বাসটা সোঁ সোঁ শব্দ করে ছুটে চলছে। আদতে সেমি লোকাল হলেও ফাঁকা রাস্তায় নিজেকে রাজা ভাবতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছে না আজ। খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে বৃষ্টিভেজা শীতল বাতাস আসছে। বাতাসের তীব্রতায় চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও ভালো লাগছে জাবিদের। ঈদের ছুটিতে অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছে সে। জাবিদের দৃষ্টি রাস্তার পাশের গাছগুলো ছাড়িয়ে দূরের গ্রামে, গ্রামের বাড়ি-ঘর, গাছ-গাছালী, পথ-ঘাটের উপর। উঁচু উঁচু নারকেল গাছ, গম্বুজের মত আম গাছ, তার মাঝে মাঝে কিছু কাঁচা-পাকা বাড়ি। কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর জুম হয়ে সামনে আসছে, তারপর গোলকিপারের হাত ফোঁসকে যাওয়া বলের মত নিমিষেই দূরে সরে যাচ্ছে।
ছোট্ট একটা মাটির ঘর। ঘরের সামনে কালো পানি ভর্তি পঁচা ডোবা। কিছু হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে সেই কালো পানিতে ঘুরে বেরাচ্ছে। ঘরটাতে কি মানুষ আছে? পঁচা কাঠের ছোট জানলাটা তো খোলাই ছিল। কে থাকতে পারে এ ঘরে? বিদ্যুৎ মিয়া? না, বিদ্যুৎ মিয়া গত বছর মারা গেছেন। মাথায় পোকা হয়েছিল। নাক দিয়ে সুর সুর করে পোকা বেড়িয়ে আসত। বাহাদুরের মা বিদ্যুৎ মিয়ার পাশে বসে পোকা গুনত আর সুর করে কাঁদত। বাহাদুরের বাপ মরে গেলে এ ঘরে একা কি করে থাকবেন তিনি? কিন্তু এখন এ ঘরে একাই থাকে বাহাদুরের মা। ভয় পাওয়ার সেন্সটা অকেজো হয়ে গেছে তার। মাথাটা বনবন করে ঘোরে। পাগলা কুত্তা কামড়ে মগজ ছিঁড়ে নেয়, কানের মধ্য দিয়ে ঝনঝন করে রেল গাড়ি চলে যায়। আর্তনাদ করে ওঠে বাহাদুরের মা। অস্পষ্ট সে আর্তনাদ ঘর পেড়িয়ে বাইরে বের হয়না। বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত দিয়ে যায় বাহাদুরের বউ। ভাত তুলে মুখে দেয়ার বল নেই হাতে, শক্ত ভাত চাবানোর শক্তি নেই দাঁতে, গলাধঃকরণ করার জন্য মুখে প্রয়োজনীয় লালাটুকুও নেই। মাথায় পাগলা কুত্তাটা খপ করে কামড় বসিয়ে দেয়। গোঙানির মত অস্ফুট একটা শব্দ হয়।
লালমাটির রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে নব্বই ডিগ্রী কোণে বাঁক নিয়েছে। এ বাঁক ঘেষেই জালাল উদ্দিনের বাড়ি। চুন খসে পড়া বড় বাড়িটা একঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। বাড়ির বৈঠকখানায় বাঁকা লাঠি আকড়ে জালাল উদ্দিন বসে আছেন। দু’সপ্তাহ আগেই জালাল উদ্দিন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের কেবিনে অসর দেহ নিয়ে পড়ে ছিলেন। হার্ট ব্লক হয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের। আল্লাহর রহমত আর বড় ছেলের পাঠানো টাকায় ওপেন হার্ট সার্জারি টা সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। ভদ্রলোক বেশ খুশি, সাথে ছেলে মেয়েরাও। না, শুধু ছেলেরা খুশি। জালালউদ্দিনের কোন মেয়ে নেই।
