হারানোর ভয় আমাদের সবার ই থাকে। কত্ত কত রকম হারানোর ভয়! হঠাৎ হারানোর কথা ক্যানো? কিছু আউট অফ সিলেবাস জিনিষ নিয়ে পড়ালেখা হচ্ছিলো। সেখান থেকেই হারানো বিষয়ক চিন্তা মাথায় ঢুকলো। জন্মের পর বাবা মার ইচ্ছে আর ধর্মীয় বিধানানুযায়ী মাথার চুল হারালাম। সেই থেকে শুরু।
আমার অবস্থা জোক্সের সেই ছেলেটার মত। যার সব রচনাই গিয়ে ঠ্যাকে সেই কুমীর এর কথায়। শৈশবের কথা আসবেই। প্রথম হারানোর অভিজ্ঞতা তো সেখানেই।
শৈশবে কারো বাসায় বেড়াতে গেলে খুব বেশি লাফালাফি করতাম না আমি। অবশ্য বেড়া-বাড়িতে পিচ্চি থাকলে আর ভুলে সে আমাকে অন্দরমহলে খেলতে ডাকলে তার শিশুজীবনের মতো শিক্ষা হয়ে যেতো। খ্যালনা ছাড়া তেমন কিছুতে আগ্রহী ছিলাম না। সেগুলো নাস্তানাবুদ করতাম এই আর কি!
বাল্যবন্ধু ইফতির কালেকশানে খুব সুন্দর একটা ট্রেন এসেছে। কয়লার ইঞ্জিনে যেমন কমলাটে আলো জ্বলে, সেই খ্যালনার ও সেরকম আলোর ব্যবস্থা। আওয়াজ করে কু ঝিকঝিক। আবার দুই চারখান গাছ আছে, আছে টানেলের সেট আপ। পুরাই জমজমাট অবস্থা। দাম নাকি সেই ৯২ এর আমলে ১০০০ টাকার বেশি। ওর মামা চাচা কেউ দিয়েছে।
বাসায় এসে চিল্লাপাল্লা করে অস্থির আমি। ঐ ট্রেন ই চাই আমার। অবস্থা বেগতিক দেখে আব্বা তখনকার দিনের খ্যালনাপাড়া পিকচার প্লেস আর নিউমার্কেট চষে বেড়ালেন। সবাই হলুদ রঙা সরু আর ছোট ট্রেন বের করে দ্যাখায় আর আমার রাগ আরো বাড়তে থাকে। দোকানদাররা আব্বার সাথে একসুর এরকম ট্রেন এ তল্লাটে নেই। খেয়াল করলাম আব্বা আর দোকানদার চোখ টেপাটিপি করছে। বুঝলাম আব্বা চাচ্ছে আমাকে শান্ত করতে। ঘণ্টাখানেক খুঁজে আমি খুব হয়রান হয়ে নিজেই বললাম এ ফকিরা শহরে পাওয়া যাবে না। ঢাকায় যাওয়া লাগবে। সে যাত্রা বুঝলাম চাইলেই সব জিনিষ পাওয়া যায় না।
সাগর ছিলো সেলিম আঙ্কেলের ছেলে। রুদ্রর ভাইপো। রুদ্র মানে রুদ্র শহীদুল্লাহ। টিভিতে একদিন কোন এক নাটকের শেষে রুদ্রের “ভালো আছি ভালো থেকো” গানটি প্রচার হচ্ছিলো। আম্মা সেই সময় ই আমাকে রুদ্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়া ব্যর্থ প্র্যাস চালালো। মোটেও পাত্তা দিলাম না। শুধু মাথায় রয়ে গেলো সাগরের চাচা রুদ্র নাটক গান এসব লেখে। খ্যালার সাথী ছিলাম আমরা। খ্যালোয়াড় হিসেবে সাগর খুব ই বিরক্তিকর। ওয়াইড নো বল করে একাই হারিয়ে দিতো দলে নিলে।
সাগরের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি ক্লাস এইটের পর।
ইস্কুলের প্রথম সপ্তাহের দিকে একটা ছেলে আমার পাশে বসলো। আমি বোকা সোকা পাবলিক। সে বাতবায়ু ত্যাগ করে আমার নামে অপবাদটা দিয়ে দিলো। সেই প্রথম কেউ এভাবে হেয় করলো। খুব ই মেজাজ খারাপ হলেও আমি কিছুই বলিনি। ছেলেটা ন্যাড়া হওয়ার পর সুযোগ বুঝে একদিন মাথায় হাত বুলিয়ে একরম শোধ নিলাম।
এরপর দিন যেতে থাকলো।
কিসের জানি ছুটি হলো।
আম্মা একদিন এসে কাদো কাদো হয়ে বললো, “ঐ যে ঐ ছেলেটা তোর পাশে বসতো ও মারা গেছে। পানিতে ডুবে। আজ মিলাদ।” ওর মা কে স্বান্ত্বনা দিতে আমাকে বাসায় রেখে গেলো ইস্কুলের আম্মা পার্টির সবাই।
স্পষ্ট মনে আছে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো সে দিন...ভেসে যাচ্ছিলো আশপাশ...পাশের একতলা বাড়ির ছাদে বর্ষা আছড়ে পড়ছিলো...ভিজছিলো চড়ুই পেয়ার গাছের ডালে চুপচাপ আমার তাড়া খেয়ে বারান্দায় বসতে না পেরে...
আমার শুধু মনে হচ্ছিলো কিভাবে ঐ ছেলে মা কে ছেড়ে একা একা কবরের ভিতর ভিজছে। কবর ভেসে যায় নি তো?
আম্মা যখন ভুনা খিচুড়ী আনলো ওর মিলাদের, খেতে পারলাম না। শুধু মনে হচ্ছিলো ভেজা মাটি খাচ্ছি কবরের...
আচ্ছা, হারিয়ে গিয়েছি নাকি হারিয়ে যাইনি কোনটা জরুরী খবর?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ২:০২