বেশ কদিন ধরে আমার মনটা অন্যান্য বারের চেয়েও ভয়াবহ রকমের খারাপ ছিল। খারাপ লাগার কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট করে দু একটি কথা বললেও হয়তো সবটা ফুটে উঠবে না। তাই আমি কাউকে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম না। ভেতরে ভেতরে যেন আমি ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম। ফুরিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার মতো সামনের দিনগুলোতে যেন অপেক্ষা করছিল অনন্ত অন্ধকার। সেটা যে কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণার আবহে আমাকে ক্রমশ অসাড় করে ঠেলে দিচ্ছিল সেটা তুই বুঝতে পারবি না। হয়তো বা সবটুকু তোকে বোঝাতেও পারবো না।
-আচ্ছা না বুঝলে নাই। তার চেয়ে বরং তুই পুরো ঘটনাটা খুলে বল আমাকে।
তুরিনকে কথাগুলো বললেও যেন আমার কথা সে ঠিক বুঝতে পারলো না বা গা করলো না। ভাবছিলাম, সিদ্ধার্থর সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই আমার তেমন বনিবনা হচ্ছিলো না। ভেতরে ভেতরে একটি অগ্নিগিরিকে যেন হজম করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলাম দিনরাত। কিন্তু তুরিনের কথা শুনবার আগে তার মুখের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ মনে হয়েছিল আসলে আমার তেমন কোনো সমস্যাই নেই। আমি তো দিব্যি হাসতে পারছি। রেস্টুরেন্টে গিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছি। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বই বা ম্যাগাজিনের পাতায় ইচ্ছে করলেই চোখ বুলাতে পারছি। কিন্তু তুরিনের মুখের দিকে তাকালেই আমার কান্না পাচ্ছিল। তবু জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলাম সব কিছু খুলে বলতে। আসলে আমি চাচ্ছিলাম, তুরিন কিছুটা বলে যেন ভারমুক্ত হতে পারে।
ব্যাগের ভেতর হঠাৎ সেল ফোনটা বেজে উঠলে আমার ভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যেতে থাকে। তুরিনের মুখ থেকে কথাগুলো কী উপায়ে বের করবো সে ভাবনাটা প্রায় গুছিয়ে এনেছিলাম। অথচ ফোনটা বেজে উঠে কেমন তালগোল পাকিয়ে দিয়ে গেল মনে হচ্ছে।
সেলফোনটা বের করতেই দেখা যায় সিদ্ধার্থের নাম্বার। আমার ইচ্ছে করছিলো না এই বদ লোকটার কল রিসিভ করতে বা এ মুহূর্তে কথা বলতে। আবার মন চাইছিল না সে জানুক আমি ফোনের কাছাকাছিই আছি। তাই কেটে দিতেও পারছিলাম না।
আমার সিদ্ধান্তহীনতা তুরিনের দৃষ্টি এড়ায় না হয়তো। সে কেমন বিরক্তি মাখা স্বরে বলে উঠলো, ফোনটা না ধরলে কেটে দিচ্ছিস না কেন?
বললাম, সিদ্ধার্থ ফোন করেছে। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না এখন। আবার এও চাচ্ছি না সে জানুক আমি ফোনের কাছাকাছি আছি।
-তাহলে ওঘরে চল। এটা থাকুক এখানে।
তুরিন হঠাৎ বসা থেকে উঠে কেমন কাত হয়ে গিয়ে কোমরের কাছটা খামচে ধরলো। আমি চট করে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেই সে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে হাসে। আড় চোখে দেখি ম্যাক্সির নিচে কিছু একটা সামলাতেই সে এভাবে খামচে ধরে রেখেছে। বুঝতে পেরে বললাম, এভাবে মাঝে মাঝে গিঠটু খুলে যায় নাকি ইচ্ছে করেই খুলে রাখিস?
কিছু না বলে সে অবস্থাতেই তুরিন আমার পিঠে হাত রেখে আরেক রুমের দিকে যেতে খানিকটা চাপ দেয়। ঠিক তখনই দুষ্টু বাচ্চাদের চিৎকারের মতোই স্থানকাল বিবেচনা না করে ফোনের রিংটোন সরব হয়ে ওঠে আবার।
অন্যঘরের দিকে আগাতে আগাতে তুরিন হঠাৎ আমার পিঠ খামচে ধরে জামার ওপর দিয়ে। আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখতে পাই কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে সে। এক হাতে আমার পিঠ আরো খামচে ধরতে গিয়েই হয়তো ছিঁড়ে ফেলে ব্রার হুক। ফলে হঠাৎ ঘুরেই যে এক হাতে বা দু হাতে তাকে ধরে ফেলবো সে সময়টা পাওয়ার আগেই মেঝেতে পড়ে যায়। তবু মাথাটা যাতে দেয়ালের গায়ে ঠুকে না যায় সে বিপদ থেকে রক্ষা করতে তার দু কাঁধ আঁকড়ে ধরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার পাশে মেঝেতে বসে পড়ি।
কেন এমন হলো তা জিজ্ঞেস করবার আগেই তুরিন আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। আমিও তাই তাকে আরো ভালো মতো জড়িয়ে ধরি বুকের সঙ্গে। পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবছিলাম, কিছু বলার থাকলে এখনই হয়তো বলবে। অথবা কিছুক্ষণ কাঁদতে পারলেও অনেকটা ভাল বোধ করবে। এভাবে কত তুরিন যে, চার দেয়ালের আড়ালে দিনরাত কাঁদছে কতো অজ্ঞাত কারণে তার হিসেব কখনো দেয়াল ফুঁড়ে বাইরে যেতে পারে না। মানুষ কেবল তুরিনদের ঠোঁটে লাগানো লিপস্টিকের গাঢ় প্রলেপটাই দেখে। দেখে না তার আড়ালে ঠোঁট দুটো কতটা ফ্যাকাসে আর বিশুষ্ক হয়ে থাকে দিনরাত।
-আমরা পড়াশুনা করেই কি নিজেদের এত বড় ক্ষতিটা করলাম?
