A.
পায়ে ঠান্ডা তরলজাতীয় কিছু লাগতেই সড়াৎ করে হাঁটু মুড়ে ফেললাম। পায়ে লেগে আছে সেই তরল। হাত লাগিয়ে দেখি গাঢ় লাল রক্ত। নিচে চেয়ে দেখি চেয়ারের নিচ থেকে শুরু করে দরজা পর্যন্ত পুরো ফ্লোর জুড়ে রক্ত। বিছানার পাশে লাল টকটকে সেই রক্তের সাগরে নিথর দুটি নরনারীর দেহ পড়ে আছে। পুরুষের হাত বাঁধা দেহে বুকের কাছে ছুরি আটকে আছে,নারীদেহটি উপুড় করা। পুরো পেটটাই যেন কেটে ফেলেছে গেঞ্জি আর শর্টস পরিহিত শরীরটির।
জীবনে চোখের সামনে এত রক্ত আগে কখনো দেখিনি। এমনিতেই সামান্য হাত কাটলে মাথা চক্কর দেয় আমার। এখন এত রক্ত আর দুই মৃতদেহ দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার সারা শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। পা যত মুছে ফেলার চেষ্টা করি রক্ত ততই চেয়ারে লেগে যাচ্ছে। হাতের আঙ্গুলের ফাঁক গলে রক্ত কবজি গড়িয়ে চলে যাচ্ছে নিচের দিকে।
অতঃপর আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম।
B.
ঘুম ভেঙ্গে গেল সাথে সাথেই। কিছুক্ষণ দম মেরে শুয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি। ডান পাশে দেয়ালে ঝুলছে ক্যালেন্ডার,সিলিংয়ে ঘুরছে চারপাখার ফ্যান। সেই ফ্যানের বাতাসে ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে। মাথার উপরে জানালার ফাঁক গলে আসছে সোডিয়াম বাতির আলো। হয়তো নিচে গণিমিয়া স্বভাবসুলভ ঝিমুচ্ছে। বা’পাশে এটাসড টয়লেটের দরজা খোলা,আজকেও লাগাতে ভুলে গেছি। টেবিলে ল্যাপটপের পাওয়ার বাটনটা মিটমিট করছে। ব্যাটারীটা এবার না গেলেই নয়।
নিজের রুমে বিছানায় শুয়ে আছি আমি।
ঘড়িতে বাজছে ২টা ৩৭ এম।
C.
দো’তালা থেকে সিড়ি বেয়ে নিচে নামবার আর জো নেই। সিড়িতে গিজগিজ করছে মানুষ। কম করে হলেও শ’খানেক। কিশোরী-তরুণী-মহিলা,পুরুষ আর তরুণ;একসাথে বলতে গেলে মানুষ বাদে আর কোন ভাল বিশেষণ পাইনা। সবাই বেরুতে চায়। এমন কি আমার পিছনে ধাক্কাধাক্কি করে ক্রমাগত বাড়তে থাকা ভীড়টাও বেরুতে চায় এই ভবন থেকে। আজকে কাজে না আসলে এ মাসের বেতন দেবে না তাই সবাই এসেছিল। এখন বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। নিচে কলাপ্সিপল গেটটা কেন যে খুলছে না।
হঠাৎ মনে হল চোখের সামনে দেয়ালটা দুলে উঠলো। এরপর মনে হল অনেক নিচে কোথাও তলিয়ে যাচ্ছি। চারিদিকে প্রচন্ড ভয়ার্ত চিৎকার আর আর্তনাদ এর শব্দ।
তাহলে কি পিলারগুলো সব একসাথে ধ্বসে গেল !!
D.
আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল দুঃস্বপ্নে। রুমের সবকিছু আগের মতই আছে। আমি শুধু গায়ের কাঁথাটা অষ্টপাশে পেঁচিয়ে ফেলেছি বেকায়দায়। কেমন জট পাকানো অবস্থা হয়েছিল। পা দিয়ে বিছানার চাদর ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করতে করতে গায়ের নতুন করে কাঁথাটাকে জড়িয়ে নিলাম। পুরো মাথা ডেকে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছি। ঘুমানোর চেষ্টা চলছে। রাত এখনো গভীর হচ্ছে।
ঘড়িতে এখন দু’টা চুয়াল্লিশ বাজে।
E.
