এক বাড়িতে বাস করে ৭০০ পরিবার............
সাধারনত গ্রামের একটা বাড়িতে ৪/৫ জন থেকে সর্বচ্চ ২০/ ৩০ জন মানুষ বাস করলেও বাংলাদেশের একটি বাড়িতে ৭০০ পরিবারের প্রায় ৬০০০/৭০০০ হাজার মানুষ বসবাস করছে যুগযুগ ধরে। এই বসবাসকারী মানুষেরা এই বাড়ির ওয়ারিশ এবং পরস্পরের ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন। যারা সবাই সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বী।
বাড়িটির নাম “মেহারণ দালাল বাড়ি” এর অবস্থান চাঁদপুরের মতলব থানার নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে। আসুন জানা যাক “মেহারণ দালাল বাড়ি”র কিছূ তথ্যঃ
** - বাড়িটির দৈর্ঘ্য দেড়কিলোমিটার।
** - এই এলাকার সকল ভোটার এই একই বাড়িতে বসবাস করেন।
** - বাড়ির চারদিক ঘিরে রয়েছে ফসলি জমি। কাছাকাছি নেই অন্য কোনো বাড়ি।
** - এ বাড়িতে সুপেয় পানির জন্য রয়েছে প্রায় ৬০টি চিউবওয়েল।
** - বাড়ির মধ্যে রয়েছে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আটটি মন্দির।
** - পুরো বাড়িটি ঘিরে ১টি স্বর্ণের দোকান, ৪টি সেলুন, ২টি ফার্নিচারের দোকান, ২টি মোবাইল সার্ভিসিং দোকান এবং ৪টি মুদি দোকান।
“মেহারন দালাল বাড়ি" এই এলাকার অনেক পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। অনেক পরিবারের বসবাস এখানে। বাড়িটির বাসিন্দা, জমিদার ব্বংশের উত্তরাধিকার মেহারন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌতম দাস জানান, “কয়েক পুরুষ ধরে আমরা এ বাড়িতে বসবাস করছি। আমাদের মাঝে কোনো ঝগড়া-বিবাদ নেই। আনন্দ-উৎসব আমরা একসাথে পালন করি।”
“মেহারণ দালাল বাড়ি” মুলত একটি প্রাচীন জমিদার বাড়ি। এখনও জমিদারদের দুটি ভবন- যা কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। একটির নাম 'দ্বারকাপুরি' এবং অপরটি 'আম্বিকা ভবন'। প্রথম ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে এবং পরেরটি ১৩৪৪ সনে। এক সময় জমিদার পরিবারের লোকজনের বাস দিয়ে শুরু এ দালাল বাড়ির। দো’তলা দু’টি ভবনতে এখনো জমিদারের বংশধররা বসবাস করেন। বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলো টিনের ঘর। সেখানে জমিদারদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন বসবাস করে। এখানে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষ জেলে, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও তারা সবাই জমিদার বংশের উত্তরসূরী। জমিদার বংশের পূর্ব্সূরিরা এখানে অনেক জমি দান করেছেন এবং জমিদারের আত্মীয় স্বজনগন এক সাথে এক বাড়িতে বসবাস করছেন। বংশ পরম্পরায় বাড়িটিতে বাসিন্দাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। অপরিচিত যে কেউ এ বাড়িতে প্রবেশ করলে বের হওয়ার রাস্তাই হারিয়ে ফেলবেন।
এ ছাড়া এই ওয়ার্ডেই ২৩শ ভোটার রয়েছেন। যাদের ভোটের মাধ্যমে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে থাকেন। নারায়ণপুর বাজার থেকে দালালবাড়িতে আসতে প্রায় ৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে ২৫-৩০ মিনিট সময় লাগে।
দালালবাড়ির চারদিক ঘিরে রয়েছে ফসলি জমি- সেই জমি চাষ করে সবাই সমানুপাতিক হারে ভাগ করে নেয়। এই বাড়ির কাছাকাছি নেই অন্য কোনো বাড়ি। ফলে এই বাড়ি উপজেলার সকলের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এখানকার মানুষ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। বাড়িটির প্রধান প্রবেশ সড়কটিই বেহাল। বর্ষা মৌসুমে বাড়ির চারপাশ পানিতে টইটুম্বুর থাকে।
এক সময় এই দালালবাড়িতে যেতে হলে নৌকা ছিল একমাত্র ভরসা। বর্তমানে এই সড়কটি আধা পাকা রাস্তা হলেও পুরো রাস্তা ভাঙা। কোথাও কোথাও মাটি ধসে পড়েছে। শুধু তাই নয়, এত জনবহুল একটি বাড়ির জন্য নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত দালালবাড়ির মানুষ।
স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত দালালবাড়ির মানুষ
ব্যবসায়ী উত্তম কুমার ও শিক্ষার্থী বাধন চন্দ্র দাস বলেন, ছোট একটি বাড়িতে হাজার হাজার মানুষের বসবাস। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষার সময় পুরো বাড়ি কাদা হয়ে থাকে। তখন চলাচল করতে খুব কষ্ট হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয় করা খুব জরুরি। এখানকার শিক্ষার্থীরা অনেক দূরে গিয়ে লেখাপড়া করতে হয়।
দালালবাড়ির বাসিন্দা একারশী ও পারবতী বলেন, নারীদের খুব কষ্ট করে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়। গর্ভাবস্থায় বেশি দুশ্চিন্তা থাকে। রাস্তা খারাপ থাকার কারণে কোনো গাড়ি ভেতরে আসতে চায় না। কাছাকাছি একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকও নেই। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি এখানে একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক তৈরি করে দেওয়ার জন্য।
জমিদার পরিবারের সদস্য উত্তম কুমার দাস দালাল (জমিদার) বলেন, আমাদের বংশধররা এখানে অনেক জমি দান করেছেন। এখানে একটি স্কুলও নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত ভবনে রয়েছে। নতুন করে একটি বিদ্যালয় করেছে কিন্তু ভবনের পরিসর ছোট হওয়ায় ছেলে-মেয়েরা ঠিক মতো লেখাপড়া করতে পারছে না।
চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ মেহারন দালালবাড়ির বিষয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর সাথে বৈরী সম্পর্কের কারণে তাকে সম্প্রতি বদলী করা হয়েছে।
ছবি ও তথ্যঃ ব্যাক্তিগত যোগাযোগ, স্যোশাল মিডিয়া/ফেসবুকে রাফাত নূরের একটি পোস্ট ও বিভিন্ন নিউজ থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:৩৯