খামোখা পকেট ভারী করার দরকার কি? মোবাইলটা সাইলেন্ট করে ড্রয়ারে রাখে টিকু। ইদানিং এই যন্ত্রটার বিশেষ প্রয়োজন পরে না ওর। বেকার টিকুকে আন্তরিক হয়ে ফোন করার মত বাড়তি সময় মানুষের নেই। টিকুরও বা সময় কই? কে কেমন আছে না আছে সেটা জেনে টিকুর কি হবে?
আজকের বিকেলটা একটু অন্যরকম। অনেকক্ষণ থেকে দমকা বাতাস বইছে। মনে হয় ঝড় হবে। আকাশের দিকে তাকায় টিকু। ট্রাকের সাইলেন্সার দিয়ে যেভাবে ডিজেল পোড়া ধোঁয়া বের হয় সেভাবে মেঘগুলো ঈশান কোণ থেকে ভুরভুর করে বের হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত আকাশে। দক্ষিণ দিকটা মেঘশূন্য। গোধূলির লালচে আভাটা এখনো লুপ্ত হয়ে যায়নি। বহুরূপী আকাশটা দেখে আনমনে কি যেন ভাবে টিকু। পৃথিবীর মানুষগুলোর সাথে আকাশের কোথায় যেন একটা সাদৃশ্য আছে। দিক বিশেষে মানুষও এভাবে একই আকাশে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ধারণ করে।
একটা সময় ছিল যখন চোখ বন্ধ করে মানুষকে বিশ্বাস করত টিকু। মনের কথা সব উজার করে বলত। এখন সে সময়টা চলে গেছে। সাথে করে নিয়ে গেছে বিশ্বাসটাকেও। মানুষ বলতে সাড়ে সাত’শ কোটি হোমো সেপিয়েন্স নয়, গুটি কয়েক মনওয়ালাকে বুঝত টিকু। আস্তে আস্তে অঙ্কটা কমতে কমতে শুন্যে মিশে গেছে। অবশিষ্ট ছিল তৃনা। টিকুর বাল্যবন্ধু তৃনা।
- আচ্ছা তোর ফেভারিট খাবার কোনটারে?
- কচু ভর্তা
- আজব তো! কচুভর্তা কারো ফেভারিট হয়?
- কারো না হলেও আমার হয়।
- তুই একটা কচু তোর পছন্দও কচু কচু! যা তোকে এক বস্তা কচু ভর্তা করে পাঠিয়ে দিব
- হঠাত আমার খাবার নিয়ে তোলপাড় শুরু করলি কেন?
- কারণ তোকে আমি খাওয়াবো। পার্টি দেব, ব্রেক-আপ পার্টি!
- অসময়ে ফাইযলামি করিস না তো! কি হইছে ডিরেক্ট বল।
- তোর একমাত্র বান্ধবী ছ্যাকা খাইছে!
- মাঝে মাঝে ছ্যাকা খাওয়া দেশের জন্য ভালো! ভাতের উপর চাপ কমে!
- আমি সত্যিই ছ্যাকা খাইছি! শফিকের সাথে আমার ব্রেক-আপ হয়েছে!
- কি আপ বললি? সেভেন আপ?
- তোর কি মনে হয় আমি তোর সাথে ইয়ার্কি করছি?
- অসম্ভব! কিন্তু আপামনি ছ্যাকা খাওয়ার আগে যে প্রেম করতে হয় সেটা জানেন নিশ্চয়?
- শফিকের সাথে আমার তিন বছরের রিলেশন ছিল
- আর ইউ সিরিয়াস?
- তোকে অনেকদিন বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহস পাইনি।
- শুনে প্রীত হলাম। তো ব্রেক-ডাউন টা হলো কি করে?
- শফিক ছেলেটার অনেক সমস্যা আছে। ফেসবুকে মেয়ের সাথে টাংকি মারে আর আমার সাথে হরহর করে মিথ্যে বলে।
- ফেবুতে যে টাঙ্কি মারে সে খবর তোকে কে দিল?
- ফারদিন। শফিকের আইডিটা ফারদিনই হ্যাক করেছে
- ফারদিনটা আবার কে?
- আমার অনেক কাছের একটা ফ্রেন্ড।
- তারমানে ফারদিনও তোদের রিলেশনের বিষয়টা জানত?
- প্লিজ দোস্ত ভুল বুঝিস না।
- আমি কইছি যে ভুল বুঝছি?
- আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। মানুষ এত মিথ্যুক হয় কি করে?
- মিথ্যা বললেই মিথ্যুক হওয়া যায়। তুইও চেষ্ঠা করে দেখতে পারিস
- ও যা বলত আমি অন্ধের মত তাই বিশ্বাস করতাম। আমি এত বোকা কেন রে? আমি এখন কি করব?
- খুব খারাপ লাগলে ফ্যানের সাথে ওড়না প্যাঁচায়ে সুইসাইড করতে পারিস! তোর তো আবার সাহস কম। তুই বরং বালিশ ধরে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি কর।
- তুই কি আমার ফ্রেন্ড?
- বোধহয় ছিলাম।
- মানে?
- মানে আমার জন্য খারাপ লাগলে আরেকটু বেশী করে কাঁদিস। এক আয়োজনেই হয়ে যাবে।
- তুই এমন করে কথা বলছিস কেন?
- জানিনা রে। পাগলের কথায় কান দিতে নেই। শোক কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়না। কিছুদিন কান্নাকাটি কর এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
সত্যি সত্যিই কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল তৃনা। কিন্তু টিকু ঠিক হতে অনেক সময় নিয়েছিল। যে বিশ্বাসের আধিক্যে বাল্যবন্ধুর কাছে নিজের ভালোলাগা-খারাপলাগার অনুভূতিগুলো শেয়ার করত টিকু সেই একই বিশ্বাসের স্বল্পতায় টিকুর কাছে এতদিন ধরে বড় একটা সত্য গোপন করে এসেছে তৃনা। বিশ্বাসের পার্থক্য নিয়ে একই ছাঁদের নিচে দীর্ঘদিন বসবাস করা যায়, কিন্তু বন্ধুত্ব করা যায় না। যায়না বলতে হয়না।
ঝড় শুরু হয়েছে। বৃষ্টির পানিগুলোকে তুলার মত উড়ে নিয়ে যাচ্ছে উম্মাদ বাতাস। থেকে থেকে বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। দরজা-জানালা থর থর করে কেঁপে উঠছে। ঝড়ের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে টিকুর। নদী যেমন সাগরের বুকে মিশে যায় ঠিক সেভাবে।