দোচালা একটা টিনের ঘর। মরিচা ধরা টিনের দেয়াল ঘেষে লম্বা একটা বাঁশে নীল রঙয়ের দুটো মাইক ঝুলছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় ওটা মসজিদ। মসজিদের পাশে কাঁচা বাঁশে ঘেরা নতুন একটা কবর। কবরটা নিশ্চয় বশির মুন্সির হবে। বশির মুন্সি এ মসজিদে বিশ বছর ইমামতি করেছেন। অনেকদিন থেকে বুক ব্যাথা করত মুন্সির। গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা ভেবে সকাল বিকাল সেকলো গিলতেন। ব্যথা যে কমত, তা না। তবুও দাঁত চেপে সহ্য করতেন সব। একদিন তীব্র ব্যথায় মুর্ছা গেলেন বশির মুন্সি। এলাকাবাসী শহরে নিয়ে গেল। ডাক্তার টেস্টের রিপোর্ট দেখে মুখ বাঁকালেন। চারদিন পর ঢাকা থেকে বায়াপ্সি টেস্টের রিপোর্ট এল। লিভারে ক্যান্সার হয়েছে মুন্সির। থেরাপি দিতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে দরিদ্র মুন্সির জন্য চাঁদা তোলা শুরু হল। টাকা উঠানো শেষ না হতেই তিনমাসের মাথায় মুন্সি মারা গেলেন।
বাসটা সোঁ সোঁ শব্দ তুলে ছুটে চলছে। রাস্তার পাশে একটা কালো রঙয়ের একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। সাদা কালিতে স্পষ্ট বাংলায় লেখা -‘এই জমি বিক্রয় হইবে’। সাইনবোর্ড টা আফতাব চৌধুরী টানিয়েছে। আফতাব চৌধুরীর বউ মাজেদা বেগমের ক্যান্সার ধরা পড়েছে গত বছর। চিকিৎসার কোন ত্রুটি করেননি আফতাব চৌধুরী। জমি বিক্রি করে বউকে সিঙ্গাপুর অবধি নিয়ে গেছেন। কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি বাদ রাখেন নি কিছুই। ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয়ে উঠছিলেন মাজেদা বেগম। ছয়মাস যেতে না যেতেই আবার অসুস্থ্য হয়ে পরলেন। একসময় যে লম্বা চুল নিয়ে গর্ব করতেন, সে চুল একটা একটা করে সব পড়ে গেল। মাজেদা বেগম শুকিয়ে পাটখড়ি হয়ে গেলেন। কিছু খেতে পারেন না এখন। দুবেলা ব্যথার ট্যাবলেট আর ইনজেকশন ছাড়া বাংলাদেশে আর কোন চিকিৎসা অবশিষ্ঠ নেই তার জন্য। তবে হাল ছাড়বেন না আফতাব চৌধুরী। প্রিয়তমা স্ত্রীকে এবার মাদ্রাজ নিয়ে যাবেন তিনি। রাস্তার পাশের এ জমিটা বড় শখ করে কিনেছিলেন আফতাব চৌধুরী। আশা ছিল গ্রামের ভাঙা বাড়িটা বিক্রি করে এখানে একটা দোতলা বাড়ি করবেন, নীচতলা ভাড়া দিয়ে উপর তলায় বউকে নিয়ে একা থাকবেন আফতাব চৌধুরী। একা না, সাথে একটা ছেলে থাকবে। প্রতিদিন বিকেলে ছাঁদ থেকে ছেলেকে গাড়ি দেখাবেন তিনি। আশাটা বোধহয় আর পূরণ হয়না আফতাব চোধুরীর।
সামনে চৌমাথা। কচ্চপ গতিতে একটা রিক্সা উত্তর দিক থেকে এসে পশ্চিমে মোড় নিল। রিক্সায় বাইশ তেইশ বছরের এক ছেলে রক্তলাল চোখ নিয়ে মুর্তির মত নির্বাক বসে আসে। ছেলেটার সাথে সাথে তেল চিটচিটে মেটে রঙয়ের একটা ট্রাভেল ব্যাগ। স্কুল মাস্টার হাবিবুর রহমানের বড় ছেলে ওটা, সাবু না লাবু কি যেন নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। হাবিব মাস্টারের বড় সাধ ছিল ছেলের প্রথম বেতনের টাকা নিজের হাতে গুণবেন, পাড়ার লোককে দাওয়াত করে পেটপুরে খাওয়াবেন। কিন্তু নষ্ট কিডনি দুটো সে সাধ পূরণ করতে দিল কই? চিকন লিকলিকে হাবিব মাস্টার ফুলে ভোম্বল হয়ে গেলেন। বিছানায় পড়ে থাকলেন সপ্তাহখানেক। তারপর ভোরবেলা মারা গেলেন। আজ? আজকেই তো। ছেলেটা বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেই রক্তলাল চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
রঙ বেরঙয়ের ফুলে সাজানো লাল রঙয়ের একটা প্রাইভেট কার বাসটাকে ক্রস করে সাঁই করে চলে গেল। বিদেশ ফেরত জিশান খান বিয়ে করতে যাচ্ছেন। ফুলের আধিক্যে ভদ্রলোকের মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল না। তবুও অষ্পষ্ট বিরস মুখটা দেখে ভদ্রলোকের ভিতরের অবস্থা আন্দাজ করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না জাবিদের। না, সুন্দরী বউ অপছন্দ হওয়ার কোন কারণ নেই জিসান খানের। দেশে ফেরার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন তিনি। তাহলে? লিজার কথা বোধহয় মনে হয়েছে জিসান খানের। প্রথম পছন্দ, প্রথম ভালোলাগা, প্রথম প্রেম এ সবকিছু বলতে লিজা নামের একটি সত্ত্বাকেই বুঝতেন তিনি। পিএইচডি স্কলারশিপ নিয়ে আয়ারল্যান্ড যাওয়ার আগে এনগেজমেন্টের ভেজালটা সেরে গিয়েছিলেন। কথাছিল তিন বছর পর দেশে ফিরেই লিজাকে ঘরে তুলবেন ড. জিসান। একবছর গেল, দুই বছর গেল, ঠিক তিন বছরের মাথায় ড. জিসানকে ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল লিজা। জিসানের দেয়া কথা শাহজালাল আন্তার্জাতিক বিমান বন্দর হয়ে সোজা আয়ারল্যান্ডে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। কোলনে ক্যান্সার হয়েছিল লিজার। জিসান দেশে ফেরার ঠিক একমাস তের দিন আগে মারা যায় লিজা।
বাসের গতি কমতে থাকে। একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে থামে বাস। সুপারভাইজারের চিৎকারে জাবিদের কল্পনার জালটা হঠাৎ ছিঁড়ে যায়। ধীরপায়ে বাস থেকে নামে জাবিদ। বাহাদুরের মা’র গোঙানির শব্দ কানে এসে বাঁধে ওর। জমির মুন্সির আর্তনাদ ধক করে বুকে একটা শব্দ তোলে। বউ পাগল আফতাবের হাহাকার রেস্টুরেন্টের মসৃণ দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে জাবিদের কানের কাছে এসে হাহাকার করে ওঠে। হাবিব মাস্টারের বড় ছেলেটা ইলেক্ট্রিসিটির থামের মত আশে পাশে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে। জিসান খানের মত চিনচিন করে ব্যাথা করতে থাকে বুকের বাঁদিকটা। জাবিদ জানে বাহাদুরের মা’র গোঙানি, জমির মুন্সির আর্তনাদ, জিসান খানের বুক ব্যাথা কিংবা আফতাব চৌধুরীদের হাহাকার এদেশে কোনদিন বন্ধ হবে না, ব্যাক্টেরিয়ার মত লগ সাইকেলে দিনে দিনে শুধু সংখ্যাবৃদ্ধি করবে। সবজির সাথে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশবে, বাহাদুরের মা’র গোঙানি বাড়বে, মাথার মধ্যে শতশত পাগলা কুত্তা একসাথে কামড়াবে। কার্বাইড ফল পাকাবে, জমির মুন্সি সপরিবারে বুকের ব্যাথায় মুর্ছা যাবে। ফরমালিনের পরশে আপেল, কমলা, মাছ চির অমরত্ব পাবে আর অন্য দিকে জাবেদা বেগম ছোট বোন আবেদা বানুর সাথে পাশাপাশি কেবিনে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনবে। অনেক স্বপ্ন মুছে যাবে, অনেক আশা নিরাশার সাগরে হাবুডুবু খাবে, অনেক প্রীয় মুখ অকালেই ঝরে যাবে। তবুও মানুষ জাগবে না। ফরমালিনে মাছ জাগে, ফলমূল জাগে, শুধু মানুষ জাগে না।