১.
বারান্দার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন করিম হোসেন। পড়ন্ত বিকেলের একচিলতে রোদ বারান্দার গ্রিল দিয়ে ভেতরে ঢুকে অস্থায়ী আবাস গেড়েছে টাইলসের মেঝের ওপরে। করিম হোসেনের ইজিচেয়ারের হাতলের উপরে একটি খালি চায়ের কাপ। চা খাওয়া শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, যদিও চায়ের উত্তাপ এখনো কাপের গায়ে লেগে আছে।
বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন করিম হোসেন। দৃষ্টিসীমার মধ্যে দেখা যাচ্ছে অদূরে একটা খেলার মাঠ। সবুজ ঘাসের সে মাঠে বাচ্চারা খেলছে। এই বাচ্চাগুলোর মধ্যে করিমের দুই মেয়েও আছে। ওরা লাল টুকটুকে একটা বল নিয়ে লোফালুফি খেলছে। সবুজ ঘাসের ওপরে লাল বল, কেমন জানি বাংলাদেশের পতাকার মত মনে হচ্ছেনা! হঠাৎ করে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো করিম হোসেনের।
নিজের দেশ থেকে সহস্র মাইল দূরে পরভূমে পরবাসী করিম হোসেন নীরবে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন...
২.
চিন্তা করলে মনেহয় এই তো সেদিনের ঘটনা। করিম হোসেন ঢাকার একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করতেন। সকালে বেরিয়ে যেতেন অফিসে, বিকেলে অফিস শেষ হলে অফিস থেকে নেমে কলিগদের সাথে কাদেরের দোকানে চা খেতেন। দোকানের নামটাও ছিলো বাহারী "কাদেরের চা, বারবার খা।" চাপর্ব শেষে ফিরতেন বাসায়। ছুটির দিনগুলোতে পরিবার নিয়ে চলে যেতেন শহরের মায়া ছিন্ন করে গ্রামের বাড়ির দিকে। গ্রামের তাজা বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিয়ে আবার শহরে ফিরতেন । দিনগুলো কেটে যেত হাসি-বেদনার মিশ্রণে।
"...বাজারে যাবে না?" স্বপ্নার ডাকে সম্বিৎ ফেরে করিম হোসেনের, স্বপ্না তার স্ত্রী।
"হু, যাবো। বাজারের ব্যাগটা দাও" আনমনে কথাটা বলেই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন করিম হোসেন। এই উন্নত দেশে বাজার করতে ব্যাগ লাগেনা। সুপারশপের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম এলাকায় ট্রলি নিয়ে ঘুরে ঘুরেই বাজার করা যায়। আসার সময়ে সুপারশপের লোকেরাই হাতে বাজারভর্তি ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। বিদেশের সুপারশপের উন্নতমানের এই ব্যাগে দেশের বাজারের সস্তামানের সে ব্যাগের পরিচিত গন্ধটা আসেনা কেন?
৩.
করিম হোসেনের মনে পড়ে যায় দেশের বাজারের কথা। দেশেও সুপারশপ ছিলো, সেখানে করিম হোসেন কখনো যেতেননা। তিনি যেতেন মহল্লার বাজারে। ছুটির দিনের ভোরে হাতে বাজারের থলে নিয়ে তিনি বের হতেন। কাঁচাবাজার থেকে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বেগুন, পটল, কুমড়া.. কিনে ঢুকতেন মাছের বাজারে। মাছের মেছো গন্ধ আর মাছবিক্রেতাদের চিৎকারে ভারি হয়ে থাকতো ভেতরের পরিবেশ। কিছু বরফ দেওয়া মরা মাছ আর কিছু তড়পানো মাছ, যারা ডাঙ্গায় উঠে খাবি খাচ্ছে, তাদের নিয়ে ছিলো মাছের বাজার। কানকো টিপে, ফুলকা দেখে, দরকষাকষি করে পছন্দের মাছ কিনতেন করিম হোসেন। লোকজনের ঠেলাঠেলি, মাছের বাজারের কাদাকাদা মেঝে, চকচকে মাছগুলো ছিলো যেন একে অন্যের সাথে একসূত্রে গাঁথা।
ভাবতে ভাবতে সুপারশপের দরজায় পৌঁছে গেলেন করিম হোসেন। স্বয়ংক্রিয় দরজার সামনে পৌঁছতেই খুলে গেলো দরজা। ভেতরে ঢুকতেই এসির মৃদু, চাপা গর্জন শোনা যায়। হাতে ধাতব ট্রলি নিয়ে চকচকে মেঝেতে খুব সাবধানে হাঁটেন করিম সাহেব। তার চোখে তখন মহল্লার মাছের বাজারের চকচকে মাছগুলো ভাসছে। সুপারশপে সব জিনিসের গায়েই প্রাইজট্যাগ বসানো, কাউন্টারে ঝুলতে থাকে "ফিক্সড প্রাইস, নো বার্গেইনিং প্লিজ"। এখানে কানকো টিপে, দরকষাকষি করে মাছ কেনার সুযোগ নেই। মাছগুলোও কেমন বিবর্ণ, মহল্লার মাছগুলোর মত চকচক করেনা।
সুপারশপ থেকে মাথানিচু করে বাজারভর্তি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসেন করিম হোসেন। দেশে যখন থাকতেন, বাজার করতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। এখন বাজারের নাম শুনলেই তার ভ্রু কুঁচকে যায়, ভীষণ বিরক্তি লাগে। তার কাছে সুপারশপগুলোকে থিয়েটার অথবা নাট্যশালা মনে হয়, যেখানে নিয়মিত বাজারের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে।
৪.
