ফেলুদা কল রিসিভ করার সময়েই আমি দেখেছিলাম মোবাইলের স্ক্রিনে লালমোহন বাবুর ছবি ভেসে উঠেছে। লালমোহন বাবু আমাদের হোটেলের রুমে দেখতে না পেয়ে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন দিয়েছেন। জটায়ূর সাথে কথা শেষ হওয়ার পরে ফেলুদা বললো, "ভদ্রলোক আমাদের রুমে দেখতে না পেয়ে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ওনাকে রবীন্দ্র সরোবরে আসতে বললাম। আমরা এখন সেদিকেই যাচ্ছি।"
ধানমন্ডি লেকে "রবীন্দ্র সরোবর" কোথায়? আর যদি থেকেই থাকে, ফেলুদা জানলো কীভাবে? আমার হাবভাবে ফেলুদা বুঝতে পারলো, কী প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরঘুর করছে। বললো, "এত বছর আমার সাথে থাকার পরেও এই সহজ জিনিসটা বুঝলি না? আমি কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে যে হোমওয়ার্ক করি, পড়াশোনা করে যাই তা তুই জানিস না?"
মনে মনে একটু লজ্জাই পেলাম।কোনো কথা না বলে ফেলুদার সাথে পা চালিয়ে এগোতে লাগলাম রবীন্দ্র সরোবরের দিকে।
কিছুদূর এগোতেই দেখলাম ফাঁকামতন একটা জায়গা। সেই জায়গাটার চারপাশ ঘিরে বসার জায়গা। ফেলুদা বললো, এটাই রবীন্দ্র সরোবর। এক দোকান থেকে ওয়ানটাইম কাপে করে চা এনে আমি আর ফেলুদা রবীন্দ্র সরোবরের এক কোণে এসে বসলাম। চায়ের স্বাদটা একটু অন্যরকম ছিলো, ফেলুদা বললো এটাকে নাকি মালাই চা বলে।
আমি একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলাম, "এটাও কী তুমি বই পড়ে জেনেছো?"
ফেলুদা বললো, "এজন্যেই বলি, চোখকান একটু খোলা রাখ। দোকানের পাশেই তো চার্টে লেখা ছিলো কী কী চা এখানে পাওয়া যায়, কোন চা'এর দাম কত। খেয়াল করা উচিত ছিলো তোর।"
এই রে। ভীষণ ভুল হয়ে গেছে। নিজেকে মনে মনে বকুনিই দিলাম এরকম বোকামোর জন্য।
অনেকক্ষণহয়ে গেছে আমরা এখানে এসেছি। ফেলুদা বারবার ঘড়ি দেখছে। লালমোহন বাবুর এতক্ষণে এসে পড়ার কথা ছিলো। ভদ্রলোক এখনো আসেননি। উদ্বিগ্ন হয়ে ফেলুদা লালমোহন বাবুকে একটা কল দিলো। জটায়ূ আর ফেলুদার কথাবার্তা থেকে যা বুঝলাম, রবীন্দ্র সরোবরে আসতে গিয়ে ভদ্রলোক লেকের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছেন। ফেলুদা তাকে মোবাইলের নেট কানেকশন অন করে গুগল ম্যাপের সাহায্যে রবীন্দ্র সরোবরে আসতে বললেন।
দশ মিনিট পরে দেখি ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন।আমাদের পাশে এসে ধপ করে বসে পড়ে বললেন, "আর একটু হলেই প্রাণটা গিয়েছিলো প্রায়।"
ফেলুদা খোঁচা দিয়ে বললো, "সাতসকালে অটোগ্রাফ-শিকারীরা বুঝি তাড়া করেছিলো আপনাকে?"
জটায়ূ খেপে গেলেন, "রাখুন মশাই অটোগ্রাফ শিকারী। রবীন্দ্র সরণীর খোঁজে আমি লেকের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম।যাকে জিজ্ঞেস করি, সেই চিনতে পারেনা। হঠাৎ করে একটা গাছের আড়াল থেকে ষণ্ডামার্কা একটা লোক বের হয়ে আমার দিকে ছুরি তাক করে যা আছে সব দিতে বললো। আমার কাঁধব্যাগে ছিলো গোলমরিচের গুঁড়ো। ঢাকায় নাকি ভালো বরই পাওয়া যায়। গোলমরিচ দিয়ে বরই খাবো বলে ব্যাগে করে খানিকটা গোলমরিচ গুঁড়ো বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিলাম। সেটা ছিনতাইকারীর মুখে ছুড়ে মেরেই দৌড় শুরু করেছি। ভাগ্যিস, তখন গুগল ম্যাপের কথা বললেন।"
ফেলুদা বললো, "রবীন্দ্র সরোবরকে রবীন্দ্র সদন বললে কেউ কী আর চিনবে? যাক গে, আজকের প্ল্যান কী লালমোহন বাবু?"
জটায়ূ হাসিমুখে বললেন, "আজ যাবো নীলক্ষেত।বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের মার্কেট। আমাদের কলেজ স্ট্রীটের মতই।"
ফেলুদা বললো, "শুভস্য শীঘ্রম। চলুন, হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়া যাক।"
জটায়ূ আর আমি ফেলুদার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে হোটেলের দিকে অগ্রসর হলাম।
হোটলের লবিতে পা দিয়েই দেখতে পেলাম, লবির এক কোণে সোফায় সাগর স্যান্যাল বসে আছে। আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। বললেন, "আমার বাসায় চলুন। সকালের ব্রেকফাস্ট আমার বাসাতেই করবেন।" ফেলুদা'র ওজরআপত্তি ভদ্রলোক আজ আর শুনলেন না। একরকম টেনেহিঁচড়েই হোটেল থেকে আমাদের বের করলেন। পার্কিংলট থেকে গাড়ি বের করে আমাদের উঠিয়ে রওয়ানা হলেন ধানমন্ডি-১৫ তে তার বাসার দিকে।গাড়িতে বসেই সাগরবাবু নিজের সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। ভদ্রলোকের জুতোর কারখানা ছাড়াও নিউমার্কেটে তিনটি জুয়েলারির দোকান আছে। ধানমন্ডিতে তার নিজের বাড়ি, ১১ তলা বাড়ি। ৩ তলায় তিনি থাকেন, বাকিগুলো ভাড়া দেন। ভদ্রলোকের দুটি সন্তান। এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর সাথে মেয়ে সিডনি থাকে।
সাগর স্যান্যালের কথা শুনতে শুনতে আমরা ধানমন্ডি-১৫ চলে এলাম। বিশাল এক বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামলো। ঢাকায় এসে দেখেছি, এখানে খুব অল্প জায়গার মধ্যে অনেক বাড়ি তৈরী করা হয়েছে। তাই, অনেক বাড়িতেই পার্কিংলট ছাড়া আর কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। কিন্তু, সাগর স্যান্যালের বাড়ি এ নিয়মের ব্যতিক্রম। গাড়ি গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম নুড়িবেছানো রাস্তা চলে গেছে একেবেঁকে মূল বাড়ির দিকে। রাস্তার দুইপাশে অনেকখানি করে ফাঁকা জায়গা। একপাশে বাগান করা হয়েছে। বিভিন্ন রংয়ের, বাহারের ফুলগুলো বাগানের শোভা বাড়িয়েছে। অন্যপাশে বসার জন্য শ্বেতপাথরের টেবিল-চেয়ার। ঘাসগুলো যে নিয়মিত কাটা হয়, সেটা বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হলোনা।
তিন তলায় পৌঁছে বাসার কলিংবেল চাপলেন সাগরবাবু। কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও কেউ দরজা খুললোনা... (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৫