ভালো থেকো নাতাশা.....
ম্যাক্সিম গোর্কির একটা গল্প পড়েছিলাম বহুকাল আগে, নাম One Autumn Evening (“শরতের এক সন্ধ্যেয়”)। বেশ বিখ্যাত গল্প। অবশ্য নামটা "autumn", অর্থাৎ শরৎ হলেও আমাদের হিসেবে "হেমন্ত" বললেই জমে ভাল। কারণ পটভূমি যেখানে, সেখানে শরতেও আদতে থাকে হাড়কাঁপানো মাঘের শীত, চারপাশে ভলগা উপত্যকা, ধেয়ে আসে সাইবেরিয়ার শীতল হাওয়া!
গল্পটার শুরু অদ্ভুৎ!
“সেদিন, এক শরতের সন্ধ্যেয়, ঘটনাচক্রে, আমি খুবই গোলমেলে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। হাজির হয়েছিলাম এক নতুন শহরে, যেখানে আমি প্রায় কাউকেই চিনি না। এদিকে পকেট গড়ের মাঠ, রাতে মাথা গোঁজবার ঠাঁইটুকুও কোথায় পাব জানি না। জায়গাটা এমনিতে বেশ জমজমাট থাকে, কিন্তু অক্টোবরের শেষে শহর প্রায় নির্জন, শুনশান, কোথাও একটা খাবারের দোকান বা সরাইখানা অবধি খোলা নেই!”
গল্পের কথক তখন ষোলো-সতেরো বছরের কৈশোর উত্তীর্ণ ভাগ্যান্বেষী। জায়গাটা রাশিয়া, তার ওপর আবহাওয়াও খুব একটা ভাল নয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে, উত্তর দিক থেকে হাড়কাঁপানো ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে। পেট চুঁইচুঁই করছে খিদেয়। এমন সময়, একটা বন্ধ দোকানের সামনে ছেলেটির নজরে এল, বৃষ্টিভেজা কাপড়ে কোনও মতে সেই দোকানে একরকম সিঁদ কেটেই কিছু খাবার চুরির চেষ্টা করছে একটি মেয়ে। প্রায় তারই বয়সী। মুখে ঘোরলাগা সৌন্দর্য, কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যায়—সঙ্গে কিছু আঘাতের চিহ্নও আছে।
ছেলেটি গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই সে মরিয়া হয়ে বলে ওঠে, "তুমিও কি খাবারের সন্ধানে? তাহলে অমন ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে না থেকে হাত লাগাও!" সেও খাবারের জন্য মরিয়া।
খানিক খোঁড়াখুঁড়ির পরেও তেমন সুবিধে করতে না পেরে শেষে ছেলেটি বলে, এইভাবে হবে না। গর্ত করে আর কদ্দুর যাওয়া যায়! তার চেয়ে দোকানের সদরের তালাটা ভাঙার চেষ্টা করা যাক। তালা ভাঙা হল। কিছুই পাওয়া যায় না প্রথমে। ঝড়টা বাড়ছে। কোনও মতে, অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক টুকরো ঠাণ্ডা ভিজে পাউরুটি পাওয়া গেল।
এদিকে বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। রাত বাড়ছে। ঝোড়ো হাওয়াও তীব্র হচ্ছে। পৃথিবীর এই উত্তর প্রান্তে ঠাণ্ডা বাদলা হাওয়া পাঁজর অবধি কাঁপিয়ে দিতে পারে। দু'জনে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে ছুটল কোনো আশ্রয়ের দিকে। কিন্তু কে দেবে আশ্রয়? শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। সে নদীর তখন উথালপাতাল অবস্থা! কোনোমতে ঘাটে এসে দেখল, একটা নৌকো বাঁধা আছে। কোথাও জনমানবের চিহ্ন নেই। দু'জনে কোনোমতে সেই নৌকোর ছইয়ের মধ্যেই ঢুকে বসল। বৃষ্টি পড়ছে! হাওয়ার দাপটও কম নয়। গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হয়।
মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করে সে। নাম বলে- "নাতাশা!"
কিন্তু নামের সঙ্গে শুরু করে এক করুণ কাহিনী। তার এক প্রেমিকের। তার সঙ্গে চলা এক ভয়ানক সম্পর্কের। পেশায় বেকারির কর্মী সেই প্রেমিকটি মানুষ হিসেবে ছিল ভয়ানক, নিজের বান্ধবীকে মারধোর, অত্যাচার— কোনো কিছুই করতে বাকি রাখেনি। তার সামনেই অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। বাইরের লোকের সামনেও পিটিয়েছে। নাতাশার মুখের দাগ আসলে ওই মারের চিহ্ন। তিতিবিরক্ত হয়ে নাতাশা পালিয়ে যায়। তারপর ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে এই অবস্থায় আসা। প্রবল রাগে ওই ঝড়বৃষ্টির মাঝেই নাতাশা সমস্ত পুরুষকেই গাল পাড়তে শুরু করে। শাপশাপান্ত, খুনের হুমকি কিছুই বাদ যায় না। 'পুরুষ মাত্রেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা উচিত। পুরুষ মাত্রেই নরকের কীট!' ছেলেটি হকচকিয়ে যায়। কী বলবে ভেবে পায় না। শুধু বুঝতে পারে, "আসল মৃত্যুযন্ত্রণার কাছে মৃত্যুর সবচেয়ে শৈল্পিক বর্ণনাও তুচ্ছ!"
এদিকে শীতে কাঁপুনিটা ক্রমশ বাড়ছে। প্রায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে! ঝোড়ো হাওয়াটা বেড়েছে। প্রায় অবশ হয়ে যাবে—এমন সময় ক্রুদ্ধ নাতাশার নজরে আসে, যাকে এতক্ষণ ধরে বলে চলেছে, সে নিরুত্তর। ঠাণ্ডায় প্রায় জমে গিয়েছে! একটু আগেই যার বাক্যবাণে কার্যত জগৎসংসারের সব পুরুষ "স্কাউন্ড্রেল" বলে বিবেচিত হয়েছিল, সে প্রায় হাঁ হাঁ করে উঠল,
"আরে? তুমি দেখছি জমে গেছো! এ কি! এরকম হচ্ছে বলবে তো! এ কি, কাঁপুনি ধরে গেছে দেখছি! এসো এদিকে এসো। এখানে শুয়ে পড়ো। একদম আমার কোল ঘেঁষে! হ্যাঁ আমাকে জড়িয়ে ধরো। চেপে। হ্যাঁ, এইভাবে। দ্যাখো একটু শীতটা কমবে! একরাতের তো ব্যাপার! এইভাবেই কাটিয়ে দেব। এসো এসো..."
পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা থেকে দূরে থাকা, ভালবাসার ভাগ না পাওয়া নাতাশা পরম যত্নে ছেলেটিকে হাওয়া থেকে আড়াল করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।
এই গল্পের শেষে কিছু নেই। এই গল্পের শেষে কোনো ট্যুইস্ট নেই, কোনো নাটকীয় ঘটনা নেই। সেই এক অভিশপ্ত রাত নাতাশার জন্য ছেলেটির কাছে হয়ে উঠেছিল মনে রাখার মত কিছু মুহূর্ত। জীবনের রুদ্রমূর্তিতে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে, গোর্কির ভাষায়, "রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একটি মেয়ে" সারারাত ধরে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি থেকে নিজেকে দিয়ে আড়াল করে রাখে অনাহারে থাকা ছেলেটিকে। ক্রমাগত সান্ত্বনা দিতে থাকে, কিছু হবে না। তারপর সকাল হতেই দু'জনে হাঁটা দেয় শহরের দিকে। তারপর বিদায় নেয় একে অপরের থেকে।
"পরের প্রায় ছয় মাস ধরে আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলাম নাতাশাকে। কিন্তু আর দেখা পাইনি। সেই এক রাত্তিরের মুহূর্তগুলো নিয়েই সে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। জানিনা, বেঁচে আছে কিনা আজও। না থাকলেই ভাল। যদি থাকেও—তবু সেই কথাটাই বলব! সে যেন একটু শান্তিতে থাকে!"
১৮৯৫ সাল নাগাদ লেখা গল্পটি এইখানেই শেষ।
(২০১৯ সালে ফেসবুকে লিখেছিলাম)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৮