেখলে উজবুকের মত লাগে। হাত না ধুয়েই খাবারে হাত দিয়ে ফেলেছে। এটো হাতেই পানির গ্লাস ধরে ফেলেছে। নখ কাটেনি। এরকম কত শত যে অভিযোগ নিত্য দিনের। আয়েশার শখ ছিল তার স্বামী হবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। স্মার্ট হয়ে চলাফেরা করবে। অনেকটা উত্তম কুমারের মত। কিন্তু এমন জুটল তার কপালে। বান্ধবীদের সামনে নিয়ে যেতেও লজ্জা করত। এমনিতেই পুরুষ মানুষ সহ্য হত না। তারপরে আবার এমন চিড়িয়া। নিত্য অশান্তি অকারনেই বাধাত আয়েশা। বাসার গুরুজনরা কম চেষ্টা করেন নি।
হয়ত অশান্তি হতে হতে একদিন রেজা আর সহ্য করতে পারছিল না। তার পালানো রোগ ছিল। চলে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই 14 বছরে একটিবারের জন্যও খোজঁ নেই নি। আজ এসেছে। ওইতো বসে আছে কাচারি ঘরে। হাতল ভাঙা চেয়ারটাই।
: কেমন আছেন?
: এইত। তোমার খবর কি?
: ভাল। কবে এসেছেন?
: দিন তিনেক হল।
: উঠেছেন কোথায়?
: কোথাও না। শরনর্থী ক্যাম্পে ছিলাম।
কি অবস্থা আপনার গ্রামের?
: হু
: মিলিটারিরা কি গিয়েছে? শুনলাম সব গ্রাম নাকি আগুনে ছাড়খার করে দিয়েছে।
: জানি না।
: কেন?
: আমি তো গ্রামে বেশিদিন ছিলাম না। রেল এ চাকরী নিলাম। পোষ্টিং হল চাঁট গাঁ।
: শুনেছিলাম আবার বিয়ে করেছেন।
: হু। আমার চার বাচ্চা। দুটো ছেলে দুটো মেয়ে।
: ওরা কোথায়?
: হারিয়ে ফেলেছি।
: হারিয়ে ফেলেছেন কোথায়?
: আমাকে চারটে ভাত খাওয়াতে পারবা আয়েশা। ছ দিন হল ভাত খাই না। এটা সেটা খেয়ে আছি।
আয়েশা আর কথা বাড়াল না। মানুষটা ছ দিন ভাত খাই না। চেহারা অবশ্য বলে দিচ্ছে। বয়স কতই বা হবে রেজার। 20/22 এর দিকে বহররমপুর এসেছিল। এখন উর্ধে 40। দেখে মনে হচ্ছে 60 পেরিয়েছে। মানুষটা এত কঙ্কালসার তো ছিল না। আয়েশার মনে কোথায় যেন একটা সহানুভুতি খেলা করছে। ঠিক এই সময় ঝড় উঠল প্রবল বেগে। দমকা হাওয়ায় হারিকেনও বন্ধ হয়ে গেছে। চারিদকে গুমট অন্ধকার। কোথায় যেন বড় একটা ডাল ভেঙে পড়ার আওয়াজ। দূর থেকে একটা হৈ চৈও শোনা গেল। আয়েশা হারিকেন নিয়ে ছুটতে গিয়ে অন্ধকারেই হোচট খেয়েছে। নখ উপরে গেছে বোধহয়। ভীষন যন্ত্রনা করছে। মালেকাকে ডাকতে হল উপায়ন্তর না পেয়ে। মালেকা আয়েশার ছোটবোন।