২০০৯ এ বন্ধুদের সাথে যেবার সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম, সেবারই মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, মাকে নিয়ে একবার ঐ নীলপ্রবালদ্বীপে যাবো। প্রায় তিন বছর পর স্বপ্নটা সত্যি হলো! এটাকে আমি স্বপ্নই বলবো। কেননা ছোটবেলায় মার সাথে অনেক জায়গায় ঘুরোঘুরির অভিজ্ঞতা থাকলেও বেড়বেলায় তেমনটি হয়ে উঠেনি। অবশ্য সব স্মৃতিই যে এখনও মনে আছে এমনও নয়! মায়ের কোলে চড়ে প্রথম কক্সবাজার যাওয়ার অভিজ্ঞতা এখন শুধুই ফটোগ্রাফ হয়ে আছে! মা'র ভাষ্যমতে সমুদ্র দর্শনের চেয়ে আমাকে সামলাতেই মায়ের পুরোটা সময় কেটেছে।
যদিও সেন্টমার্টিনের কথা বলতে মা শুরুতে রাজি ছিলেন না, তবুও তিন ছেলের কথা উপেক্ষা করাও সম্ভব নয়। তাই নির্ধারিত দিনে সব গোছগাছ শেষে আমারা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যঠিকই বেরিয়ে পড়ি। চিটাগংয়ের সিনেমা প্যালেস থেকে বাসে করে প্রথমে টেকনাফ, এবং টেকনাফ থেকে কেয়ারিতে সেন্টমার্টিন।
রাতের বাস। ভোরে যখন টেকনাফের কাছাকাছি, কী অদ্ভুত সুন্দর সেই পরিবেশ। রাতের হালকা ঝিমুনি কেটে যেতেই দেখি চারপাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। রাস্তার দু'পাশে ছোট ছোট টিলা আর যতদূর চোখ যায় সেগুন আর গামারি গাছের বন। মাঝে মাঝে বিশালবিশাল মেহগনি আর আকাশি গাছের দেখা মিলছে। সেই বিশাল বিশাল সব গাছের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দ ভোর নামছে সুদীর্ঘ রাতের অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে। ভোরের নরম আলোয় সেই সবুজ বন কী পবিত্র মনে হয়! মনে হচ্ছিল কোন ভুবন বিখ্যাত শিল্পীর নিঁখুত তুলিতে আঁকা পট্রেট। একবার কল্পনা করুন, যে সময়টায় আপনি প্রতিনিয়ত আয়েশী ঘুমে কাটিয়ে দিচ্ছেন ঘরের চৌহদ্দীর ভেতরে, তেমনি এক সময়ে প্রসন্ন ভোরে দুইপাশে বিস্তীর্ন সবুজ বনানীর মাঝ দিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিচ্ছেন ভাবতে কি একটুও অন্যরকম লাগছে না? আর সে সময় যদি আপনার প্রিয় মানুষটি আপনার পাশে থাকে- হয়তো আপনার কাঁধে বা বুকের প'রে মাথা এলিয়ে দিয়েছে আলতো করে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে প্রিয় মুহূর্তে কাছে পেয়ে আপনি হয়তো তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি ভাবছেন। থাক এসব কথা আর না বলি - আমার নিজেরই দীর্ঘশ্বাস পড়ছে!
টেকনাফ শহরটা সমুদ্র সৈকতের জন্য যতটা বিখ্যাত, বোধকরি তারচেয়ে বেশি বিখ্যাত মাথিনের কুপের কারনে। (ভালবাসার এক ভিনদেশী যুবকের** অপেক্ষায় থেকে জীবন উৎসর্গকারী পাহাড়ি রাজার মেয়ে মাথিনে একমাত্র স্মৃতিচিহ্ণ) এবার সময়ের অভাবে দেখতে যাওয়া হলো না। টেকনাফে নেমে হালকা নাস্তা সেরে বর্মা ও বাংলাদেশকে দুভাগ করে দেয়া নাফ নদীর সবুজ জলে দুলতে থাকা লঞ্চ কেয়ারিতে উঠে পড়লাম। একপাশে টেকনাফের উঁচু পাহাড়ের সারি আর নাফ নদীর জল সেই সবুজ পাহাড়ের পায়ে চুমু খেয়ে এগিয়ে গেছে সাগরের দিকে। আর অন্যপাশটায় বর্মা সীমান্ত। লঞ্চ যাত্রায় একটু খেয়াল রাখলেই নাফ নদী ও সাগরের মোহনায় ইরাবতী ডলফিনের দেখা পাবেন। লঞ্চের ডিকিতে দাঁড়িয়ে নাফ নদীর সবুজ জলে মগ্ন হয়ে পড়ি। ভুলে যাই অতীত- ভবিষ্যত। ভুলে যাই অফিস- দীর্ঘ জ্যাম। নদীর জলে চোখ রেখে আমি নদীকে সুধাই, নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
নদী বলে, মহাদেবের জটা হইতে!
নাফ নদী পাড়ি দিয়ে সেন্টমার্টিন পৌঁছাতেই সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে শুধু নীল আর নীল! স্বচ্ছ সবুজ নীল। সে এক অনন্য সাধারণ অনুভূতি! সে কখন মনে নেই, অনেক আগে একজনকে বলেছিলাম, তোমাকে নিয়ে সমুদ্র দর্শনে যাবো।
সে হেসে বলেছিলো, আমার চোখের দিকে তাকাও।
আমি তার প্রসন্ন চোখের দিকে তাকালাম। সে বলল, কি দেখলে?
আমি বললাম, নীল!
সে গভীর চোখে চেয়ে বলল, সমুদ্রও নীল হয় জানো তো? আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। তার চোখের স্বচ্ছ সবুজ নীলে ডুবে যেতে থাকলাম...
* ছবিগুলো মোবাইলে তোলা
** ধীরাজ ভট্টাচার্জ নামের সেই যুবক পরবর্তীতে মাথিনের স্মৃতিচারণ করে একটি বই লিখেছিলেন এবং কলকাতার ছবিতে নায়ক চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন।