কপাল পোড়া রাফেল ভালদাও......
ডিসকভারী চ্যানেলে এক ব্রাজিলীয় কারাবন্দীর জেল পালানো ঘটনা নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী দেখে আবার মনে পরলো- 'দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন' মুভির কথা। 'দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন' মুভির রিভিউ লিখেছিলাম অন্তত দশ বছর আগে। 'দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন' মুভির ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়ার আগে বর্ণনা করছি- ডিস্কভারী চ্যানেলে ব্রাজিলীয় কারাবন্দী রাফেল ভালদাও এবং জুডসন কুনহা ইভাঞ্জেলিস্তার এর কাহিনীঃ-
মাদক ও হত্যা মামলায় ১৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামী রাফেল ভালদাও এবং জুডসন কুনহা ইভাঞ্জেলিস্তা। সিনেমার কাহিনীর মতো যে জেল ভাঙার ঘটনা জেল বন্দীদের বাস্তব জীবনেও ঘটে তার প্রমাণ রাফেল ভালাদাও এবং তার অপর সহবন্দী জুডসন কুনহা ইভাঞ্জেলিস্তা। দুই বন্দী জেল প্রোকোষ্ঠে বসেই সিদ্ধান্ত নেয়- তারা জেল থেকে পালাবে। কিন্তু পালাতে চাইলেইতো পালানো যায়না। কারণ, সেই জেলে সব দুর্ধর্ষ বন্দীদের রাখা হয় সর্বচ্চ কঠোর নিরাপত্তায়। তার পরও দুই বন্দী সিদ্ধান্ত নেয়- জেলের ভেতর থেকে সুরংগ তৈরী করে জেল প্রাচীরের বাইরে বেড় হবে..... যেই ভাবা- সেই কাজ! প্রায় পাঁচ বছর ধরে ১৪০ মিটার দৈর্ঘের একটি পালানোর সুড়ঙ্গ খনন করেছিল। কিন্তু শেষটা ভালো হয়নি। জুডসন কুনহা ইভাঞ্জেলিস্তা অক্সিজেনের অভাবে ভুগছিলেন, তাই বেশীদূর এগুতে পারেনি- অর্ধেক পথ যেয়েই নিস্তেজ হয়ে পরে। আর রাফেলের দীর্ঘকায় স্থুল শরীর এবং ওজনও অত্যাধিক হলেও সে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছিল। তার শরীরের অর্ধেক বাইরে বাইরে বের করেছিল কিন্তু বাকি অর্ধেক অতিক্রম করতে পারেনি। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্থুলকায় শরীরের জন্য সে আটকে গিয়েছিল। আবার নিরাপদে পেছনের দিকেও সরে যেতে পারছিলোনা। দীর্ঘক্ষণ এভাবে আটকে থেকে তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। এমতাবস্থায় রাফেল সাহায্যের জন্য চিৎকার করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। রাফেলের আর্তচিতকার শুনে জেলের নিরাপত্তা পুলিশ চলে আসে। নিরাপত্তা অফিসার হাতুড়ী শাবল চালিয়ে সুড়ঙ্গ আরও একটু বড়ো করে তাকে বের করে।
সারমর্মঃ যখনই আপনি মনে করবেন যে, জীবন আপনার জন্য কঠিন, তখন এই লোকটির গল্পটি মনে রাখবেন যিনি পাঁচ বছর একটি সুড়ঙ্গ খনন করতে কাটিয়েছেন, শুধুমাত্র আটকে যেতে এবং আবার কারাগারে ফিরে যেতে। ‘Hope is a dangerous thing. Hope can drive a man insane.’
এবার আসি 'দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন' মুভির গল্পে- যা এক দশক আগে লিখেছিলাম।
আশা।
দুই অক্ষরের এই শব্দটার জোরেই মানুষ নিত্যদিনের বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা, সহস্র গ্লানির পরেও নতুন করে বেঁচে ওঠার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি।
১৯৯৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন (The Shawshank Redemption) দুনিয়ার তাবৎ সিনেপ্রেমিদের কাছে তাই শুধু অসাধারণ চলচ্চিত্রই নয়, জীবনের প্রত্যাশারও প্রতীক। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা।
ভাগ্যের দুর্বিপাকে যুবক অ্যান্ডির স্থান হয় শশাঙ্ক কারাগারে। সেই বন্দি জীবনের পথ মেলে রেড, ব্রুকস, জিল, জেমসদের সাথে। পরিচয় ঘটে অসংখ্য জর্জরিত প্রাণের ক্রন্দনের স্রোতে। তবে দুঃসহ জীবনের আঘাতেই থেমে যায় না সে, কষতে থাকে ভবিষ্যতের হিসেব, স্বপ্ন দেখে মুক্তির- এই বিষয় নিয়েই দশ বছর আগে লিখেছিলাম, কাজেই নতুন করে সেই বিষয় লিখছিনা, বরং মুভি তৈরীর নেপথ্য এবং মুক্তির পরের কিছু ঘটনা বলছি-
১৯৮২ সালে প্রকাশিত স্টিফেন কিং এর ‘Rita Hayworth and Shawshank Redemption’ উপন্যাসিকার অনুকরণে নির্মিত হয় ছবিটি। গল্প পড়বার সময়ই ফ্র্যাঙ্ক মনস্থির করে ফেলেন এ নিয়েই সিনেমা বানাবেন। তাই আটঘাট বেঁধে আট সপ্তাহ প্রাণান্তকর খেটে চিত্রনাট্য প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন চিত্রনাট্য। ফ্র্যাঙ্কের প্রস্তাবে বিস্মিত হয়েছিলেন লেখক স্টিফেন কিং। কারণ, এই গল্পটা যে ফিল্মের উপযুক্ত তা নাকি স্বপ্নেও ভাবেননি। তবে চিত্রনাট্য আর ফ্র্যাঙ্কের আত্মবিশ্বাস প্রভাবিত করে কিংকে। মাত্র পাঁচ হাজার ডলারে বিক্রি করেন এর ফিল্ম স্বত্ব। তবে সেই চেক কখনোই ভাঙাননি কিং। চেকটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে গোটা অক্ষরে লিখে রেখেছেন- “In case you ever need bail money. Love, Steve.”
চলচ্চিত্র আর মূল সাহিত্যের মাঝে কিছ তফাৎ থেকেই যায়। এর ব্যতিক্রম নয় শশাঙ্কও। উপন্যাসের ফিল্ম স্বত্ব কিনে নিয়ে চিত্রনাট্যে পরিবর্তন করেন ফ্র্যাঙ্ক। উপন্যাসিকায় বৃদ্ধ ব্রুকসের মৃত্যু ঘটে একলা ঘরে, বার্ধক্যে। ফ্র্যাঙ্ক তা বদলে ব্রুকসের একাকীত্বকেই বৃহদাকারে দেখান, বোঝান কারাবন্দি জীবনের অভ্যস্ততাই থাকে হতাশাগ্রস্ত করেছিল। ছবির শেষ দৃশ্যে দুই প্রধান চরিত্রের পুনরায় মিলিত হবার কথাও ছিল না। এমনকি মূল গল্পানুসারে দিগন্তে বাস যাবার দৃশ্য দিয়েই সমাপ্তি টেনেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক। পরবর্তীতে পরিবর্তন আসে স্ক্রিপ্টে। স্ক্রিপ্ট পরিবর্তন করার পর কিংবদন্তি পরিচালক রব রেইনার ( When Harry Met Sally, A few Good Men খ্যাত) তিন মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে স্ক্রিপ্ট কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ককে। তবে নিজের প্রথম ফিল্মের জন্য লোভনীয় অফারও বাতিল করে দেন ফ্র্যাঙ্ক। ফ্র্যাঙ্ক ডারাবন্ট তখন একেবারেই নবীন পরিচালক। আনাড়ির সাথে কাজ করবার সাহস দেখিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা মরগ্যান ফ্রিম্যান আর টিম রবিনস। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কী?
ছবির ২৫ বছর পূর্তিতে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন দুই তারকা অভিনেতা। তুখোড় স্ক্রিপ্ট গুছিয়ে মরগ্যান ফ্রিম্যানের কাছে প্রথম দ্বারস্থ হন ফ্র্যাঙ্ক। তখন কিন্তু ফ্রিম্যান ঘুণাক্ষরেও জানতেন না তাঁকে রেড চরিত্রের জন্য ইতোমধ্যেই বাছাই করা শেষ! স্ক্রিপ্টের প্রতি মায়া থেকেই এগোন এই প্রজেক্টে।
ছবির মূল ভূমিকা অর্থাৎ অ্যান্ডি ডুফ্রেস্নের চরিত্রে প্রথম পছন্দ ছিলেন না টিম রবিনস। টম হ্যাংকস, কেভিন কস্টনার, টম ক্রুজ, নিকোলাস কেজ, চার্লি শিন, জনি ডেপ প্রমুখের কাছেই ধর্না দিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক। একই সময় ‘ফরেস্ট গাম্প’ এর শ্যুটিং থাকায় টম হ্যাংকস ছেড়ে দেন ছবিটি। কস্টনারও ‘ওয়াটারওয়ার্ল্ড’ এর খাতিরে পিছিয়ে যান। অবশেষে আইরিশ চরিত্রে মরগ্যান ফ্রিম্যান! রেডের চরিত্রের পেছনেও কম ঘাম ঝরায়নি ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ টিম। ক্লিন্ট ইস্টউড, হ্যারিসন ফোর্ড, পল নিউম্যান থেকে শুরু করে রবার্ট রেডফোর্ড- সমস্ত বাঘা তারকাকে নিয়ে ভেবেছিল কাস্টিং টিম। গল্পের সূত্রে রেড মধ্যবয়সী সাদা চামড়ার এক আইরিশ, চুলের রঙও লালচে। কিন্তু ডারাবন্টের ভাবনায় একমাত্র মরগ্যানই ছিল উপযুক্ত রেড। জলদগম্ভীর কণ্ঠ, সুস্থির উপস্থিতির জন্য এর বাইরে অন্য কাউকে ভাবতেই পারেননি পরিচালক।
কারাগার সন্ধানঃ
প্রোডাকশন ডিজাইনার টেরেন্স মারশের কাছে বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল নিখুঁত কয়েদখানা তৈরি। উপন্যাস/ ছবির ঘটনা যেহেতু কারাগার কেন্দিক তাই পরিচালক শুটিংয়ের জন্য সত্যিকারের একটা কারাগার খুঁজে পেতে তৎপর ছিলেন। নিরন্তর খোঁজাখুঁজির পর মিলেও যায় ওহাইও রাজ্যের কেন্দ্রীয় কারাগার। ১৯৯০ সালেই বন্ধ হয়েছিল সেই কারাগারটি। বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ এং অব্যবস্থাপনার কারণে রাজ্য সরকার তালা লাগিয়েছিল এতে। সেই কারাগারকেই ঘষেমেজে সেটে পরিণত করেন টেরেন্স।
পাশে ছিল আরেক নির্মাণাধীন ভবন। ইনডোর শ্যুটিংয়ের জন্য সেট সাজিয়ে কাজ চালাতে হয়েছিল। কারাগারের বিষণ্ণ শীতল পরিবেশ টের পেতেন অভিনেতারাও। টিম রবিনস পরবর্তীতে বলেন, বছরের পর বছর কারারুদ্ধ জীবনের প্রতিধ্বনি টের পেতাম সেখানে। কত বন্দির কান্না, বেদনা তাড়া করে ফিরতো আমাদের।
গ্রীষ্মের রুদ্র তাপেই টানা তিন মাস শুটিং চলে। রুটিন ছিল সপ্তাহে ৬ দিন, ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ। সেই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ডারাবন্ট বলেন ‘প্রতিদিন যখন শ্যুটিংয়ের কাজ করতাম, তখন মনে হতো আমি প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছি। কিন্তু যখনই এডিটিং রুমে বসতাম, তখন সেসব যন্ত্রণার কথা ভুলে যেতাম।’ স্করসেসির প্রভাবঃ মার্টিন স্করসেসির Goodfellas থেকেই এই ছবির তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ডারাবন্ট। এই হলো মুভি তৈরীর টুকটাক পেছনের গল্প।
মুক্তির আনন্দ!
মুভি তৈরী করতে খরচ হয়েছিল ২৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে মুভিটা আয় করে মাত্র ১৮ মিলিয়ন ডলার! প্রযোজক-পরিচালকের মাথায় হাত! লাভের খাতা শূন্য থাকলেও অস্কার মনোনয়ন ঘোষণার সাথে সাথে আরও ১০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। সেই সাথে ৩,২০,০০০ কপি ভিডিও ক্যাসেট প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন ডলার বিক্রি হয় দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশনের।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৬