প্রসঙ্গঃ স্কুলে ভর্তি.....
সেই ষাট সত্তর দশকের কথা বলছি- আমাদের শিক্ষা জীবনে এক ক্লাস পাস করে উপরের ক্লাসে রেজাল্ট রোল অনার অনুযায়ী অটো ভর্তি করে নেওয়া হতো, বাড়তি কোনো ফিস দিতে হতো না। যদি কেউ স্কুল বদলাতো তাহলে সেই ছাত্রকে যৎসামান্য ফিস দিয়ে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিতে হতো। তখন ভর্তি হতে হতো- বছরের শুরুতে, অর্থাৎ জানুয়ারী মাসে। এখন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে বছরে একাধিক বার ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করেছে- এটা ভালো উদ্যোগ।
আজ থেকে ৬২ বছর আগে আমি যখন স্কুলের ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম তখন ভর্তির আগে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হয়েছিল। যদিও সেই স্কুলে খুব কম ছাত্ররাই ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতো, তবুও সেই অল্প সংখ্যক ছাত্রদেরই প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় (যে ক্লাসে ভর্তি হতে ইচ্ছুক সেই ক্লাসে পড়ার জন্য উপযুক্ত কিনা) অংশ গ্রহণ করেই ভর্তি হতে হতো। কারণ, মেধাই ছিল ভর্তির এক এবং একমাত্র মাপকাঠি।
আবার, ৩২ বছর আগে আমাদের বড়ো ছেলেকে যখন বনানীতে Playpen নামক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন ছেলের মেধা যাচাইয়ের জন্য সামান্য সময় খরচ করে, স্কুল কর্তৃপক্ষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলেন আমার ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের কাগজপত্র। অর্থাৎ, ছাত্র যেমনই হোক না কেন, বাবা মা বছর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান খরচের ধাক্কা সামলাতে পারে কিনা সেটাই হল মূল বিবেচ্য বিষয়।
অর্থাৎ পরিস্কার জানিয়ে দেওয়া- "তোমার পকেটের জোর থাকলে তবেই এই স্কুলে পড়াও, না হলে নিজের রাস্তা দেখো।"- 'দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ'র দুনিয়ার আপ্তবাক্য এটাই- পয়সা থাকলে পড়বে, না থাকলে নয়।
আমাদের বড়ো ছেলে লেখাপড়া শেষ করে একটি বহুজাতিক কোম্পানির মাঝারি গোছের কর্মকর্তা, বৌমাও একই ধরনের অন্য একটা কোম্পানির কর্মকর্তা। আমাদের নাতনীর বয়স চার বছর। ওকে আগা খান স্কুলে ভর্তির জন্য নিয়ে গিয়েছে..... স্কুল কতৃপক্ষ ছাত্রীর ভর্তির যোগ্যতা নিরুপনের জন্য ছাত্রীর মা-বাবার স্যালারি স্টেটমেন্ট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট পরিক্ষা করে আর্থিক সংগতি নিশ্চিত হওয়া ছাড়াও বাড়িতে ইংরেজি চর্চার বিষয়টাও অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নিশ্চিত করে নিয়েছে!
সে যাইহোক, আমাদের দুই সন্তানকে ক্লাস ইলেভেন পর্যন্ত পড়া বুঝিয়ে দেওয়া আমরা স্বামী স্ত্রী মিলে দুজনেই করেছি। ছেলে এবং বৌমা পেশাগত ব্যস্ততায় মেয়েকে পড়ানোর সময় দিতে পারে না। তবে এই বয়সে নাতনিকে পড়ানোর চর্চা এবং মানসিকতা আমাদেরও নেই। তাই বলে তো অবিভাবকের দায়িত্ব সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে চলার শিক্ষা প্রদানের দায়বদ্ধতা কমে যায় না। বিশেষ করে, কোন পথটা সঠিক নীতির আর কোনটা দূর্নীতির, সেটা বোঝানোর দায়িত্ব অবশ্যই অভিভাবকদের। অভিভাবক হিসেবে সেই লড়াইয়ের পথে ওদেরকে এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। পাশের বাড়ির মেয়েটা এ-যুগের প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত হয়ে সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, আবু সাইদ, মুগ্ধরা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দেবে- আর আমার নাতনী বাড়িতে বসে সেই লড়াইয়ের মেওয়া খাবে- এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পরবর্তী প্রজন্মকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে যারা বুক চিতিয়ে লড়ছে তাদের পাশে দাঁড় করিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করার দিন আজ সমাগত।
ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের প্রধান চরিত্র ঈশ্বরী পাটনী অন্নপূর্ণার কাছে আবেদন করেছিলেন, "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে"।
আজকের এই জন্মভূমিতে একজন সন্তানের বাবা হিসেবে, দাদা হিসাবে আমার একটাই চাহিদা-
আমার বংশধর যেন থাকে সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:৪০