বই পর্যালোচনাঃ চৌরঙ্গী
লেখক: শংকর
প্রকাশনী: দে'জ পাবলিশিং
পৃষ্ঠা: ৩৬০
মূদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা
"চৌরঙ্গী" উপন্যাসটি লেখকের নিজের জীবনের একটি অধ্যায়ের কাহিনী। লেখকের জীবন যে কম বৈচিত্র্যময় নয় তা তাঁর ভ্রমণকাহিনীগুলো পড়লেই বোঝা যায়। সেই লেখক বালক বয়সে কলকাতায় হাইকোর্ট দেখতে এসে কলকাতাতেই থিতু হন যার উল্লেখ আছে লেখকের "কত অজানারে" বইতে।
কলকাতায় এসে সায়েব ব্যারিস্টারের কাছে চাকরি পেয়েছিল সে। আনন্দেই কাটছিলো দিনগুলো। হঠাৎই ছন্দপতন ঘটে গেলো। লেখকের আশ্রয়দাতা ব্যারিস্টার সায়েব মারা গেলেন। লেখক পড়লেন অকুলপাথারে। বিশাল কলকাতাসমুদ্রে লেখক হাবুডুবু খেতে লাগলেন। একটা চাকরীর জন্য তিনি সবার দ্বারেদ্বারে ঘুরতে লাগলেন। শেষমেশ, জীবিকার তাগিদে সেলসম্যান হলেন, ঝুড়ি বিক্রি করা শুরু করলেন। এভাবেই একদিন ঝুড়ি বিক্রি করে ক্লান্ত হয়ে চৌরঙ্গীর কার্জন পার্কে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ করেই লেখকের দেখা হয়ে যায় তাঁর অতিপরিচিত বায়রন সাহেবের সাথে। বায়রন সাহেব লেখকের এ দুর্দশা দেখে তাকে নিয়ে যান কলকাতার গর্ব, পাঁচতারকা হোটেল "শাজাহান" এ, যদি কোনো চাকরী লেখককে জুটিয়ে দেয়া যায়, এ আশায়।
পাঠক, নড়েচড়ে বসুন। এতক্ষন যা ছিলো, তা ভূমিকা। "চৌরঙ্গী" উপন্যাসের শুরু এই প্রাসাদোপম "শাজাহান" হোটেল থেকেই।
বায়রন সাহেবের অনুরোধে শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার মার্কোপোলো লেখককে শাজাহান হোটেলে চাকরী দেন।
চৌরঙ্গীর অট্টালিকাসম হোটেল "শাজাহান" এ লেখকের দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় লেখকের। সত্যসুন্দর বোস, রোজী, উইলিয়াম, কনি, ল্যামব্রেটা, মিস করবী গুহ, মিসেস পাকড়াশী, সুজাতাদি... অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। যারা উপন্যাসটি পড়েছেন, তারা চরিত্রগুলোকে চিনতে পারবেন। যারা পরে পড়বেন তারা তখন বুঝতে পারবেন, এ চরিত্রগুলোর নাম এখানে কতটা প্রাসঙ্গিক ছিলো।
"শাজাহান হোটেল" এ নানা বৈচিত্র্যময় কর্মকান্ডের মধ্যে কেটে যাচ্ছিলো দিনগুলো। প্রতিদিন অজস্র লোক শাজাহান হোটেলে আসছেন, আবার চলেও যাচ্ছেন। এদের মধ্যে কারো কারো জীবনের সাথে লেখকের আকস্মিক পরিচয় ঘটছে। কারো কারো জীবনকাহিনী বড্ড বেদনাদায়ক, কারো জীবনকাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। সেগুলো আশ্চর্য সাবলীলভাবে লেখকের হাত ধরে উঠে এসেছে "চৌরঙ্গী" উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায়।
কোনো রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারকাহিনীর চেয়ে কোনো অংশে এ বইটার নাটকীয়তা কম ছিলোনা। বইটি পড়তে পড়তে যখন শেষপাতায় চলে এলাম, কেন জানিনা চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো জল। উপন্যাস পড়ে আবেগপ্রবন হওয়ার মত লোক আমি ছিলাম না। কিন্তু, "চৌরঙ্গী" যে বাধ্য করলো।
নীলক্ষেতে গিয়ে অনেকটা দোকানদারের জোরাজুরিতেই বইটা কিনেছিলাম। দোকানদারকে আজ একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। এখন পর্যন্ত বইটির ৬৩ টি সংস্করণ বের হয়েছে। ৫২ বছর ধরে বইটি নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে। বিগত পঁচিশ বছর ধরে ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস চৌরঙ্গী বাংলার সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও সাড়া জাগিয়েছে। শরৎচন্দ্রের পর আর কোনো বাংলা উপন্যাসের অনুবাদ হিন্দী সাহিত্যে এমন আলোড়ন জাগায়নি।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশিনী গবেষকেরা এই উপন্যাস নিয়ে আন্তর্জাতিক পত্রিকায় সর্ববৃহৎ আলোচনা করেছেন। এই উপন্যাসের রুশ সংস্করণ সোভিয়েত পন্ডিতসমাজের প্রশংসা ও পাঠকদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
অনেকদিন এরকম ভালো কোনো বই পড়া হয়নি। ২০১৫ সালে আমার পড়া সেরা বই এটাই, বলতে দ্বিধা নেই। বইটিকে শুধু উপন্যাস বললে ভুল হবে, গভীর জীবনবোধের আশ্চর্য দলিল এই বইটি। বইটিতে বহু লাইন আছে যেগুলো পাঠককে গভীরভাবে ভাবাবে, কাঁদাবে, হাসাবে, জীবনকে নতুন করে চিনতে সেখাবে।
বইটি থেকে কয়েকটি লাইনঃ
"পৃথিবীর এই সরাইখানায় আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্রেকফাস্ট খেয়েই বিদায় নেবে, কয়েকজন লাঞ্চ শেষ হওয়া মাত্রই বেরিয়ে পড়বে। প্রদোষের অন্ধকার পেরিয়ে, রাত্রে যখন আমরা ডিনার টেবিলে এসে জড়ো হবো তখন অনেক পরিচিত জনকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা; আমাদের মধ্যে অতি সামান্য কয়েকজনই সেখানে হাজির থাকবে। কিন্তু দু:খ কোরো না, যে যত আগে যাবে তাকে তত কম বিল দিতে হবে।"
এ বই না পড়া পাঠকের জন্য অমার্জনীয় পাপ, অপূরণীয় ক্ষতি।