বন্যাপ্রবণ বদ্বীপ বাংলাদেশে বর্ষাকাল আসেও তাড়াতাড়ি, যায়ও দেরীতে। একটু বেশি বর্ষণ হলেই বহু গ্রামাঞ্চল রূপান্তরিত হয় ক্ষনস্থায়ী দ্বীপে। চারপাশে থৈ থৈ করছে অপরিসীম জলরাশি, তারই মাঝে কোনোক্রমে মাথা তুলে নিজের নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ছোটছোট গ্রামগুলো, বর্ষাকালের এ খুবই স্বাভাবিক চিত্র। এ অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত প্লাবনে প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ব্যাঘাত ঘটলেও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কৈশোরে পা দেয়া ছেলেমেয়েদের জন্য এ ঋতুই কিন্তু পরম আকাঙ্ক্ষিত। ঘরের উঠোন, স্কুলের মাঠ, গ্রামের মেঠোপথ যখন জলে থইথই, তখন তারা প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই জলরাশির বুকে। কখনো কলাগাছের ভেলা বানিয়ে, সেই ভেলায় সওয়ার হয়ে গ্রামের আনাচেকানাচে ঘোরাঘুরি, কখনো বা আসল নৌকা যোগাড় করে ফেলা, যে নৌকা হয়তো কোনো গৃহস্থ পরিত্যাগ করেছে তলদেশে ফুটো হওয়ার কারনে। অল্পবয়সী বালকেরা নৌকার শরীরের সে ক্ষত মেরামত করে নৌকাকে পুনরায় জলপথের উপযুক্ত বাহনে রূপান্তরিত করে নেমে পড়ে বিল-ঝিল-হাওড়ে।
অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে কালক্ষেপণ না করে মূলবিষয়ে ফিরে আসি। যদিও সে অর্থে প্রবল বন্যাজলে, গ্রামের বাড়িতে আমাকে কখনো আবদ্ধ হতে হয়নি। তাই, কলাগাছের ভেলা কিংবা কাঠের নৌকা কোনোটা দিয়েই বর্ষাকালীন/বন্যাকালীন আনন্দ উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি। যেটা পেরেছি সেটা হলো, প্রচুর কাগজের তরী (যার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী'র কোনো সম্পর্ক নেই) ভাসিয়েছি। আজকের এ প্রবন্ধের মূলবিষয় কিন্তু এটাই।
একেবারে ছোটবেলা থেকে শুরু করি।ছোটবেলা বলতে আমি সে সময়কে বোঝাচ্ছি যখন নিজে কাগজের তরী বানাতে পারতাম না, এই সরঞ্জামের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হতো। একদিন গম্ভীর মুখে বাবাকে বললাম, নৌকা বানিয়ে দাও আর নৌকা বানানো শিখিয়ে দাও। বাবার কাছ থেকেই প্রথম কাগজের তরী বানানো শিখলাম। কাগজ দিয়ে এরকম নৌকা, উড়োজাহাজ, ফুল, লতাপাতা বানানোকে বোধহয় অরিগ্যামী বলে। তবে, সেই ছোটবেলায় অরি কিংবা গ্যামী কোনোটাই বোঝার দরকার ছিলোনা।
নতুন নতুন নৌকা না না তরী বানানো শিখে প্রবল উৎসাহে ঘরের সব কাগজপত্র, পোস্টার, বইয়ের পাতা ছিঁড়ে অজস্র ক্ষুদ্র জলযান নির্মাণ করতে লাগলাম। জলযানের নাম দিলাম "M.V TITANIC ", তখন সদ্য সদ্য টাইটানিকের নাম শুনেছি, তাই আমার নির্মিত জলযানের নামও হয়ে গেলো টাইটানিক।
টাইটানিক নিয়ে গেলাম ঘরের পাশের মাঠে, যে মাঠে কয়েকদিন আগেও ক্রিকেট-ফুটবল খেলা হতো দেদারসে, সেখানেই আজ নীরের একচ্ছত্র আধিপত্য। ভাসিয়ে দিলাম কাগজের তরীকে যার নাম টাইটানিক। জলপথে জলযাত্রা শুরু হলো কাগজের টাইটানিকের।কিন্তু, টাইটানিক নড়ছে না। যেখানে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম, তার আশেপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করে দমকা হাওয়া বইলো, টাইটানিকও তীব্রবেগে ছুটতে লাগলো মাঠের জলপথ ধরে। বাতাসের বেগ একটু বেড়ে যেতেই শুরু হলো বিপত্তি। টাইটানিক হঠাৎ করে তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করে উলটে গিয়ে নিমজ্জিত হয়ে গেলো দুই আঙ্গুল জলের তলদেশে। যাক, একটা না হয় ডুবেই গেছে তাতে কী! আমার কাছে আরো টাইটানিক আছে। সবগুলোকে ভাসিয়ে দিলাম জলে। মাঠের থৈথৈ করা জল, যেখানে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তীব্রভাবে, মাঠের ঘাসগুলোকে দেখাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশের নাম না জানা উদ্ভিদের মত, সেখানে অসংখ্য সাদা কাগজের তরী এক অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি করলো। এখনকার মত সে সময় যদি মুঠোফোন এবং তার ক্যামেরা সহজলভ্য হতো, তাহলে এই দৃশ্যের একটা স্থিরচিত্র আমি অবশ্যই তুলে রাখতাম। যাইহোক, নোকিয়া ২৬০০ দিয়ে ছবি তুলতে পারিনি, এ কথা মনে করে আর মনখারাপ করছি না।
জলপথে একাধিক টাইটানিকের সমারোহ দেখে আমার বন্ধুস্থানীয় অনেকেই কাগজের তরী তৈরী করে নিয়ে এসে টাইটানিকের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। কার নৌকা জিতবে আর কার নৌকা হেরে যাবে, সে নিয়ে তখন তীব্র উত্তেজনা। বোধকরি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নৌকাবাইচের সময়েও এরকম উত্তেজনা হওয়া সম্ভব নয়।
এরকম উত্তেজনায় কেটে গেলো বৈকালিক সংক্ষিপ্ত সময়ের পুরোটা। এবার বাড়ি ফেরার পালা। তখনই মাথায় কুবুদ্ধি চাপলো। পরিচিত মাঠের জলরাশির মধ্যে পদযুগলকে ডুবিয়ে ছপছপ শব্দ তুলে সবাই মিলে চলে গেলাম তরীগুলোর কাছে।আমার টাইটানিকগুলোর অধিকাংশেরই অবস্থা সঙ্গিন। রঙ্গিন কলম দিয়ে লেখা "M.V TITANIC" জলের সংস্পর্শে মুছে গিয়েছে, বহুক্ষন জলে ভেসে থাকার কারণে অনেকগুলো জলযানের কাগজ ছিঁড়ে গিয়ে নিমজ্জিত হয়েছে। বাকিগুলোকে নিমজ্জিত করবার দায়িত্ব নিলাম আমরা। স্ব স্ব চরণের আঘাতে তরীগুলোকে চিড়েচ্যাপ্টা করে কাগজের তরীগুলোর "তরীডুবি"(রবিঠাকুরের নৌকাডুবি'র সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই) ঘটিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
আফসোস, বর্তমানের শিশুকিশোরেরা বিশেষত যারা শহরে থাকে, তারা বাথরুমের বালতির জল কিংবা রাস্তার পাশের ড্রেনে কাগজের তরী ভাসিয়ে কৃত্রিম আনন্দলাভের বৃথা চেষ্টা চালায়। অনেকে আবার রিমোটচালিত, ব্যাটারিশোভিত, ধাতব জাহাজরূপ খেলনা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। তাদের শৈশব, আনন্দ, সুখ সব এখন দূরদর্শনের কার্টুন, কম্পিউটার আর প্লেস্টেশনের মারামারি-কাটাকাটির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
যদি তারা কোনো এক বন্যাপ্লাবিত গ্রামে গিয়ে কাগজের তরী বানিয়ে, বিস্তৃত জলরাশির জলপথে ভাসানোর সুযোগ পেতো, আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, এইসব ছোট ছোট শিশুরা প্লেস্টেশন, কম্পিউটার গেমস, কার্টুন ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতোনা।
কৃত্রিমতা বাচ্চাদের বড্ড অপছন্দের, কিন্তু, পরিতাপের বিষয়, তারা এই কৃত্রিমতার ভয়ঙ্কর নাগপাশেই বন্দী।
মাঝে মাঝে ভাবি,ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে কী কাগজের তরীও রেখে যেতে পারবো না?
প্রশ্ন তো নির্দিষ্ট , কিন্তু উত্তর?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৪