।
।
।
।
(এই গল্পের যাবতীয় দায় ফালু নামের চরিত্রটির। আমি একজন শ্রোতা মাত্র। আমার বেশিরভাগ কথাই মনে মনে বলা। যেহেতু কেউ শুনেনাই, তাই গল্পের সঙ্গেও আমার কোনো যোগসাজস নাই।)
কই থাইকা যেন হন্তদন্ত হইয়া আসতেছিল ফালু। আমারে দেইখাই হঠাৎ থমকাইয়া দাঁড়াইয়া কইলো, আরে খবর হুনছস?
সেই সময় আমি নিজেরে নিয়া খানিকটা ভাবিত ছিলাম। বংশাল যাওয়ার তাড়া ছিল। মাল কিনতে হইবো। সেই মাল দিনে দিনেই সায়দাবাদ নিয়া আবার কুমিল্লার বাস ধরতে হইবো। তাই কোনো ভনিতা না কইরাই বলি, কোন খবরের কথা কইতাছস?
দেশের মন্দপরিস্থিতি নিয়া পত্র-পত্রিকায় আর টিভিতে নানা ধরনের সংবাদ দেখি। দোকানপাটের আড্ডায় বিভিন্ন পেশার লোকজনের মুখে বিচিত্র রকমের কথাবার্তা শুনি। মনে হয় সামনের দিনগুলাতে ব্যাপক ধরনের একটা কষ্টের মুখে পড়তে যাইতাছি। তার ওপর দুর্ভিক্ষ নিয়া প্রাইমমিনিস্টারের আগাম সতর্কবাণী শুইনা মোটামুটি অন্ধকারে আছি বলা যায়।
ফালু বেশ উত্তেজিত ভাবে প্রায় চিৎকারের ভঙ্গীতে বলতে থাকে, উত্তরের মেয়রের সচিবরে তো পরিচ্ছন্ন কর্মীরা মারতে মারতে পরায় ন্যাংটা কইরা ফালাইসে। ব্যাটারে দেখলাম ছিঁড়া সেন্টু গেঞ্জি পিন্দা জান লইয়া রাস্তা দিয়া দৌড় পারতাছে।
আজকাল সচিবরা সবক্ষেত্রেই ক্ষমতাবান। দেশের প্রধানমন্ত্রী থাইকা শুরু কইরা ইউপি সচিব পর্যন্ত সবাইরেই দেখি কথায় কথায় কেবল ক্ষমতার দাপট দেখায়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় এই দেশে যার ক্ষমতা আছে তারাই বুঝি থাকার যোগ্য। মাঝে মাঝে নিজেরে মনে হয় রোহিঙ্গা।
তো, এমন একজন মানুষ যার ক্ষমতার অভাব নাই, তার মতন দাপুটে মানুষ যদি পরিচ্ছন্ন কর্মীদের হাতে ক্যালানি খায় তাইলে বুঝতে হবে সামনে আরও ভয়াবহ দিন আসতেছে। সেই সঙ্গে ঘুম ভাঙা অজগরের মতোই আমার ভাবনায় কয়েকটা জিজ্ঞাসা আড়মোড়া দিয়া ওঠে। তার আশপাশে কি কোনোও পুলিশ ছিল না? এমন কি মেয়রের সচিব বইলা লোকটারে কেউ চিনে এমন কেউ সেখানে ছিল না? আর পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তো তারে মারার কথা না। তাদের সেই সাহসও হওয়ার কথা না। তাইলে কি টাকা পয়সা নিয়া কোনও ঝামেলা হইছে? চাইরো দিকে জিনিসপত্রের দাম যেই হারে বাড়তাছে। নিম্ন-আয়ের মানুষগুলার গলায় দ্রব্যমূল্য যেই ভাবে ফাঁসের মতো দিন দিন চাইপা বসতাছে, তাইলে কি তারা আবার জাইগা উঠতে শুরু করলো?
যদিও জিজ্ঞাসাগুলা আমার ভাবনায় ঘুরপাক খাইতেছিল এবং মুখ থাইকা বের হওয়ার আগেই আবার ফালু সরব হইয়া ওঠে। বলে, তারা বেতন পায় না অনেকদিন। এক জোট হইয়া বেতনের খোঁজ করতে গেছিল মনে কয়। আর তুইও তো জানস ক্ষমতা থাকলে বা ক্ষমতাবান কারও বিচির তলে থাকলেও বাঙ্গাল কেমন বাল-পাকনামী করে! অবস্থাটাও হয়তো তেমনই কিছু একটা হইবো।
আমি ফালুরে আরও খানিকটা উসকাইয়া দেওয়ার জন্য বলি, এইটা তো আমাগো রক্তের দোষ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হইলেও কোনো উন্নতি হইল না। বঙ্গবন্ধু যে কয়টা চোর আমাগোরে দিয়া গেছিলেন,সেইগুলার আণ্ডা-বাচ্চা দিয়া দেশটা ভইরা গেল। আর লগে লগে যেই হারে ওয়াজ-মাহফিল, দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ আর মসিদ-মাদ্রাসা বাড়তাছে, হ্যার লগে পাল্লা দিয়া ভাল মানুষের সংখ্যাটা কিন্তু বাড়তাছে না। ব্যাপারটা কি তুই বুঝতে পারতাছস?
ফালুর বাকি কথাগুলা শুনবার জন্য আমি ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হইয়া উঠি। চোখের সামনে ভাসতে থাকে এই অল্প কয়েক মাস আগে শ্রীলংকার লোকজন তাদের মন্ত্রী-এমপিগো উপরে কতটা ক্ষেইপা উঠছিল। কিভাবে তাগোরে প্রকাশ্যে নাস্তা-নাবুদ করতেছিল। মেয়রের সচিব পরিচ্ছন্নকর্মীদের হাতে চড়-থাবড়া, কিল-ঘুষি, লাথি-উষ্টা খাওয়ার মানে কিন্তু ভালো লক্ষণ না। আমাদের বর্তমান ক্ষমতাধরদের উদ্দেশ্যে এইটা একটা অশনি সংকেত বলা যায়। তাদের বোঝা উচিত আয়ু আর ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয় না।
ফালু আবার গড়াইতে থাকা ঝুরা পাথরের মতো কইতে আরম্ভ করে, বুঝস তো, আমরা কেমন চরিত্রের! তো, পরিচ্ছন্ন কর্মীরা যখন একজোট হইয়া বেতনের কথা জিগাইছে বা বেতন কবে হইবো জানতে চাইছে আর সচিব ব্যাটায় হয়তো ঝাড়ি মাইরা কোনো পাকনা কথা কইছে। ঘরে টাকা-পয়সা নাই, বাজারে আগুন, ও এম এসের চাইল-ডাইল, তেল-আটাও ঠিক মতন পাওয়া যায় না, তাই হয়তো সচিবের কথার লগে লগে কেউ পালটা ঘুষি মাইরা চেহারা ভচকাইয়া দিছে। আমরা বাঙ্গাল না! একজন শুরু করলে কি আর বাকিরা বইসা থাকে? মাইরের ঠ্যালায় ব্যাটার রঙ্গিলা পাঞ্জাবি যে কই হারাইয়া গেছে কারও খবর নাই। ভাগ্য ভালো ব্যাটায় বেল্ট লাগানো জিন্সের প্যান্ট পিন্দা আছিলো! মাটিতে ফালাইয়া যেই লাত্থি-উষ্টাগুলা মারছে, নাইলে প্যান্টটাও হারাইয়া যাইতো মনে কয়।
বুঝতে পারি ফালুর কুটনামী, চোগোলখোরি, গীবত অথবা সংবাদ সরবরাহ যেই নামেই অভিহিত করি না কেন তা সাঙ্গ হয়। আমি মনে মনে বাংলাদেশের তথা আমজনতার আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা কইরা ভিতরে ভিতরে কুকরাইয়া যাইতে থাকি।
হয়তো আমার ডুবন্ত অবস্থা টের পাইয়া যায় ফালু। অথবা আমার অন্তর্গত ভাঙচুরের ফোকাস চেহারাতে তেমন একটা ছিল না। বা কিছু না বুইঝাই ফালু বলে, আয় চা খাই। আমার খুব খুশি খুশি লাগতাছে! বইলা, আমার হাত ধইরা চায়ের দোকানের দিকে যাইতে আকর্ষণ করে সে। তারপর স্বভাবসিদ্ধ প্রগলভতায় বলতে থাকে, আমার দেশের মানুষ যদি এমন কইরা প্রতি জেলায় থানায় আর ইউনিয়নে জাইগ্যা ওঠে, তাইলে সত্যিই পথ হারাইবো না বাংলাদেশ। যেই চোরেরা দেশের ব্যাংক-ব্যবসা, বাজার-কারখানা লুট কইরা বিদেশে সেকেন্ড হোম বানাইছে, সেখানকার ঘরবাড়ি বেইচ্যা ফেরত দিতে বাধ্য হইবো, আর এমনটা যদি না-ও হয়, তাইলে অন্তত লুটপাটের স্ট্র্যাটেজিটা বন্ধ হইবো।
আমাদের আশপাশ দিয়া নগরের ব্যস্ত সড়কে সাইকেল, রিকশা, নানা পদের গাড়ি হুসহাস আর শো-শা শব্দে আসা যাওয়া করতেছিল। সেই দিকে কিছুক্ষণ তাকাইয়া কিছু একটা হয়তো ভাবে ফালু। তারপর আমার দিকে ফিরা আবার বলে, যাবি যখন এক কাপ চা খাইয়া যা। আবার কোনদিন দেখা হয় না না হয়। নাজিমের দোকানে চা’টা ভালো হয়।
দূরত্ব অনুভব কইরা বলি, না, অতটা দূরে যামু না। টাইম নাই। আমারে শীঘ্রই বংশালে যাইতে হইবো।
আমার কথা পাত্তা দেয় না ফালু। বলে, ভাই, এক কাপ চা-ই তো। এইটা দিয়াই না হয় দেশের মানুষগুলার জাইগা উঠনটা সেলিব্রেট করি!
আমার খুব ভালো লাগে ফালুর কথা। তার সঙ্গে একাত্ম হইয়া মনে মনে বলি, ফালু, এই দেশে তর মতন আরও কয়েক কোটি ফালু প্রয়োজন। বাহাত্তরের পর থাইকা এই পর্যন্ত দেশের উঁচু আসনগুলায় রাক্ষস ছাড়া আর কিছুই দেখিনাই।
কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা
২৪/১০/২০২২ইং।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:০৭