করিম হোসেন পরিবারকে নিয়ে বিদেশে এসেছেন দুই মাস হয়েছে, দেশের স্মৃতিগুলো তাই এখনো অনেক বেশি টাটকা। ক্ষণেক্ষণে সেগুলো বেয়নেটের মত খুঁচিয়ে যায় ভেতরটাকে। বিদেশ বলতে তিনি কোন দেশে আছেন, সেটা এখনো বলা হয়নি। দেশের বাইরে যেকোনো দেশই বিদেশ। পাঠকের এখানে পূর্ণ অধিকার আছে নিজের পছন্দমত যেকোনো একটা দেশে করিম হোসেনকে কল্পনা করে নেয়ার।
যে বহুজাতিক সংস্থায় তিনি চাকরী করতেন তাদের নির্দেশেই এখন তাকে তিন বছর বিদেশের এই শাখায় চাকরী করতে হবে। তিন বছর পরে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারবেন। এখানে আসার একমাস আগে থেকেই করিম হোসেন বিশাল আগ্রহে সদ্য কেনা ট্রাভেলব্যাগ গোছানো শুরু করেছিলেন। নতুন দেশ দেখবেন, সে আনন্দে তার নির্ঘুম রাত কাটছিলো। বিমানের যেদিন ফ্লাইট, তার দুইদিন আগে রাতে একটা স্বপ্ন দেখে করিম হোসেন ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে পড়েন। স্বপ্নে তিনি দেখছিলেন, তাকে তার মায়ের কোল থেকে এক আধুনিকা মহিলা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, ছোট্ট করিম তার গ্রাম্য,সাধারণ মায়ের কোল থেকে যাবেনা, সে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে... ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন করিম হোসেন। ঘড়িতে দেখলেন, রাত ৩টা বাজে। তিনি শুনেছিলেন, ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়, তখন তার মনে হয়েছিলো, গভীর রাতের স্বপ্নও বোধহয় সত্যি হয়। সত্যিই তো তাকে তার মায়ের কোল থেকে কোনো এক আধুনিকা মহিলা নিয়ে যাচ্ছে, সে মহিলার কাছে যাওয়ার জন্যে বিমানের টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছে। স্বপ্নের সাথে বাস্তবের শুধু একটাই অমিল, স্বপ্নে তিনি কাঁদছিলেন, আর বাস্তবে, তিনি বেশ আনন্দেই মায়ের কোল ত্যাগ করে আধুনিকার কোলে পাড়ি জমাচ্ছেন। হঠাৎ করে করিম হোসেনের চোখ থেকে কিছু উত্তপ্ত তরল নেমে আসে গাল বেয়ে, হয়তো স্বপ্নটাকে পুরোপুরি সত্যি করবার জন্য, হয়তো করিম হোসেনকে কাঁদানোর জন্য।
৫.
করিম হোসেন ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন। বিদেশে এসেছেন ১ বছর হয়েছে, অনুভূতিটা এখনো টাটকা। ল্যাপটপের ইমেজ ফোল্ডারে ঢুকে দেশে রেখে আসা বাবা, মা, বন্ধুবান্ধব, দোকানপাট সবকিছু ১৪ ইঞ্চির মনিটরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। গ্রামের বাড়িতে ইটের দেয়াল, টিনের ছাদের সেই বহুস্মৃতিবহনকারী বাড়ির সামনে করিম হোসেনের বাবা, মা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের মাঝখানে করিম হোসেনের দুই মেয়ে। এদেশে আসার কয়েকদিন আগে গ্রামে গিয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরায় ছবিটি তোলা হয়েছিলো। স্লাইড করে পরের ছবিতে যেতেই দেখা গেলো, বাড়ির পাশের শানবাঁধানো পুকুর। চৈত্রের ঝাঁঝালো দুপুরে এ পুকুরে অগণিতবার সাঁতরেছেন করিম হোসেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পুকুর থেকে প্রবল সমারোহে মাছ ধরা হচ্ছে। করিম হোসেন যেবারই সস্ত্রীক বাড়িতে যেতেন, তার বাবা লোক এনে পুকুর থেকে মাছ ধরার আয়োজন করতেন। পুকুর থেকে মাছও উঠতো অনেক। ক্ষেতের সবজি দিয়ে সে মাছ রান্না করতেন মা। মায়ের হাতের রান্নার কাছে তখন অমৃতও তুচ্ছ হয়ে যেত। স্লাইড করে এবার চলে গেলেন অন্য ফোল্ডারে। প্রথম ছবিটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে, গ্রুপ ফটোসেশন। শিক্ষাসফরের বাসে ওঠার আগমুহূর্তে ছবিটা তোলা হয়েছিলো। ছবির একেবারে কোণায় রফিককে দেখা যাচ্ছে। রফিকের চোখে সানগ্লাস, হাতে গিটার, গানবাজনার শখ ছিলো রফিকের, গানের গলাও ছিলো মায়াময়। ভার্সিটিতে রফিক ছিলো করিমের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যেদিন করিম হোসেনের ফ্লাইট, সেদিন এসেছিলো রফিক, শেষবারের মত বন্ধুর সাথে দেখা করতে। গানও শুনিয়েছিলো। এখানে আসার কয়েকমাস পরে করিম হোসেন জানতে পারে, রফিক মারা গিয়েছে বাসের নীচে চাপা পড়ে, পত্রিকার ভাষায় "সড়ক দুর্ঘটনায়।" প্রিয় বন্ধুর মরামুখটাও দেখতে পারেনি, এয়ারপোর্টে বন্ধুর সাথে সে দেখাই ছিলো অন্তিম দেখা।
আর ছবি দেখতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, করিম হোসেন ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আকাশে মেলামাইনের প্লেটের সাইজের চাঁদ উঠেছে। ঠান্ডা চাঁদের আলোয় চারপাশ মৃদু আলোকিত। করিম হোসেন ইজিচেয়ারে বসলেন। চারপাশে পিনপতন নীরবতা, হঠাৎ করে নিজেকে ভীষণ একা মনে হলো তার।
৬.
পরদিন সকালে করিম হোসেনের স্ত্রী স্বপ্না বারান্দায় এসে দেখেন তার স্বামী ইজিচেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখে মৃদু হাসি। স্বপ্না কাছে গিয়ে করিম হোসেনের হাত ধরলেন, ভীষণ ঠান্ডা হাত। গতকাল রাতের সেই চাঁদের মতই ঠান্ডা হবে হয়তো। স্বপ্না আছড়ে পড়লেন তার স্বামীর নিথর দেহের ওপরে। কান্না শুনে দুই মেয়ে ছুটে এলো ঘর থেকে। বাচ্চামেয়ে দুটিও মায়ের সাথে কান্নায় সামিল হলো।
করিম হোসেন তখনও একদৃষ্টে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখে মৃদু হাসি।
পরিশিষ্টঃ
করিম হোসেন বিমানে দেশে ফিরছেন, পরিবারের সাথে, সাদা চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে, লাশ হয়ে। যদি জীবিত থাকতেন, দেশে ফিরে আসায় তার মত খুশি বোধহয় আর কেউ হতোনা। "আধুনিকা মহিলা" নামের বিদেশ করিম হোসেনের প্রাণটাকে রেখে নিথর দেহটাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে, করিম হোসেন আস্তে আস্তে তার নিজের দেশের নিকটবর্তী হচ্ছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৫