যেকোনো রাষ্ট্রেই আদালত সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে নিজেকে আটকে রেখে সে সংবিধানের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নাগরিক অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করে। সংবিধানের সীমিত পরিসরে যেসব নাগরিক অধিকার স্পষ্টতা পায় না, আদালত সেসব নাগরিক অধিকারকে স্পষ্ট করে তোলে।
যখন রাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামোর ভেতরে নাগরিকের অধিকার খর্ব হয়েছে নাগরিকের ভেতরে যখন এমন বোধ তৈরি হয়, নাগরিক সে অধিকার স্পষ্ট করতে বিচার বিভাগের বিবেচনা দাবী করে- বিচার বিভাগ তার কাঠামোর ভেতরে অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে তার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে।
নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিচার বিভাগ এবং আদালতের কর্মসূচি এই সীমিত পরিসরে ঘোরাফেরা করে। স্থুল বুদ্ধির মানুষ যারা নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রের অঙ্গীকার এবং সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিগুলোর ভেতরে কোনো পার্থক্য করতে পারে না, তারা আদালতে গিয়ে নিজের উপরে ঘটে যাওয়া অবিচারের কিংবা অন্যায়ের প্রতিকার দাবী করে।
আদালত কিংবা রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের দায়িত্ব মূলত: মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে এক ধরণের স্পষ্টতা প্রদান করা এবং একই সাথে মৌলিক অধিকারগুলো যেনো নাগরিক ভোগ করতে পারে সে নিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি করা। রাষ্ট্রের সংবিধান এবং অন্যান্য আধুনিক রাষ্ট্রের মানবাধিকার বিধান মূলত মৌলিক অধিকারগুলোকে স্পষ্ট করতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিনিয়ত নিজেকে ধার্মিক প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত এবং ধর্মপালনের উৎসাহে রাষ্ট্র অনিবার্য ভাবেই একটি নির্দিষ্ট ধর্মমতের বাইরের সকল মতবাদকে অগ্রাহ্য করছে এবং নাগরিক অধিকার পুরণে বৈষম্য তৈরি করছে।
আদালতের নির্দেশে বর্তমান সরকার সংবিধান সংশোধন করেছে এবং সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা অংশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছে
ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্যে
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন,
বিলোপ করা হইবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বিধি যা সংবিধানের অন্তর্গত অসামঞ্জস্যতা সেটা নিরসনের কোনো উদ্যোগ নির্বাচিত সংসদ গ্রহন করে নি। বরং আজ যখন ব্লগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহানবী হযরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কটূক্তিকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন এবং এর কার্য পরিচালনা করা যে সংবিধান লঙ্ঘনের অপরাধে দুষ্ট সে বিবেচনা আমাদের ধার্মিক প্রধানমন্ত্রীকে বিচলিত করে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। [ সংবিধান ধারা ১১] এটি বাংলাদেশের নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। আদালত মূলত এই মৌলিক মানবাধিকারের সীমানা নির্ধারণ করবে।
সংবিধান ২১ নং ধারায় নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য হিসেবে ব্যক্ত করেছেন
(১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য৷
(২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য৷
রাষ্ট্রের প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী যদি রাষ্ট্র প্রধানের অত্যুৎসাহে সংবিধান ও আইন বিরোধী কোনো কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় সেটার দায় মূলত রাষ্ট্রপ্রধানের উপরে বর্তায়।
সংবিধানের ২৭ নং ধারায় বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
সংবিধানের ২৬ নং ধারায় এসে রাষ্ট্র ঘোষণা করছে মৌলিক অধিকারের সহিত অসমঞ্জস আইন বাতিল করা হবে। (১) এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
যদিও বাংলাদেশের পেনাল কোডের ২৯৫ এ [১৮৬০] বিধি মতে ধর্মের প্রতি কটুক্তি করলে এবং মানুষের ধর্মীয় অনুভুতিকে আহত করলে কারাদন্ডের বিধান অন্তর্ভুক্ত আছে কিন্তু ধর্মের প্রতি কটুক্তি কিংবা মানুষের ক্রমস্ফীত ধর্মানুভুতি আহত হওয়া এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে আধুনবিক রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবস্থান যাচাইয়ের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।
বাংলাদেশের ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৯৯ ধারা অনুসারে
"the government may confiscate all copies of a newspaper if it publishes anything subversive of the state or provoking an uprising or anything that creates enmity and hatred among the citizens or denigrates religious beliefs. The magistrate can send police with a warrant to the place where these newspapers are found. The aggrieved person can take the matter to the notice of the high court."
