বড়ভাই যখন ঢাকায় লেখাপড়া করতেন, আমরা থাকতাম বাড়িতে। কলেজ বন্ধ হলেই বড়ভাই বাড়ি চলে আসতেন, আমার জন্য নিয়ে আসতেন একগাদা বই। বইয়ের প্রতি নেশাটা এভাবেই বেড়ে গিয়েছিলো আমার। বড়ভাই একেকবার একেক রকম বই আনতেন। কোনোবার সত্যজিৎ, কোনোবার শীর্ষেন্দু, কোনোবার জাফর ইকবাল বা কোনোবার শরদিন্দু। সেরকমই, একবার আমার জন্য নিয়ে এলেন কিছু বই। তারমধ্যে, একটার নাম ছিলো "ময়ূরাক্ষী।" লেখক হুমায়ূন আহমেদ। এই লেখককে চিনিনা তাই বইটাও ফেলে রাখলাম। সুনীল, সমরেশ এদের বইয়ের দিকে হাত বাড়ালাম।
গ্রামে গল্পের বই পাওয়া যায়না। আর আমার বইপ্রাপ্তির অবলম্বন তখন বাবা আর বড়ভাই। বাবা ঢাকা গেলে বই নিয়ে আসতো আর বড়ভাই বন্ধের সময় এলে বই নিয়ে আসে, এ ছাড়া গল্পের বই পাওয়ার আর কোনো উৎস ছিলোনা।
কিছুদিনের মধ্যেই সমরেশ আর সুনীলের বই শেষ হয়ে গেলো। পড়ে রইলো হুমায়ূনের "ময়ূরাক্ষী।" হাতে আর কোনো বই নেই অথচ বইও পড়তে হবে।তাই, নিতান্ত বাধ্য হয়েই হাতে নিলাম "ময়ূরাক্ষী।" হিমু সিরিজের একটি বই ছিলো এটা। প্রথমবার পড়েই হিমুকে পছন্দ হয়ে গেলো। পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরিহিত মহাপুরুষ হিমালয়ের ভক্ত হতে বেশি দেরি হলোনা। সেই শুরু...
এরপর হুমায়ূন আহমেদের যে বইটা পড়েছিলাম, তার নাম "মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র।" চকচকে মলাটটার এককোণে ছেঁড়া ছিলো। ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো হলদেটে হয়ে গেলেও লেখাগুলো ছিলো ঝকমকে। অনীল বাগচীর একদিন, শ্যামল ছায়া, আগুনের পরশমণি...
এরপর, চলে এলাম ঢাকায়। ঘরের কাছে নীলক্ষেত। হিমু সমগ্র, মিসির আলী সমগ্র বগলদাবা করতে খুব বেশি সময় নিলাম না, গোগ্রাসে গিলতাম সেগুলো। বৃদ্ধ মিসির আলীরও বড় ভক্ত ছিলাম আমি।হিমু আর মিসির আলী, কী জীবন্তই না ছিলো চরিত্র দুটো।
ঈশ্বর দুহাত ভরে প্রতিভা দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর এলেবেলে, বহুব্রীহি পড়ে হাসতে হাসতে যেমন পেটে খিল ধরে যেতো, সেরকম "জোছনা ও জননীর গল্প" পড়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। মানুষকে হাসানো-কাঁদানোর বড় অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো মানুষটির। এমনি এমনি তো আর তিনি গল্পের জাদুকর হননি।
ভ্রমণকাহিনীও বড় সুন্দর লিখতে পারতেন তিনি।নিজের স্বকীয় ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা দেওয়াতে সিদ্ধহস্ত তার মত আর কেউ ছিলো বলে তো মনে পড়েনা। রাবনের দেশে আমি ও আমরা, হোটেল গ্রেভার ইন, পায়ের তলায় খড়ম, যশোহা বৃক্ষের দেশে... বলতে গেলে কী আর শেষ হতে চায়?
শঙখনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, কবি, মধ্যাহ্ন, তেঁতুল বনে জোছনা, গৌরীপুর জংশন, আমার আছে জল, দারুচিনি দ্বীপ... কোনটা রেখে কোনটাকে ভালো বলবো? সবগুলোতেই যে মিশে আছে জাদুকরের ছোঁয়া।
হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা চরিত্রও ছিলো ভীষণ পছন্দের। শুভ্র। এই চরিত্রটা নিয়ে মোট ৪টা কী ৫টা উপন্যাস হয়েছিলো। অথচ, তাতেই শুভ্র হয়ে উঠেছিলো আরেকটি জীবন্ত চরিত্র।
কবিতাও ভালো লিখতেন তিনি। "কবি" উপন্যাসে তাঁর লেখা কিছু কবিতাও ছিলো। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো তাঁর লেখা এই দুটি লাইনঃ
"দিতে পারো একশ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।"
আমি যখন ঢাকায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশে। বইমেলায় ঘুরতাম, যদি কোনোদিন স্যারের সাথে দেখা হয়ে যায়। জাফর ইকবাল স্যারের সাথে বইমেলাতেই দেখা হয়েছিলো। অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, গল্পের জাদুকরের সাথেও এভাবেই বইমেলাতেই দেখা হবে। "অন্যপ্রকাশ" এর স্টলের চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। স্যারের বই উল্টেপাল্টে দেখতাম, স্যারের দেখা পেতাম না। বড় ইচ্ছে ছিলো, তাঁর লেখা বইতে তাঁরই একটা অটোগ্রাফ নেবো।
ঈশ্বর সবার সব ইচ্ছে পূরন করেন না। এখানেও তাই হলো, কিছুদিন পর খবর পেলাম, স্যার আর নেই। চলে গেছেন অনন্ত নক্ষত্রবিথীর ওপারে যেখানে কোথাও কেউ নেই।
বইমেলার আকর্ষণ এখন অনেকটাই ফিকে। বইমেলায় এখনো তাঁর বই "বেস্টসেলার" হয়, এখনো তাঁর হাসিমুখের ছবি স্টলে স্টলে দেখি, কিন্তু জীবন্ত হুমায়ূনকেই আর কোথাও দেখিনা, তাঁর অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য বিশাল লাইনও আর চোখে পড়েনা।
ভালো থাকবেন স্যার। হয়তো, ওপারের জগতে বসেই লেখালেখি করছেন, সেখানের বইমেলায় হয়তো আপনার বই-ই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। কে জানে? হতেও তো পারে। হিমু হওয়ার জন্য হয়তো ওপারের মানুষেরাও নগ্নপায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে মধ্যরাতে হাঁটাহাঁটি করে। জ্যোৎস্নাশোভিত রাত তো আপনার খুব পছন্দ ছিলো। ওপারের জগতে কী জ্যোৎস্না আছে?
"আঙ্গুল কাটা জগলু" উপন্যাসের একটা লাইন দিয়েই শেষ করি, স্যার।
"একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি"
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫৩