এবং বিভূতিভূষণ......
বিভূতিভূষণের একটা স্বপ্নের কথা তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন। সেই স্বপ্নটা আমি একাধিক বার দেখেছি, আগেও কয়েক বার একই স্বপ্ন দেখেছি -শুধু বিভূতিভূষণের যায়গায় নিজেকে দেখেছি। ঘটনাটা যারা ভুলে গিয়েছেন তাদের জন্য আবার মনে করিয়ে দিচ্ছিঃ-
বিহারের ঘাটশিলায় লেখক এক নির্জন জঙ্গলে ঘেরা বাড়িতে বাস করতেন। কোন একদিন সন্ধ্যায় বনের পথ ধরে আলো আধারিতে ঘরে ফেরবার পথে তিনি দেখতে পান কয়েকজন লোক জঙ্গলের পথে একটি মৃতদেহকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলের বশে লেখক এগিয়ে যান এবং মৃতদেহ বহনকারীদের জিজ্ঞাসা করেন- কে মারা গিয়েছে? কোন কথা না বলে মৃতদেহ বহনকারীরা মৃতদেহটি কাঁধ থেকে নামান এবং মুখের কাপড় সরিয়ে দেন। প্রচণ্ড বিস্ময় এবং ভয় নিয়ে বিভূতিভূষণ দেখতে পান- মৃতদেহটি আর কারও নয় বরং তাঁর নিজের। প্রচণ্ড ভয়ে দৌড়ে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। এই ঘটনার কিছুদিন পড়েই লেখক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।
পথের পাঁচালী সিনেমা দেখার বহু আগে আমি বিভূতিভূষণ এর জীবনীগ্রন্থ পড়েছি। তাই পথের পাঁচালী আমার কাছে শুধু কাশফুল, ধোঁয়া ওড়ানো ট্রেন আর অপু দূর্গা নয়। বিভূতিভূষণের হাত ধরে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখা সেই কোনকালে। মানুষকেও ভালোবাসতে শিখেছি ওঁর মতো করে। কোনও মানুষই যে নিপাট সাদা বা কালো হয়না তা তাঁর লেখা পড়েই শেখা।
পথের পাঁচালী যারা পড়েছে তাঁরা জানেন- অপু আর কেউ নয় স্বয়ং বিভূতিভূষণ। শিশুর মতো সরল সাদাসিধে লোকটা সাহিত্য জগৎ কে অনেক বেশী সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবী মারা যাওয়ার পর এতো মুষড়ে পড়েছিলেন যে বহুবছর প্রায় সাধকের মতো জীবন কাটিয়েছিলেন। এবং শুরু হয় পারলৌকিক চর্চা। দিনের পর দিন রাত জেগে প্ল্যানচেট করতেন। প্রচুর পড়াশোনা করতেন মৃত্যুর পরবর্তী জীবন নিয়ে। স্ত্রীর বিরহে পাগলপাড়া লোকটা সৃষ্টি করে গেছেন একটার পর একটা কালজয়ী উপন্যাস। প্রায় সমস্ত লেখাতেই কোথাও না কোথাও অলৌকিক জগতের রেফারেন্স আছে। ভূতের গল্প পড়ে এতো ভয় লাগেনি কখনো যতটা গা ছমছম করেছিলো 'আরণ্যক' উপন্যাসে টাঁরবাড়োর কথা পড়ে। নিশুতি রাতে গভীর অরন্যে আজও সেই দেবতা দাঁড়িয়ে থাকে। অরণ্যের আদি দেব ইনি, তাঁর নিয়মের এক চুল এদিক ওদিক হয়না জঙ্গলে। এই টাঁরবাড়োই হয়তো বুনিয়াপ হয়ে ফিরে আসে 'চাঁদের পাহাড়ে'। প্রকৃতির রক্ষাকর্তা, অরণ্যের রক্ষাকর্তা এরা। যাদের অভিশাপ লেগে সভ্যতার কংক্রিট ধ্বসে পড়ে জায়গায় জায়গায়।
'দেবযান' গল্পে ওঁর চোখে আমি মরণোত্তর জীবন দেখে এসছি। বিশ্বাস করেছি যে মানুষের কর্মফল তাকে বারবার ফিরিয়ে আনে মাটির কাছে। যত কলুষিতা বিহীন শুদ্ধ আত্মা তার পুনর্জন্মলাভ করার সুযোগ তত কম। পারমাণবিক কক্ষপথের মতো আত্মাও মৃত্যুর পর বিভিন্ন কক্ষস্তরে মুভমেন্ট করে। যত বিশুদ্ধ আত্মা তত উচ্চস্তরে তার স্থান। বহু আত্মা মৃত্যুর পরও জানতে পারেনা যে তার ইহলোকের সাথে সমস্ত যোগ ছিন্ন হয়েছে। বছরের পর বছর সে জীবিত কালের মতো দৈনন্দিন সব ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত থাকে।
'দৃষ্টিপ্রদীপে' পড়ে আকাশের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতাম। নীল আকাশের গায়ে অদৃশ্য সেই সিঁড়ি দেখা যায় যদি। কারা নাকি ওঠানামা করে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে কেউ কেউ পায় দেখতে, দুরের ওই ওদেরকে।
ফিরবো অপুর কাছে। অপু নয় অপূর্ব। পথের পাঁচালী উপন্যাসে প্রকৃতি হলো আসল নায়ক। কিন্তু অপরাজিত সবখানি অপূর্বকে ঘিরে। গ্রাম্য সারল্যমাখা শিশুবালক শহরজীবনে এসে হাঁফিয়ে ওঠে। ধোঁয়ার গন্ধমাখা,অস্বাস্থ্যকর ইস্কুল বাড়ি; ধনী পরিবারে আশ্রিতা মায়ের সাথে সিঁড়ির এককোনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছে নিশ্চিন্দিপুরের। পরবর্তী কালে কলেজ জীবনেও দেখা যায় হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে সে কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা। সারল্য তার এখনো শিশুর মতোই। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের পার্থিব জীবন হাজার ক্ষতবিক্ষত করলেও ভেতরটা আনকোরা অনাঘ্রাত থেকে যায়। বুকের ভেতরে যে একখানা কাকচক্ষু টলটল দিঘি আছে বাইরের হাজার ঝঞ্ঝাতুফান তাতে একফোঁটা ঢেউ ওঠাতে পারেনা। অপু এমনই একটা চরিত্র। বিভূতিভূষণও এমনই।
'কেদার রাজা' গল্পে পূর্ণিমা রাতে কুলদেবীর হেঁটে চলে বেড়ানোর কথা ভেবে গায়ে কাঁটা দেয়। বন্য একটা গা ছমছমে অলৌকিকতা ওনার সব লেখাতেই নিবিড় ভাবে মিশে আছে।
'চাঁদের পাহাড়'- শঙ্করের চাঁদের পাহাড় অভিযান কারো অজানা নয়। খাস কলকাতার তরতাজা ছেলে শঙ্কর। চাকরি সূত্রে যায় পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডায়। পর্তুগিজ পর্যটক আলভারেজকে সঙ্গী করে হীরের খনি আবিষ্কারে মেতে ওঠে সে। বাংলা সাহিত্যে এমন অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস আর কেউ লিখতে পেরেছে বলে আমার জানা নাই। প্রত্যক্ষদর্শী না হয়েও সুদূর আফ্রিকার এমন নির্ভুল সুন্দর বর্ণনা সত্যিই আশ্চর্যজনক। এই গল্প পড়ে কেনো জানিনা রবিঠাকুরের "গুপ্তধন" এর কথা খুব মনে পড়ে।
স্বর্ণখণিতে আবদ্ধ হয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের সেই আকুল চিৎকার
"আমি আর কিছুই চাই না- আমি এই সুরঙ্গ হইতে, অন্ধকার হইতে, গোলকধাঁধা হইতে, এই সোনার গারদ হইতে বাহির হইতে চাই। আমি আলোক চাই, আকাশ চাই, মুক্তি চাই।" শঙ্কর ও হীরের খনি থেকে খালি হাতেই বেড়িয়েছিলো। আসলে খোঁজার নেশাটাই আসল।
দুর্গমকে জয় করাই মূল উদ্দেশ্য এই গল্পের।
ওনার সমস্ত গল্পেই দেখি প্রোটাগনিস্ট বা মুখ্য চরিত্র ভীষন একা। প্রকৃতির মাঝে বা মানুষের মাঝে একলা একখানা লোক। সৃষ্টির সেই মহানাদ শুনেছে সে,জীবনানন্দের ভাষায় হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হেটেছে এই মানুষটাই। স্থবির, রিক্ত, ধূসর; মহাকালই আসল নায়ক লেখকের।।
(দুই বছর পর রি পোস্ট)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৪০