আমরা বাংলা ব্লগকে লেখালেখির জন্যে একটি মুক্ত প্লাটফর্ম হিসেবে পেলেও এর সঠিক সুযোগটি হয়তো কাজে লাগাতে পারছি না। তা পারছি না আমাদের অনেকের ভুলের জন্যে সে সঙ্গে ততটা গুরুত্ব না দেবার কারণেও হয়তো খুব একটা সহায়ক হিসেবে পাচ্ছি না।
আমি যখন ক্লাস টু-এর ছাত্র, তখন দ্বিতীয় শব্দটিকে উচ্চারণ করতাম দৃতীয়/ দ্রিতীয়। ক্লাসের ইংরেজি শিক্ষক কাসু আপা (পরে জেনেছিলাম কাজী সুরাইয়া।) হঠাৎ একদিন ধরে বসলেন। বললেন, কী বললে আবার বল। কোন শ্রেণীতে পড়?
মনের সুখে আবার বলেছিলাম, দ্রিতীয়/দৃতীয় শ্রেণীতে।
-এটা হবে দ্বিতীয়। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার গাত্রে আপার হাতের বেত সপাং সপাং নৃত্য আরম্ভ করেছিল। আর আমার নৃত্য যে কোন পর্যায়ের ছিল তা আর না বলি।
যাই হোক পিটুনি খেয়ে আবার বানানটা দেখেছিলাম। আসলেও তাতে র-ফলার কোনো বালাই নেই।
আরেকটি বানান হচ্ছে জনৈক।
অনেককেই দেখেছি বলেন বা লেখেন জৈনিক। ফলে শব্দ ব্যবহারের অসারতা যেমন বাড়ে নিজের অজ্ঞতাও প্রকাশ হয়ে পড়ে বিপুল বাদ্য সহকারে।
ব্লগে এবং পত্রিকায়ও দেখি কেউ কেউ যেন বোঝাতে লেখেন যেনো। কেন লিখতে লেখেন কেনো। যা একেবারেই অনুচিত। কারণ একটি ব্যাপার মনে রাখা উচিত যে, কোনো কোনো শব্দের উচ্চারণ ভেদে অর্থ বিপর্যয় ঘটতে পারে। যেমন, যেন শব্দটিকে যদি যেনো লেখা হয়, তাহলে তার উচ্চারণে শুনতে পাবো জেনো (জানিও), কেনো উচ্চারণ করলে বুঝবো যে, ক্রয় কর (কথ্য এবং লেখ্য রূপেও)। ফলে শ্রোতা বিভ্রান্ত হতে পারেন।
তা ছাড়া ব্লগের কোনো কোনো পোস্টে বানান সংক্রান্ত দুর্বলতার প্রতি ইঙ্গিত করলে বা ভুল ধরিয়ে দিলে কেউ কেউ লজ্জা বোধ করেন। কেউ কেউ রেগে যান। যার অর্থ নিজের অজ্ঞতাকে তিনি ঢেকে রাখতে চান। ভুল যে হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভুল হতেই পারে। আমার এই পণ্ডিতি পোস্টে যে ভুল থাকবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
টাইপের কারণে, সাময়িক অসাবধানতার কারণেও তা হতে পারে। কাজেই তা স্বীকার করে নেওয়াটা ভাল মনে করি। অজ্ঞতা গোপন করবার ব্যাপার নয়। অজ্ঞতার প্রকাশ মানেই শিক্ষা বা জানার প্রথম ধাপে উন্নীত হওয়া। আর অজ্ঞতা প্রকাশ করলে তা দূর করতে কেউ না কেউ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেনই। কাজেই অজ্ঞতা প্রকাশটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলে ফলাফল মন্দ হবে না তা জোর দিয়ে বলতে পারি।
আবার অনেকেই বলেন (নানা পোস্টের কমেন্টে দেখি) বানান সংক্রান্ত কোনো সমস্যায় পড়লে গুগুল চাচার শরণাপন্ন হন। যা একেবারেই অনুচিত। কারণ অনলাইনে যারা লেখালেখি করেন, তাদের মাঝে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী আছেন, তেমনই আছেন বিদ্যার জাহাজ গোত্রের লেখক। একটা বানান লিখতে যিনি দশটা কী-বোর্ড ভাঙেন। সুতরাং একই বানানের দুটো তিনটি রূপ দেখে বিভ্রান্ত হবেন তা নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে অনলাইন ডিকশনারির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। ভুল বানান দিয়ে সার্চ দিলে অভিধান তা দেখাবে না। ফলে হাতের কাছে রাখা অভিধান বা বানান অভিধানটি দেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে। এতে আর কিছু না হোক বানানের দৈন্য কেটে যাবে খুব দ্রুত।
আরেকটি ব্যাপার দেখেছি বাংলা ভাষার ইজারাদার বা রক্ষাকর্তা বাংলা একাডেমি সাহেব নিজেই নিজের অদক্ষতা গোপন করতে পারেন না। যেমন, অনেক বানানের বিকল্প রূপ রেখেছেন তিনি, যা বিভ্রান্তিমূলক। আমরা অনেকেই লিখছি-
তৈরী/তৈরি
নীচ/নিচ
গাভী/গাভি
মুরগী/মুরগি
ঠান্ডা/ঠাণ্ডা
গন্ডার/গণ্ডার
এমন ক্ষেত্রে যে কোনো একটি রূপ প্রমিত হিসেবে নির্দিষ্ট করা উচিত বলে মনে করি। ফলে বাংলাদেশের লেখালেখির সব মাধ্যমে একটি বানান পরিদৃষ্ট হবে। একটি শিশু সে বানান রূপেই অভ্যস্ত হয়ে বড় হতে থাকবে। একটি অভিধানই বংশপরম্পরায় যতদিন টিকে থাকবে ব্যবহৃত হবে। বানান ভুলের সম্ভাবনাও কমে যাবে। আমি বলবো যে, বাংলা একাডেমির উচিত হবে যে, অভিধানের ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের বিকল্প বানান পরিহার করা। এতে করে বানানের একাধিক রূপ ব্যবহার বন্ধ হয়ে প্রমিত রূপটিই প্রাধান্য পাবে।
আমার নিজের আরেকটি অজ্ঞতার প্রকাশ দিয়ে এ লেখাটি শেষ করবো। যখন আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, মনের সুখে ঘরে, পাঠাগারে ব্যাপক পড়াশুনা করছি নিত্য-নতুন বিষয়ে, সে সময়ের ঘটনা।
আমার এক ভাই ভূগোলে মাস্টার্স করা। শিক্ষকতা পেশায় জড়িত। তার সঙ্গে কথা বলবার সময় তিনি আমার একটি শব্দের উচ্চারণের দিকে আকৃষ্ট হয়ে বললেন, নি দিয়া কী কইলি? নির্দিষ্ট না নিবিষ্ট আবার ক!
আমি নিঃসংকোচে বললাম, ওহ, অইডা নিদ্রিষ্ট (নিদৃষ্ট)!
ভাই হেসে উঠে বললেন, দেইখ্যা পড়স নাকি হাফিজি? বানানডা তো এমন না।
-হ। এমনই তো। নয়ে রসয়িকার নি, দয়ে রেফ রসয়িকার, মদ্দিনাশ-শয়ে ট-,সংযুক্ত।
-তাইলে কী অইলো, নিরদদিষ্ট না নিদরিষ্ট?
আমার সচেতনতা ফিরে এসেছিল। তবে বিন্দুমাত্র লজ্জা পাই নি বা সংকোচ বোধ করি নি সেদিন। অজ্ঞতা আড়ালের চেষ্টা না করে সেদিন বলেছিলাম ভাইকে যে, পনের বছর ধরে শব্দটির ভুল উচ্চারণ করে আসছি, কারো কাছে ধরা পড়ল না কেমন কথা! (আপচুচ! )
এরপর আমি নিজেও সতর্ক আর অন্যের উচ্চারণের দিকেও মনোযোগী।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ২:২৫