ব্যক্তিগত ব্লগ কিংবা ফেসবুক আসলে এই ধারার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কি না এ বিষয়েও কোনো পর্যালোচনা করা হয় নি। ব্যক্তিগত ব্লগে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের ফলে অন্য কারো ধর্মবোধ আক্রান্ত হলে সেটাকে অপরাধ গণ্য করা যৌক্তিক হবে কি না এ বিষয়ে কোনো আলোচনা বাংলাদেশে হয় নি কিন্তু অপরাপর রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পরিসীমা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত।
মুসলিন জনবহুল রাষ্ট্র ব্যতিত বিশ্বের অন্যান্য দেশে গত ১০০ বছরে ব্লাসফেমী কিংবা ধর্ম অবমাননার অপরাধে সম্ভবত ২০ জন ব্যক্তিকে ন্যুনতম জরিমানা করা হয়েছিলো এবং গত ৫০ বছরে ধর্ম অবমাননা আইন রয়েছে এমন রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে শুধুমাত্র জার্মানীতে হেট স্পীচ এবং ধর্ম অবমাননার দায়ে একজন ব্যক্তিকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
অপর দিকে মুসলিম দেশগুলোর মানবাধিকার, মত প্রকাশের ও বিরুদ্ধ মত প্রকাশের অধিকার সীমিত এবং সেখানে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্র মত প্রকাশের স্বাধীনতায় নানাবিধ নিষেধ আরোপ করে, সেসব স্থানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয়েছে। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শুধুমাত্র মুসলমান দেশগুলোই ব্ল্যাসফেমী আইনের প্রয়োগ করেছে ।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ ধর্মকে অস্বীকার করা, ধর্মের বিধানকে অস্বীকার করা এবং সেটা প্রচার করাকে মানুষের ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং যদি বাংলাদেশ মানুষের মৌলিক অধিকারের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা মান্য করতে চায় তাহলে তাদেরও কোনো না কোনো ভাবে মানুষের মর্যাদা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে ব্লাসফেমী আইন রদ করতে হবে। সেটা না করে বিশেষ একটি ধর্মের বিশেষ একজন ব্যক্তির প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ব্যক্তিগত ব্লগ খুঁজে তাকে অভিযুক্ত করার অসাংবিধানিক চর্চায় উদ্যর বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
অপরাপর ধর্মের প্রধান ব্যক্তি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বিধি এই নজরদারির আওতায় আসে নি, সেটা এক ধরণের নাগরিক অধিকারের বৈষম্য। সেটা স্পষ্টই সংবিধান লঙ্ঘন।
নাগরিকের ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে এবং এই অসাংবিধানিক আচরণকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বৈধ্যতা দেওয়ার আয়োজন চলছে।
ধর্মপুলিশের আগমনে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, মানুষের বাকস্বাধীনতা খর্বিত হয় । শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থা ব্যতিত মানুষের মৌলিক অধিকারের উপরে হস্তক্ষেপ ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রনের কোনো ক্ষমতা সাংবিধানিক সরকারের নেই।
শেখ হাসিনা তার পরামর্শে নাগরিকের বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছেন, একদল ধর্মবিকৃত মানুষের ভোটের লোভে নিজেদের অতিআস্তিক প্রমাণের তাড়নায় ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং ধর্ম না পালনের স্বাধীনতায় এক ধরণের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সেসবকে অপরাধ পর্যায়ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
তার নির্দেশনায় সরকারী কর্মচারীরা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্যবিধি ভুলে অসাংবিধানিক আচরণ করছেন এবং এখনও এই বৈষম্য বিষয়ে কাউকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দিতে শুনি নি। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ মেনে নিলে বলতে হবে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবেই ক্রমশ: এক ধরণের সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র সৃজনের উদ্যোগ নিচ্ছি
১. ১৩ ই মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩১ ০