ফতেপুর সিকরি এবং একটি মিথ.........
ফতেপুর সিকরি নামটির উৎপত্তি হয় সিকরি নামের গ্রাম থেকে। ফতেপুর সিকরি বাবরেরও খুব পছন্দের জায়গা ছিল এবং এখানকার ঝিল থেকে সৈন্যদের পানি সরবরাহ হত বলে তিনি একে শুকরি (শুকরিয়া) বলতেন। অ্যানেট বেভারিজ 'বাবরনামা'-এর অনুবাদে লিখেছেন, বাবর সিকরিকে শুকরি বলতেন। বাবর নামায় লিখেছেন, তিনি রাণা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করার পরে এখানে 'বিজয়ের উদ্যান' নামে এক বাগান বানিয়েছিলেন। গুলবদন বেগমের 'হুমায়ুননামা'-তে লেখা আছে, বাবর সেই বাগানে একটি আটকোণা চাতাল বানিয়েছিলেন যা তিনি বিনোদন ও লেখার জন্যে ব্যবহার করতেন।
১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ অবধি সম্রাট আকবর শহরটিকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৬১০ সালে শহরটি রাজধানী মর্যাদা বর্জন করা হয়।সম্ভবত পানীয় জলাভাবের কারনে শহরটিকে বর্জন করা হয়। ইতিপূর্বে সমগ্র ফতেপুর সিকরি আকবরের দুর্দান্ত শিল্পভাবনার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণ তুলে ধরে একটি স্বতন্ত্র স্থাপত্যধারার প্রচলন করলেও প্রাসাদটি নিকটবর্তী একটি ঝিলের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আশে-পাশের পানি-সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এছাড়া প্রাসাদটি রাজপুতানার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় শত্রুদ্বারা আক্রমনের ভয়ও ছিল। এই সমস্ত কারণে প্রাসাদটিকে ১৫৮৫ সালে বর্জণ করা হয়।
ইতিহাস একথা বললেও এখানকার বাসিন্দা দের মুখে প্রচলিত আছে অন্য গল্প।
ধারণা করা হয় নর্তকী জরিনার জন্যই ফতেপুর সিক্রি ধ্বংস হয়। সম্রাট আকবরের প্রাসাদে নাচার স্বপ্ন ছিল নর্তকী জরিনার। একদিন সেই সুযোগও পেল জরিনা। আকবরের প্রাসাদে নাচলো সে। আকবর খুশি হয়ে তাকে প্রাসাদেই রেখে দিলেন। সম্রাটের প্রিয় হয়ে উঠায় রানির দাসী মাধবীর হিংসার কারণ হলো জরিনা।
সিক্রির নর্তকী জরিনার স্বপ্ন ছিল বান্ধবীদের মত প্রাসাদে কাজ করবে। কিন্তু তার বাবা রাজি ছিলেন না।
একদিন সম্রাট আকবর তার কাছের অতিথিদের জন্য এক অনুষ্ঠান আয়োজন করলেন। তিনি গায়ক তানসেনকে ডাকলেন সেই অনুষ্ঠানে গান গাইতে। সম্রাট তানসেনকে বললেন, আপনার গানের সঙ্গে সেখানে কাউকে নাচতে হবে। তানসেন বললেন, আমি চেষ্টা করব নর্তকী রাখতে, কিন্তু আমি এখানে কোন নর্তকীকে চিনি না।
দাসীদের মধ্য থেকে কেউ একজন সম্রাট আর তানসেনের এ আলাপ শুনেছিলেন। সম্রাট চলে গেলে সেই দাসী তানসেনকে জরিনার কথা বললেন। পরামর্শ দিলেন তানসেন যেন জরিনাকে নাচার প্রস্তাব দেন।
তানসেনের মত বিখ্যাত গায়ক জরিনাকে সম্রাট আকবরের জন্য নাচার প্রস্তাব দিলে জরিনার বাবা আর না করতে পারলেন না। জরিনা ফতেহপুর শহরে যাওয়ার আগে বাবার কাছে থেকে বিদায় নেয়। বাবা জরিনাকে পরামর্শ দিলেন, একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে। সাবধানে থাকবে, আর মনে রাখবে তোমার জন্য আমি সবসময়ই আছি।
জরিনা প্রাসাদে গিয়ে আকবর ও তার সভাসদদের সামনে সারারাত নৃত্য পরিবেশন করলো। জরিনার কাছে এটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ব্যাপার। সম্রাট জরিনাকে পছন্দ করলেন। তিনি জরিনাকে প্রাসাদে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রাসাদের সবাই জরিনাকে পছন্দ করলেও রানি যোধা বাঈয়ের দাসী মাধবী জরিনাকে পছন্দ করল না। সম্রাটের কাছ থেকে জরিনা বেশি মনোযোগ পাওয়ার কারণে মাধবী জরিনার প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিল। জরিনাকে সম্রাটের চোখে অপরাধী বানাতে চাইল সে। তাই একদিন সুযোগ বুঝে রানি যোধা বাঈ এর স্নানের সময় মাধবী তার গয়নার বাক্স থেকে একটি সোনার বালা চুরি করে জরিনার জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।
যোধা বাঈ যখন দেখল যে তার একটি বালা নেই তখন তিনি মারাত্মক রাগান্বিত হলেন। পুরো প্রাসাদ তল্লাশির নির্দেশ দিলেন।ববালাটি জরিনার ঘরে পাওয়া গেলে যোধা বাঈএর রাগে যেন ঘৃতাহুতি পড়লো। তিনি সম্রাট আকবরের কাছে গেলেন। সম্রাট আকবরের কাছে গিয়ে যোধা বাঈ কাঁদতে কাঁদতে তার আদরের নর্তকী বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেন এবং বিচারের দাবী জানালেন।
জারিনাকে এসম্পর্কে বলা মাত্রই তিনি আকাশ থেকে পড়লেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তিনি তার পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারলেন না। নিরুপায় রাজা তখন বাধ্য হলেন জারিনার শাস্তি ঘোষণা করতে। তখনকার আইন ছিলো যে কোনো ব্যক্তি যদি চুরির দায়ে ধরা পড়েন তবে শাস্তিস্বরূপ তার হাত কেটে নিতে হবে। আকবর এই শাস্তি ঘোষণা করলেও নিজে মন থেকে মানতে পারছিলেন না। জারিনা কে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
রাতে জরিনা অন্যান্য দিনের মতই সম্রাটের সামনে নৃত্য পরিবেশন করলো। কিন্তু এই নাচে কোনো আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, ছিলো না কোনো উচ্ছলতা, তার নাচের মধ্য দিয়ে ঝরে পড়েছিল সম্রাটের প্রতি তার তীব্র অভিমান। আকবরের সভাসদরা প্রত্যেকেই সেদিন নৃত্যশৈলীর এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
পরের দিন সকালে আকবর তার সকল সভাসদদের ডাকলেন। তিনি একজন রক্ষীকে পাঠালেন জরিনাকে নিয়ে আসার জন্য। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই রক্ষী কোথাও জরিনাকে পেল না। সে এসে সম্রাটকে এ কথা জানালো। তখন সভায় এক বৃদ্ধ লোক প্রবেশ করলেন।
সিংহাসনে বসা সম্রাট আকবরের সামনে গিয়ে তিনি বললেন, হুজুর, কোন প্রমাণ ছাড়াই জরিনাকে অভিযুক্ত করে আপনি ভুল করেছেন। আকবর জরিনার বাবাকে চিনতে পারলেন। তিনি বললেন, জরিনা কোথায় আমাকে বলুন, আমি দেখব তার সঙ্গে যেন ন্যায়বিচার ঘটে।
জরিনার বাবা মাথা নেড়ে বললেন, অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আর কিছুই করা যাবে না। আপনি আমার মেয়ের জীবনে অনেক দুঃখ এনে দিয়েছেন, আর ফতেহপুর সিক্রি অবশ্যই এ বেইমানির শাস্তি পাবে।
বৃদ্ধ লোকটির কথার অর্থ কী, আকবর জিজ্ঞাসা করার আগেই লোকটি ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। দুই সপ্তাহ পরে ফতেহপুর সিক্রির কুয়োগুলো শুকিয়ে গেল। সম্রাটের উট ও ঘোড়ার এবং মানুষের জন্য কোন পানি কুয়োগুলোতে অবশিষ্ট ছিল না। সম্রাট আকবর তার স্ত্রীদের ও সন্তানদের নিয়ে আগ্রার দুর্গে গিয়ে উঠলেন। তারা আর কখনোই ফতেহপুরে ফিরে আসেননি।
সিক্রি গ্রামে এই গল্প এখনো প্রচলিত আছে। গ্রামের কেউ কেউ বলে যে পূর্নিমা রাতে ফতেহপুর সিক্রির প্রধান ফটক, বুলন্দ দরজাতে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা বলে যে এটা আসলে মাধবী, সে জরিনার জন্য অপেক্ষা করে যাতে তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে।
তথ্যসুত্রঃ
(১) 'A Handbook Agra and the Taj Sikandra, Fatehpur Sikri'- থেকে ভাবানুবাদ।
(২) "Census of India: Fatehpur Sikri" থেকে ভাবানুবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