জবুথবু বসে আছি এক চটপটি দোকানের আড়ালে। দূর থেকে বাঁশির শব্দ আর অনেকগুলো এলোমেলো টর্চের আলো ক্রমাগত সামনে এগিয়ে আসছে। আমি হাঁটু জড়িয়ে ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করছি চটপটির এই ভ্যানের সাথে মিশে যেতে। জানিনা আমাকে দেখতে পেলে ওরা কি করবে,তবে অজানা কোন শংকায় বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের সিড়িতে অনেককেই মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি।
অনেকগুলো বুটজোড়ার আওয়াজ ক্রমান্বয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। এলোমেলো টর্চের আলো দেখে বুঝা যায় ওরা খুব বেশি দূরে নেই। হঠাৎ হুইসেলের আওয়াজকে দমিয়ে খুব কাছেই দুটো কুকুর ডেকে উঠলো। ঠিক কেন জানি বলতে পারবো না, আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌঁড় লাগালাম।
পিছনে একসাথে অনেক গুলো কন্ঠস্বর “ঐতো ধর,ধর” বলে ধাওয়া করা শুরু করলো। আমিও জীবনবাজি রেখে দৌঁড়াচ্ছি। গায়ের পাঞ্জাবীটা যেন হাঁটুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আমি ছুটছি,পিছনে কুকুর।
হঠাৎ একসাথে কয়েকটা গুলি হলো।
F.
এবার ঘুম ভাঙ্গতেই উঠে বসলাম। ঘড়ির কাঁটায় এখন তিনটা এক। আজ কত তারিখ? ২২ ডিসেম্বর তো এই সেদিন গেল। বছরে কি আজকাল বৃহত্তম রাত দুইটা হওয়া শুরু হলো নাকি ?? আজকের রাতটা এত বড় কেন ??
টেবিলে রাখা পানিটুকু খেয়ে নিলাম। অন্য সময় নতুন করে পানি এনে রাখি। আজ আর অন্য রুমে যেতে মন চাইছে না। কি অন্ধকার ঐদিকে।
G.
বিস্তৃণ জলরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলছে আমাদের ট্রলার। দুই পাশে সুন্দরীর বন নোনা জলের বুকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ট্রলারের শ্যালো ইঞ্জিনের বিকট শব্দ ছাড়া এই স্বপ্নের বাকি সব ঠিক আছে। কে যেন বলল আর কিছু দূর গেলে স্মরণখোলা। সামনের দিকে তাকিয়ে আছি,ট্রলার এগিয়ে চলছে। বাতাস কেটে কেটে যাচ্ছে শরীর দিয়ে। শরীরে কেমন তেল চিটচিটে ভাব।
ও কি !! সারা শরীরেই তো তেল। এত তেল এলো কোথা থেকে? যত ঝেড়ে ফেলি ততই যেন বাড়ছে। এত একটু আগী দুঃস্বপ্নে দেখা রক্তের মতই বাড়ন্ত।
কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
H.
গেঞ্জিটা সেঁটে আছে গায়ের সাথে। একেবারে ঘেমে নেয়ে উঠেছি। গায়ে থেকে খুলে খাটের সাথে মেলে দিলাম। গায়ে তো জ্বর ছিল না, এভাবে ঘেমে উঠলাম কেন !!
ধুত্তরি,রাতটাই বেজার কাটছে। উঠে টয়লেটে গেলাম। এবার মনে করে দরজাটা আটকিয়ে শুতে আসলাম। এখনো মাত্র রাত তিনটে সতেরো হতে চলল। ল্যাপটপটা অফ করে দেয়া হয়নি। উঠে অফ করে দিলাম। আজকের রাত কি শেষ হবে না ?
ডাক্তার বন্ধুটারে একটা কল দিয়ে দেখা যায়,সাউন্ড স্লিপের কোন থেরাপি জানা যায় নাকি। কিন্তু ব্যাটা তো কল-ই উঠায় না। থাক,এত রাতে বেচারাকে জ্বালাতন না করি।
কি আর করবো,কাঁথা মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করা যাক।
I.
কি রে !! কই আমি !! হাঁটু আর শরীর নাড়াচাড়া করতে পারি না কেন !! এ কিসের ভেতর আমি বন্দি !! কে আমাকে এখানে আটকিয়েছে !!
মাথার উপরে তাকালে অনেক দূরে কোথাও আলো আছে মনে হয়। নিচে তো তাকাতে পারছি না। তবে কোথাও ব্যাঙ ডাকছে।
“বাঁচাও !! বাঁচাও !!”
আমার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসছে। কেউ কি শুনতে পাচ্ছে আমার সাহায্যের জন্য এই আকুতি। কেউ আসবে আমাকে এখান থেকে টেনে বের করতে ??
“বাঁচাও !! বাঁচাও !!”
এটাও কি কোন দুঃস্বপ্ন !! তাহলে এই স্বপ্ন ভাঙছে না কেন ??
তাহলে কি এ রাত এখনো অনেক বাকি ??
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৪১