স্যার,
শুরুতেই আমার সালাম নিবেন। জানি আপনি অনেক ব্যাস্ত মানুষ, আমার এই চিঠি আপনার চোখে পড়বে কিনা জানি না। তারপরও সোশাল মিডীয়ার এই যুগে সবার কাছেই সব তথ্য পৌঁছে যায়- এই আশা নিয়ে আপনাকে উদ্দেশ্য করে এই খোলা চিঠিটা লিখার দুঃসাহস করে ফেললাম।
চিঠির শুরুতেই আপনাকে মন থেকে ধন্যবাদ এম এ জলিল অনন্তকে নিয়ে আপনার বস্তুনিষ্ঠ এবং কঠিন কিছু সত্য কথা সবার সামনে অকপটে তুলে ধরার জন্য। মুভি-ঘরানার লোক না হয়েও বাংলা চলচ্চিত্র এবং তার কুশীলবদের প্রতি আপনার ভালবাসা থেকেই কথাগুলো লিখেছেন বলে আপনাকে সাধুবাদ। কিন্তু তারপরও আপনার লেখাটিতে কিছু অসংগতি ছিল, যেগুলোর ব্যাপারে কথা না বললেই নয়।
সিনেমা হলে গিয়ে আপনার “নিঃস্বার্থ ভালবাসা” দেখার অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে অনন্ত জলিলকে নিয়ে দর্শকদের নির্মম রসিকতা এবং অসহিষ্ণু আচরণের বর্ণনা। আপনি জানেন কিনা জানি না, আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম টিকেই আছে এই ‘মজা নেওয়া’ সংস্কৃতির উপরে। যেই দেশের প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, সরকার, বিরোধীদল,সুশীল সমাজ সবাই একের পর এক হতাশ করে যাচ্ছে মানুষকে, সেই দেশে চুপচাপ মুখ বুজে সব সহ্য করে মুখে সস্তা হাসি ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া আর বেশি কিছু করার নেই ‘ভাল থাকা’র জন্য। এবং এই মজা দেওয়া এলিমেন্টগুলোর লিস্টে শুধু অনন্ত জলিলই না, আরো অনেক এলিমেন্টই আছে যেগুলো প্রসঙ্গক্রমে আমার লেখায় উল্লেখ করবো। তাই অনন্ত জলিলকে নিয়ে নির্মম রসিকতা করলে এর দায় তরুণ প্রজন্মের উপর কমই চাপানো যায়, কারণ সস্তা মজা নিয়ে কোনভাবে জীবন পার করা ছাড়া আমাদের সামনে এখন খুব বেশি পথ খোলা নাই। তবে তাই বলে শুধু রসিকতা করার জন্য তার পারসোনাল জীবনে আক্রমণ করাটাকে আমি কোনভাবেই সমর্থন করি না, যেটা হয়েছিল গত বছর ঈদে ধানমন্ডী পিজা হাট/ কেএফসি’তে।
এদেশের একজন সন্তান অনন্ত জলিলের এরকম
বাংলা চলচ্চিত্রে অনন্ত জলিল সাহেবের অবদান কতটুকু সে হিসাবে আমি যাব না। কারণ আমার মনে হয়েছে তিনি চলচ্চিত্রশিল্পের ফাউন্ডেশনের ইটগুলো খুলে নিয়ে সেই ইট দিয়ে বিল্ডিং এর উপরের তলা বানানোর একটা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে একসময় পুরো বিল্ডিংটাই ধসে পড়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। আপনি প্রশ্ন রেখেছেন জলিলকে নিয়ে আমাদের অতিরিক্ত হাসাহাসির পিছনে কি আমাদের অহমবোধ, স্মার্টনেসের বড়াই, শ্রেণী অবস্থান নিয়ে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগা কাজ করছে কিনা? আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এর একটিও কাজ করছে না। তিনি তার চলচ্চিত্রের পিছনে কাড়ি-কাড়ি টাকা ঢালছেন, স্পেশাল ইফেক্টস ইউজ করছেন, দেশী-বিদেশী অভিনেতা কাস্ট করে মুভির ইন্টারন্যাশনাল রিলিজ দিচ্ছেন- এসব কারণে কি আমরা তার মুভিগুলোর দুর্বল দিকগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাব? জলিলের সিনেমাগুলোতে কি স্টোরীলাইন আরো শক্ত করা যেত না? তার অভিনয়ের দক্ষতা/ এক্সপ্রেশনের দিকে আরেকটু মনোযোগ দিলে ভাল হতো না? স্পেশাল ইফেক্টের অতিমাত্রায় এবং অদরকারী প্রয়োগের বদলে তার দশ ভাগের এক ভাগ অর্থ খরচ করে জলিল সাহেবের ভয়েজটা ডাবিং করানো যেত না? শুধুমাত্র কাড়ি-কাড়ি টাকার জোরে কি তার সব দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়া যায়? না, যায় না। বরং আমার দৃষ্টিতে জলিল সাহেব যেটা করছেন তা হল সুকৌশলে নেগেটিভ মার্কেটিং, খুব সচেতনভাবেই নিজেকে হাস্যকর করে তোলার একটা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মানুষ আপনাকে নিয়ে মজা নিবে, তামাশা করবে, আপনার ছবির ট্রল বানিয়ে ফেসবুক ভরিয়ে দিবে, কিন্তু ঠিকই গাঁটের পয়সা খরচ করে আপনার সিনেমা দেখতে হলে যাবে। আখেরে লাভটা কার? ফ্রী মার্কেটিং হচ্ছে, হাইপ বাড়ছে, ছবি মুক্তির ৪সপ্তাহ পরেও হলে গিয়ে ‘হাউজফুল’ বোর্ড দেখে অনেক মানুষ বাসায় ফেরত আসছে। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে জলিল সাহেবকে আমি কোনভাবেই দোষ দিতে পারিনা। তিনি অর্থলগ্নি করেছেন, সেটার বিপরীতে যত টাকা আয় করবেন ততই তার লাভ। এদিকে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ পেয়ে দর্শকও খুশি, যে যেভাবে পারছে মজা নিচ্ছে। এমনকি আপনার লেখার শেষ পরিচ্ছদেও আপনি লিখেছেন লিখেছেন “আমাদের চারপাশে দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য অনন্ত জলিল”। এখানে কি বলা যায় না যে আপনিও অনন্তকে নির্মল ঠাট্টা-তামাশার খোরাক একজন হাস্যাস্পদ ব্যাক্তি হিসেবেই তুলে ধরেছেন? তবে দিনশেষে সব টিটকারী সহ্য করেও বক্স অফিসের হিসাব মিলিয়ে শেষ হাসিটা জলিল সাহেবই হাসছেন এই ভেবে যে তাকে বোকা ভেবে মজা নিতে এসে কয়েক লাখ হাঁদারাম তার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কয়েক কোটি বাড়িয়ে দিয়ে গেল। ঠিক এই কাজটাই কিছুদিন আগে করেছে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ এশিয়া, জিএম ডোরস। চরম বাজে, কুরুচিপূর্ণ এবং আপত্তিকর বিজ্ঞাপন করে লোক হাসিয়েছে- গালি খেয়েছে, কিন্তু তাদের মার্কেটিং হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ৫গুণ বেশি। তাহলে জেনেশুনে নেগেটিভ মার্কেটিং করে দিনশেষে যদি ভোক্তা-উৎপাদক দুই পক্ষই খুশি থাকে তবে তাতে আপনার-আমার সমস্যা কি? আমরা খুব বেশি হলে এই নেগেটিভ মার্কেটিং সিস্টেমটাকে দোষ দিতে পারি, ভোক্তা কিংবা উৎপাদককে দোষ দেওয়াটা এখানে কোনভাবেই সমীচিন নয়।
আপনি বলেছেন আমাদের তরুণ প্রজন্মের সামনে আইডলের অভাব। রজনীকান্ত যদি দক্ষিণ ভারতে অনন্ত জলিলের চেয়েও ‘বেসম্ভব’ কান্ডকারখানা করে ভগবানের পর্যায়ে চলে যেতে পারে তবে আমাদের অনন্ত কেন এত অবহেলা-লাঞ্ছনার শিকার হবে? ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রী এবং সেখানকার দর্শক কতটা অপরিপক্ক্ব এবং হাস্যকর সে কথাটা উল্লেখ করলেন না কেন? যেই দেশে চেন্নাই এক্সপ্রেস, দাবাং, ওয়ান্টেড, মার্ডার এর মত অখাদ্য চোখের নিমিষে শতকোটি রুপি আয় করে, মুভি রিলিজের আগেই শীলা-মুন্নীর ঝলক দেখিয়ে অন্তত ৫০কোটি রুপীর নিশ্চয়তা চলে আসে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজের স্পন্সরে আর স্বদেশ, চাক দে ইন্ডিয়া ফ্লপ; কাই পো চে সেমিহিট (ব্যাতিক্রম রাং দে বাসান্তি, থ্রী ইডিয়টস) সেদেশের ইন্ডাস্ট্রী ও দর্শককে আপনি অনুসরণ করতে বলছেন? রজনীকান্তের উদাহরণ যেহেতু টেনেছেন, ধরে নিচ্ছি চাক নরিসের নামও আপনি অবশ্যই শুনেছেন। এরা হয়তো নির্দিষ্ট কিছু নির্বোধ দর্শকের কাছে পূজনীয়, কিন্তু সারা বিশ্বে এদেরকে হাস্যকর কর্মকান্ডের চুড়ান্ত সীমা হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। এখনও কি আপনি সাজেস্ট করবেন যেই দেশে আমরা আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাক, জাফর ইকবাল, আলমগীর, সালমান শাহের মত নায়ক; জহির রায়হান, খান আতা’র মত পরিচালককে দেখে বড় হয়েছি- সেইদেশে আমরা অনন্ত জলিলের মত নায়ক-পরিচালককে আইডল মেনে একটি মডেল আরিফ খান সদৃশ মুরাদ টাকলা প্রজন্মের দিকে এগিয়ে যাব?
স্যার, আপনার লেখার পরবর্তী অংশে আপনি উল্লেখ করেছেন আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্ববৃন্দের পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবকে এবং তা থেকে ভুল শিক্ষা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের শ্রদ্ধাহীনতার। এ অংশটিতেও আমি দ্বিমত পোষণ করব। আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কারো থেকে শিক্ষা নিয়ে বয়োজেষ্ঠ্যদের উপর শ্রদ্ধা হারাচ্ছে না, হারাচ্ছে বয়োজেষ্ঠ্যদের কার্যকলাপের নীতিহীনতা, স্বার্থান্বেষী মনোভাব, অন্যায়ের সাথে আপোষ এবং লাগামছাড়া দুর্নীতি দেখে। তারা ব্যাক্তির সমালোচনা করছে না, করছে ব্যাক্তিটির কার্যকলাপের। আপনার একটি কথা ঠিক- এই প্রজন্মের কোন আইডল নেই। বর্তমান প্রজন্ম কাউকে অনুসরণ করছে না, তারা দল-মত-নির্বিশেষে যেকোন অন্যায়েরই প্রতিবাদ করছে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। আপনার সাথে আমার মতপার্থক্য থাকার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু গত বছরের ১৫মার্চ আপনাকে যখন একটি টকশো’তে দেওয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে তলব করা হল, বিডিনিউজে খবরটা দেখার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাগে-দুঃখে একটা লেখা লিখেছিলাম আপনার অনেক কর্মকান্ডে আপনার উপর ক্ষোভ জমা থাকা সত্ত্বেও (লেখাটির লিঙ্ক http://goo.gl/mZrDWU ) তাই আপনি কোনভাবেই বলতে পারেন না কারো কথায় কিংবা কাউকে অনুসরণ করে আমরা শ্রদ্ধাহীন হয়েছি। বরং ব্যাপারটাকে যেকোন অন্যায্য পরিস্থিতির বিরুদ্ধে অকপট উচ্চারণ হিসাবে দেখলেই ভাল হয়।
আপনি বলেছেন একজন নোবেল লরিয়েট, একজন বিচারপতি, একজন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং একজন প্রবীণ সাংবাদিকের অশ্রদ্ধার কথা। আইনপেশায় আপনার অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন প্রাসঙ্গিক এবং অবশ্যই উল্লেখ করার মত কিছু ব্যাপার। নোবেল লরিয়েটের অশ্রদ্ধাটা আমারও অপ্রিয়। তিনি যা-ই করুন না কেন, দেশের জন্য খুব দুঃসময়ে অনেক বড় খুশির একটা সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন এটা আমরা খুব সহজে ভুলে যাই। প্রবীণ সাংবাদিকটি কে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। তবে আপনি যদি এখানে আমার দেশ এর সম্পাদকের কথা বলে থাকেন তাহলে ধরে নিব আমার কষ্ট করে এই চিঠিটা লেখা খুব বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তবে তিনবারের নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীর একটি সুনির্দিষ্ট জন্মদিন না থাকাটা কি আপনার নিজের কাছেই হাস্যকর মনে হয়না। শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা যিনি কিনা এই জাতির জনক, তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুবার্ষিকীতে কেক কেটে জন্মদিন পালন করাটা যে লেভেলের নিষ্ঠুরতা- তার তুলনায় বর্তমান প্রজন্মের টিটকারিটা খুবই নগণ্য নয় কি? এবার সেই বিচারপতির প্রসঙ্গে আসি। প্রমাণিত এবং আত্মস্বীকৃত একজন গণহত্যার সংগঠককে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত না করাকে “প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর সততা” শব্দ তিনটি দিয়ে মহিমান্বিত করা আর গোলাম আজমের ১৯৭১ সালের অপকর্মকে তার ‘দেশপ্রেম’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া আমার জন্য সমান পরিমাণের হাস্যকর কথা। অন্তত ’৯২ এর গণআদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে আপনি আমার চেয়েও ভালভাবে জানেন যে শুধুমাত্র জামাত-শিবির এবং রাজাকারদের রাজনৈতিক দোসর ছাড়া বাংলাদেশের আর সব মানুষের প্রত্যাশা কি ছিল। ১৬কোটি মানুষের ন্যায়বিচার প্রত্যাশাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা উঠিয়ে দেওয়াটাই কি আপনার কাছে “প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর সততা” এর মূর্ত প্রতীক?
সবশেষে এটুকুই বলব, এম এ জলিল অনন্ত অভিনেতা-পরিচালক-প্রযোজক হিসেবে যত হাস্যরসেরই জন্ম দেক না কেন, মানুষ হিসাবে ওনাকে একজন ভাল মানুষ হিসেবেই আমি জানি। তাকে উপজীব্য করে কলাম লিখে একজন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, একজন “প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর সততা” এর অধিকারী বিচারপতির হাস্যকর রকমের অন্যায্য কর্মকান্ডকে সুগারকোট করে আমাদের ভুলানোর চেষ্টা করে অনন্ত জলিল সাহেবকে অপমান করবেন না।
ইতি,
তরুণ প্রজন্মের একজন।
আসিফ নজরুল সাহেবের নিচের লিঙ্কের কলামের জবাবে এই চিঠিটি লেখা হয়েছে।
http://goo.gl/GPeuKa