ফোঁপাতে ফোঁপাতে কথা বলে ওঠে তুরিন। যদি মূর্খ থেকে যেতাম তাহলে মান-অপমান বোধ লাজ-লজ্জা কম হতো। পারতাম কুকুরের মতো লাঠির নিচ দিয়ে হলেও খাবারের থালায় মুখ দিতে। তিন বেলা খাবার আর দুটো কাপড়ের জন্য হজম করে নিতাম সব কিছু।
আমার ভেতরে ভেতরে বমির বেগের মতো মোচড়াচ্ছিল জিজ্ঞাসাটা, কী হয়েছে খুলে বলবি? কিন্তু তবু নিজেকে থামিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিলাম। হতে পারে আমার জিজ্ঞাসায় সে আবেগটাকে সামলে নিয়ে সচেতন হয়ে উঠবে। তখন হয়তো মনের কপাটে অর্গল তুলে দেবে। শিক্ষা মানুষের ভালর চেয়ে মন্দটাই যেন করে বেশি। অনেক দিক দিয়ে তাকে সংস্কার মুক্ত করতে গিয়ে আরো বেশি জড় আর সংযত করে ফেলে। অনেক কিছুই বুঝে-সুঝে চেপে যেতে উৎসাহিত করে। শেখায় জীবনের জটিলতাকে কীভাবে আড়াল করতে হয় সুকৌশলে।
তুরিনের কথা শুনতে শুনতে আমার কাছে যেন নারী জীবনের আরেকটি অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ খুলে যেতে থাকে। মনে পড়ে রোশনারা ফুপুর মেয়ে আলোর কথা। স্বামীর বাড়ি থাকলেও বোনেদের পরামর্শ ছাড়া একদিনও চলতে পারতো না মেয়েটা। আর বোনেদের কথা মতো স্বামীকে টাইট দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে গিয়েছিল। শত চেষ্টা করেও সংসার বাঁচাতে পারে নি। এমন কি শেষ পর্যন্ত মা-মেয়েতে ছেলে পক্ষের সবার হাতে-পায়ে ধরবার মতো হীন কাজেও পিছিয়ে ছিল না। শিক্ষা থাকলে তাদের কিছুটা হলেও হয়তো আত্মসম্মানবোধ থাকতো। আর সেই শিক্ষাটাই আবার তুরিনের মতো কারো কারো জীবনে সমস্যা ডেকে আনছে।
কী অদ্ভুত এই নারী জীবন! ভাবতে গেলে কখনো কখনো আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এতটুকু একটি জীবন অথচ হাজারো আপসের ভেতর দিয়ে চলতে হয় একটি মেয়েকে। পান থেকে চুন খসলে তার খেসারতও গুনতে হয় নারীই। মাঝে মাঝে নিজের নানা সংকটের কথা ভাবতে গেলেও আমার মনে হয় যে, মানুষ উভলিঙ্গের হওয়াটাই বরং জরুরি ছিল। নারী-পুরুষের একে অন্যের প্রতি নির্ভরতা আছে বলেই জীবনে এত জটিলতা।
তুরিনের ফোঁপানোর শব্দ কমে আসবার সঙ্গে সঙ্গে তার কথাও কমে আসতে থাকে। আমার মনে হয় কথাগুলো তার আরো আগেই বলা উচিত ছিল। হয়তো আজও বলতো না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিল বেচারি।
বেশ কিছুক্ষণ পর তুরিন কিছুটা ধাতস্থ হলে তাকে তুলে দাঁড় করাই। বলি, ওয়াশ রুমে চল। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দে একটু!
কোমরের কাছ থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছিল বলে সে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কালো রঙের পেটিকোটটা নেমে এসে তার নগ্ন পা দুটো ঢেকে দেয়। আর তা দেখে সে নিজেই হেসে ওঠে হঠাৎ। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আগেকার সেই যন্ত্রণার ছাপ ফুটে ওঠে চেহারায়। কোমরের কাছটাতে হাত দিয়ে সে একবার ককিয়ে ওঠে। আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠি, ওখানটায় কী হয়েছে আমাকে বল, নয়তো তোর ম্যাক্সিটা ছিঁড়ে ফেলবো।
বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে দিতে সে বলল, কাল সে আমাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল। দেখ কেমন লাল হয়ে আছে এখনো। বলে, সে বুকের কাছের বোতামগুলো খুলে দেখায়। তারপর আবার বলে, কোমরের কাছটা খাটের কোণায় লেগেছিল। পুরো জায়গাটা ব্যথা হয়ে আছে বলে ফিতেটা বাঁধতে পারছিলাম না।
আমার মাথার ভেতরটাতে যেন হঠাৎ করেই দাবানলের উত্তাপে ফেনা উঠতে আরম্ভ করছিল। বললাম, শুয়োরটার ঘরে এখনো পড়ে আছিস তুই? নিজেই টের পাচ্ছিলাম কণ্ঠস্বরের তীব্রতা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই।
-আহ আস্তে বল! পাশের ফ্লাটে লোকজন আছে।
তুরিন মুখ মুছে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আবার বলে, বাবা-মাকে বলেছিলাম।
-কী বললেন তারা?
-মা বলল, এমন যাতে আর না হয়। মানিয়ে চলতে।
তুরিনের কথা শুনে আমার খুবই লজ্জা হচ্ছিল। লজ্জা বোধ করছিলাম কেন আমিও নারী হয়ে জন্ম নিলাম। কেন আরেকজন নারীর পেটেই আমাকে আসতে হলো! আমার ইচ্ছে হয় এমন মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলো আছে বলেই আমাদের সমাজটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলো না। নারীরা পারলো না মেয়েমানুষের দুর্নাম ঘুচাতে। তবু আমি তুরিনের মুখ থেকে জবাবটা শুনতে চাই। বলি, তুই কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
-আমার আবার কীসের সিদ্ধান্ত? মা তো বলেই দিয়েছেন আমাকে কী করতে হবে!
বলতে বলতে তার দুচোখে আবার পানি টলমল করতে দেখা যায়।
কথা শুনে আমার এতটাই রাগ হয় যে, আমি সব কিছু ভুলে যাই। এমন একটি মেয়েকে এতকাল আমার প্রাণের বন্ধু বলে বিশ্বাস করে এসেছি, যে কি না এতটা শিক্ষার পরও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অন্ধ রাগে আমি ভুলে যাই তুরিনের রুমে আছে আমার সেল ফোন আর ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট আর টিকেটের কথা।
সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেগে লাফিয়ে নামতে নামতে বিস্মিত সিকিউরিটির বিস্ফারিত দৃষ্টি আর হা করা মুখের সামনে দিয়ে আমি প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসি রাস্তায়।
সন্ধ্যা বেলার ফুটপাত ধরে হাঁটবার সময় বাইরের খোলা হাওয়া আমাকে খানিকটা প্রবোধ দেয় যেন। পাশ কাটিয়ে যাওয়া লোকজনের দৃষ্টিতে হীরকের নৃত্য দেখে অনুভব করতে পারি ঢিলে ব্রার কাপ দুটো প্রায় গলার কাছে উঠে এসেছে। আর তখনই পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কতগুলো ইঁচড়ে পাকা কিশোরের মুকে উলু ধ্বনি শুনে ফিরে তাকাই। তাদের সবার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বুঝতে পারি ওড়নাটাও রয়ে গেছে তুরিনের ওখানে। সঙ্গে সঙ্গেই খোলা ফুটপাতের ওপর এক ধরনের অস্বস্তি আমাকে জাপটে ধরে আড়াল প্রত্যাশী করে তোলে
মোটামুটি চওড়া একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে পেটের কাছে হাত ঢুকিয়ে গলার কাছে উঠে আসা ব্রা-টাকে টেনে নামাই। তখনই একবার সেটা বের করে বদমাশগুলোর মুখের ওপর ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে হলেও আমি যে দেশে জন্ম নিয়েছি, যে সমাজ আর আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি, সেখানে এমন কিছু করা খুব সহজ ব্যাপার নয় বলেই সেটাকে টেনেটুনে সামলে নেই আবার।
একবার মনে হলো ফিরে গিয়ে তুরিনের ওখান থেকে আমার ব্যাগ আর ওড়নাটা নিয়ে আসি। কিন্তু তখনই আবার জেদ চেপে বসে যে, যেখান থেকে বের হয়ে এসেছি সেখানে আর ফিরে যাবো না। তখনই পা চালাই সামনের দিকে। এভাবে পথ চলায় অভ্যস্ত নই বলে বেশ কিছুটা অস্বস্তি হলেও বোধটাকে আর পাত্তা দিতে ইচ্ছে করে না। সেই সঙ্গে ভুলে যেতে ইচ্ছে হয় আমার যে জেন্ডার সেটাও।
(সমাপ্ত)