প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প-ভাবনা#৪
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-১
কয়লাপোড়া দীর্ঘশ্বাসের রঙ-২
দূর থেকেই দেখা যায় মাটি দিয়ে ভরাট করা দীর্ঘ পথ যেন আর একটু উঁচু হলেই ছুঁয়ে ফেলতে পারতো আকাশের নিটোল বুক। রেল রাস্তার ওপার সব কিছুই অদৃশ্য। শুধু আকাশ আর আকাশের নীল মিশে আছে। যেন একটি সুউচ্চ পাড় অনেক দূর থেকে ঘিরে ফেলেছে সিদ্ধেশ্বরী আর গুণপুরের আশপাশের গ্রামগুলোও। মতিন অবাক হয়ে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলে সেদিকে। কখন থেকে শুরু হয়েছিল মাটি ভরাটের কাজ? কবেই বা অতটা দীর্ঘ হয়ে উঠেছে মাটির তৈরি বেড়া? প্যাট্রিক সায়েবের ভাষায় যাকে বলা যায় ওয়ল। একবার সায়েবের মুখে গল্প শুনেছিল যে, চিন নামের একটি দেশের পুরোটাই এমন পাথর দিয়ে বেড়া দেয়া আছে। যে বেড়া পার হয়ে অন্য দেশের সেনারা ঢুকতে পারতো না সে দেশে। তাহলে কি এই রেল রাস্তা তাদের আর আশপাশের গ্রামগুলোকে বেড়া দিয়ে আটকে ফেলল?
গুণপুরের পরের গ্রামটাই হচ্ছে পঞ্চবটি। যেখানে তার কালি ফুপুর বিয়ে হয়েছিল। ছোট থাকতে একবার বাবার সঙ্গে সে গিয়েছিল কালি ফুপুর বাড়ি। এখন হয়তো সেই গ্রামটা রেল রাস্তার ওপার পড়েছে। দু গ্রামের লোকজন রেল রাস্তা পার হয়ে আসা যাওয়া করবে। তখন যদি রেলগাড়ি চলে আসে লোকজন কী করবে? নানা অদ্ভুত ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবার কারণে চৈত্রের খাখা রোদ্দুরেও যেন তার শরীরে কোনো তাপের ছোঁয়া লাগে না।
রেল রাস্তার ওপরের দিকের ঢাল নিচের দিকে যেখান থেকে আরম্ভ হয়েছে তার পাশেই সরু খালের মতো কেটে ফেলা হয়েছে মাটি। বর্ষাকালে কি এ মাটি গলবে না? হাজারো জিজ্ঞাসার বোঝা নিয়ে ঢাল বেয়ে সে উঠে যায় রেল রাস্তার ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গেই আরো অবাক বিস্ময়ে দেখতে পায় মাটির ওপর চওড়া আর ভারি কাঠের টুকরো দু-আড়াই হাত পরপর দূরত্বে বসানো আছে বিছিয়ে রাখা পাথরের টুকরোর ওপর। সেই কাঠের ওপর পাশাপাশি দুটো লোহার পাত সামনে পেছনে যেখানে চোখ যায় চলে গেছে সমান্তরাল। আগে পিছে খানিকটা বাঁক খেয়ে যেন দুটো লোহার মাথা মিশে গেছে একই সঙ্গে।
প্যাট্রিক সাহেবের বইটাতে এমন অনেক দৃশ্য আছে। রেলগাড়ির দৃশ্য, চাকা গড়িয়ে যাবে পেতে রাখা দীর্ঘ লোহার ওপর দিয়ে। আশপাশে উড়তে থাকবে ঘন কুয়াশার মতো ধোঁয়া। অদ্ভুত একটি ভালো লাগা নিয়ে সে তাকিয়ে থাকলো রেল লাইনের দিকে। কুলু বাড়ির আস্তাক এখানেই কোথাও কাজ করে হয়তো। কিন্তু মাটি কাটার কোনো লোকজন দেখতে পেলো না সে। তার বদলে দেখতে পেল কয়েকজন কালো মতো লোক কিছু একটা দিয়ে লোহার পাশে কিছু করছে। আর দুজন সাহেব মাথায় হ্যাট লাগিয়ে হাত তুলে দূরের কোনো একটা কিছু দেখাচ্ছে। তার কিছুটা ভয় ভয় করছিল, ওরা কিছু বলবে না তো? ঠিক তখনই মৃদু একটা ঘড়ঘড়ানো বা কোনো শক্ত কিছুর তীব্র ঘর্ষণের একটি শব্দ শুনতে পেয়ে পেছন পাশ ঘুরে দৃষ্টি ফেরায়। রেলের দুটো লোহার ওপর দিয়ে একটি চৌকো কিছু ঘড়িয়ে আসছে। যাতে মুখোমুখি দুটো মানুষ বসে আছে। একই সঙ্গে দুজন মিলে কিছু একটা টানাটানির ফলে শা শা করে তেড়ে আসছে তাদের বাহনটা। আর তা দেখে সে লাফিয়ে লাইন থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ায়।
আজ কেবল বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়। লোক দুটো কি চৌকো জিনিসটাকে চালাচ্ছে এভাবে? নৌকা বাইচের সময় বৈঠা টেনেটেনে যেমন নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। লোক দুটোকে ঠিক এমনই কিছু একটা করতে দেখেছিল সে। তাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদা সাহেব লোকটি একটি হাত উঁচিয়ে বলে উঠল, হাই ম্যান! লাইক ইট?
আজকাল অনেক কথাই সে বুঝতে পারে বেনিয়াদের ভাষা। কিন্তু মুখ ফুটে পালটা তেমন কিছু বলতে পারে না। তবে চটপট কয়েকটা ছোটছোট শব্দ বলতে পারে। লোকটির হলদেটে দাঁত যেন হাসিটাকে ম্লান করে দেবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো চেহারাটাকেও নোংরা করে দিয়েছে আরো। সরকার বাড়ির বাতেন জন্মের পর কখনো দাঁত পরিষ্কার করেছে কিনা তার পরিবার বা আশপাশের কেউ বলতে পারবে না। এমন কি মতিনও ব্যাপারটা কখনো লক্ষ্য করেছে বলে মনে পড়ে না। সে বাতেন কথা বলবার সময় বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ালেও মনে হয় তার মুখের দুর্গন্ধ উড়ে এসে নাকে লাগছে। অদ্ভুত বাহনটির আরোহী সাহেবটির ব্যাপারেও তার এমন কথাই মনে এলো প্রথম।
যেখানে সাদা-কালো লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে গিয়ে বাহনটি থেমে গেল। কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে তারা আলাপ করতে করতে আরো পেছনের দিকে হাঁটতে লাগলো। মতিন ফের আগে পিছে আরেকবার দেখে নিয়ে লাফিয়ে উঠে আসে রেল লাইনের ওপর। তারপর ভারি কাঠের ওপর পা দিয়ে একটি থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগল। ব্যাপারটা বেশ মজার মনে হলেও তার মনে হচ্ছিল বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।
বেলা অনেকটাই হেলে গেছে পশ্চিমে। সে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হয়তো ডুবে যাবে সূর্যটা। অবশ্য তেমন কোনো সমস্যা নেই অন্ধকার হলেও। অন্ধকার যতটাই গাঢ় হোক না কেন খোলা আকাশের নিচে মোটামুটি পথে দেখে ভালোই চলা যায়। মতিন রেল রাস্তার ঢাল বেয়ে নামার সময় হঠাৎ পা হড়কে গড়িয়ে পড়ল। কিছু বুঝে উঠবার আগে কয়েকটা গড়ান খেয়ে উঠল। কেউ দেখবার নেই তাই এ নিয়ে তার বিব্রত হবারও কিছু ছিল না। একটি জমির চওড়া আল ধরে সে হেঁটে চলে তার গাঁয়ের উদ্দেশ্যে। আজ রাতের বেলা কবিয়াল জমির গাজীর বাড়ি আসর আছে। তার বেশ ইচ্ছে ছিল গান গায়। চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু জমির গাজী বলে দিয়েছে তুই আর আওনের কাম নাই। গানবাদ্য তর লাইগ্যা না।
এরপর অনেক ভেবেছে সে, যদি গানবাদ্য তার জন্যে না হয়ে থাকে তাহলে কোনটা তার জন্যে উপযুক্ত? যে কাজেই সে আগ্রহ করে গিয়েছে সেখানেই তাকে এমন ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। তবে প্যাট্রিক সায়েব একবার বলেছিলেন যে, তার আরো বেশি বেশি পড়া উচিত। পড়াশুনায় ফাঁকি দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কিন্তু সে কোনোভাবেই সায়েবকে বোঝাতে পারে না যে, সে পড়াশুনায় কোনো অবহেলা করে না। যা এ পর্যন্ত শিখেছে তার সবই মনে আছে। শুধু বলবার সময় কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় সব কিছু।
কুটিলার পালপাড়া পেরিয়ে আসবার সময় হঠাৎ মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঢাকা একজন নারী তাকে পাশ কাটাবার সময় ঘুরে মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে ওঠে, আরে মতিন, কইত্থে আইলি? কালি হুবুর বাইত গেসলিনি?
সেরাজ ব্যাপারীর মেয়ে রমেসাকে শুরুতে চিনতে পারেনি মতিন। কথা শুনে মুখের দিকে ভালো করে তাকাতেই চিনতে পেরে বলে, নাহ। রেল রাস্তা দেইখ্যা আইলাম। তুমি কই যাও অবেইলে?
-গুণপুর। মাইয়াডার শইল ভালা না হুনলাম। কুদ্দুসের মায় খবর কইল।
সেরাজ ব্যাপারীর এই মেয়েটা এ পর্যন্ত চারটি পুরুষ বদল করে ফেলেছে। কিন্তু কারো সঙ্গেই তার বনিবনা হয় না। কোনো পুরুষই তার মনোমতো হয়নি। গ্রামের অলস আর ছিদ্রান্বেষী লোকজন এ নিয়ে প্রায়ই বলাবলি করে। সে অনেকবারই এসব শুনেছে। ইদানীং এসব শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া কেউ যদি কারো সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পারে তাহলে শুধুশুধু একখানে নিজেকে জড়িয়ে রেখে যন্ত্রণা আর নানা লাঞ্ছনায় খেয়ে-পরে-ঘুমিয়ে জীবন পার করবার কোনো মানে হয় না। মানুষটির যদি আগ্রহ থাকে তাহলে তার মন যতক্ষণ চায় ততক্ষণ মনের মতো মানুষের সন্ধান করতেই পারে। তবে মেয়েরা যখন এসব নিয়ে কথা বলে, তখন তা যেমন অপমানজনক তেমনই উদ্ভট আর হাস্যকরও হয়ে ওঠে অনেক সময়। সেদিনও বড় চাচি তার মায়ের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলছিলেন, সেরাজ মোল্লার মাইয়াডার কাম আছিল একটা ব্যাহা-কালা ব্যাডা। তাইলেই ব্যাডায় কিছু হুনলো না অইলে, কিছু কইলো না অইলেও। বেডিমাইত মন-মর্জিমতন চললে আর হাঙ্গা-বিয়ার কোন কাম?
মতিন জানে মেয়েদের আলাপ শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত গোপন আলাপে গিয়ে থামে। সে সব শুনলে এমনিতেই তার কান ঝাঁ ঝাঁ করে বলে তাদের আলাপের সময় ধারে কাছে থাকে না। রমেসাকে সে বলল, আউজ্জা হিরা আইবানি? না থাইক্যা যাইবা?
-আমার হিরা আওন আর না আওন। কোনোরহমে রাইত পার করন!
মতিন এ কথার কী উত্তর হতে পারে ভেবে পায় না। কথাগুলো ঠিকমতো বোধগম্য হয়নি বলে খানিকটা থম ধরে থাকে যেন। তখনই রমেসা আবার বলল, আমরার বাড়ি দিয়া যাইস। ছোড চাচিরে কইস আমার ক্যাওয়ারডা জানি বাইন্দা থোয়।
-আইচ্ছা।
বলে, বাড়ির উদ্দেশ্যে সে হাঁটতে আরম্ভ করে। আর হাঁটতে হাঁটতে সে টের পায় যে, রেল রাস্তার ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বার ফলে শরীরের নানা জায়গায় একটু একটু করে ব্যথা করছে। এ নিয়ে তার তেমন একটা দুর্ভাবনা হয় না। খুব বেশি হলে রাতের বেলা শরীরের ব্যথায় ঘুমটা কম হবে। সকাল বেলা মরিচের ভর্তা দিয়ে খানিকটা কাঞ্জি খেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তার মা প্রতিদিন ভাত রান্নার সময় এক মালা করে আধা সেদ্ধ চাল কাঞ্জির হাঁড়িতে ঢেলে রাখেন। হাঁড়িটা যখন পাঁচ-সাতদিনের চালে প্রায় পূর্ণ হয়ে যায় তখন জাউয়ের মতো করে রান্না করেন। সে সময় একটা টকটক আর মিষ্টি গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে ম ম করতে থাকে পুরো বাড়ি। সেখান থেকেই বেশ কিছুটা নিয়ে চিবিয়ে খেলেও বেশ সোয়াদ। শরীরটাও ব্যথা-বেদনা ভুলে কেমন কেমন যেন হয়ে ওঠে।
সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সে দেখতে পায় আজগর একটি গাই নিয়ে গোয়াল ঘরে ঢুকছে। আর তখনই তার মনে পড়ে যায় যে, দুপুরের আগে যে সে বের হয়েছে না হয়েছে ঘাস তোলা না হয়েছে গাই দুটোর যত্ন গোসল। এ নিয়ে নিশ্চয় আজগর আজ কথা শোনাবে অনেক। দু একটা চড়-থাপ্পড়ও দিতে পারে। এমন চড়-থাপ্পড়ে তার কিছু আসে যায় না। সেই ছোটবেলা থেকেই কারণে অকারণে ভাইয়ের হাতে মার খেয়ে আসছে। এখন ইচ্ছে করলে সে নিজেই উলটো দু চার ঘা লাগিয়ে দিতে পারে বড় ভাইকে। কিন্তু মা বাবা দুজনই বলেছেন যে, বড় ভাইয়ের গত্র হাত তুলন নাই। নইলে কি আর সে মার খায়?
বাবা-মায়ের কথা রাখতে গিয়েই সে হজম করছে এসব অত্যাচার। কিন্তু একটা সময় সে চলে যাবে এমন শয়তান ভাইকে ছেড়ে। সেই ছোটবেলা থেকেই মনেমনে ঠিক করে রেখেছে। তবে আজ মার খেলে তার সত্যিই খুব খারাপ লাগবে। মমতাজ যদি দেখে, তাহলে মিচকি শয়তানের মতো মিটমিট করে হাসবে আর তা দেখলে আজগরও আরো গলা উঁচিয়ে তাকে ধমক-ধামক দিতে আরম্ভ করবে।
বেলা ডুবে গেলে সে চুপি চুপি মায়ের কাছে খাবার চেয়ে খেয়ে নেবার পরিকল্পনা আঁটে। আর যাই হোক, ভাইয়ের হাতে তাও আবার শয়তানের মতো ভাবিটার সামনে মার খেতে চায় না। দরকার হলে আজগর যতক্ষণ বাড়ি থাকবে ততক্ষণ সে ঘরে ঢুকবে না।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৪ রাত ১১:৫১