বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং মর্মান্তিক গণহত্যা, আন্তর্জাতিক বৈরিতা এবং প্রায় সামরিক অভিজ্ঞতাহীন একটি জনগোষ্ঠীর অসংখ্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিখাদ দেশপ্রেম সম্বল করে ৯ মাসে একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের ইতিহাসে একটি অভুতপূর্ব ঘটনা ছিলো। এর চেয়ে বড় মাপের প্রস্তুতি নিয়েও অনেক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পরেছে, কিংবা দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের পর উভয় পক্ষ অবশেষে এক ধরণের সমঝোতার মাধ্যমে পরস্পরের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে কিন্তু সর্বক্ষেত্রে নিরংকূশ বিজয়ের আস্বাদ নিতে পারে নি।
আমাদের এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল শক্তি ছিলো আমাদের দেশপ্রেমিক জনতা কিন্তু স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে সাধারণ জনতা এই বিজয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার কিংবা স্বীকৃতিটুকু পায় নি। এক ধরনের রাজনৈতিক দীনতা সেখানে ছিলো, তারপরও প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা নিজের দেশপ্রেমের জায়গা থেকে স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলো, নয় মাস নিরন্তর সঙ্গে থেকে এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তিনি জনগণের আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রথম সপ্তাহে তার বিভিন্ন ভাষণ ও বিবৃতিতে সেটুকু স্পষ্ট হয়ে যায় কিন্তু ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই এই বিজয়ের স্বীকৃতি কিংবা তাজউদ্দিনের প্রস্তাবিত পুনর্গঠনের রাস্তায় হাঁটে নি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কি কারণে কি প্রয়োজনে তাজউদ্দিন আহমেদ অপাঙতেয় হয়ে গেলেন সেটা নিয়ে বিভিন্ন গুজব ও আলোচনা আছে, সেসব পাশ কাটিয়ে বলি বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেখানে যাওয়ার কথা ছিলো সেই কাঙ্খিত স্বদেশ নির্মাণের ব্যর্থতার দায়টুকু দীর্ঘ সময় আসলে বিচারহীনতার সংস্কৃতির উপরেই চাপানো হয়েছে।
দালাল আইনে বিচারাধীন ব্যক্তিবর্গের বিচার স্থগিত করা এবং সংবিধান সংশোধন করে অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সূযোগ করে দেওয়াকে অনেকেই এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির সূচনাবিন্দু হিসেবে নির্দিষ্ট করেন এবং আওয়ামী লীগের দলীয় ও আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুগত বুদ্ধিজীবীগণ এই মতাদর্শিক ধারায় নিজেদের স্থাপিত করেছেন।
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্য কর্মী এবং সক্রিয় জনগণের ভেতরেও অস্পষ্ট আকারে হলেও এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের স্পষ্ট ক্ষোভ ছিলো, কাদের মোল্লার বিচারের রায়কে যারা এক ধরণের রাজনৈতিক সমঝোতার রায় হিসেবে বিবেচনা করে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাদের মনে হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় অধঃপতনের সূচনা যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে শুরু হয়েছে, কাদের মোল্লার রায় সেই সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করায় তরুণ প্রজন্ম যেমন কৃতজ্ঞ একই ভাবে বইচারের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতি করবে এমন একটা আশংকাও তাদের ছিলো, কাদের মোল্লার রায় ভোটের রাজনীতিতে চলমান বিচারিক প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার চক্রান্ত এমন একটা সংকেত তারা পেয়েছিলো, সে কারণে এই আন্দোলনের আওয়ামী বিরোধী হয়ে ওঠার একটা সম্ভবনাও ছিলো।
এই বিক্ষোভ আশংকা কিংবা হতাশা যে শুধু ঢাকাকেন্দ্রীক একদল অনলাইনজীবী তরুণের হতাশা ক্ষোভ বিক্ষোভের প্রকাশ নয় সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় পরের দিনই যখন সারা দেশের বিভিন্ন চত্ত্বরে এমন গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠে। বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষুব্ধ মানুষেরা এই তরুণদের প্রতিবাদে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহন করে, তারা ভেবেছিলো সার্বিক গণজাগরণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধের সূচনা হচ্ছে এখানেই, এখানেই তারা বিচারহীনতার সংস্কৃতির কবর খুড়ছেন।
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ খুব স্পষ্ট ভাবেই ঢাকার বাইরের সকল গণজাগরণ মঞ্চের সাথে একীভূত হতে চায় নি, তারা প্রতিটি অঞ্চলকে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতার ভেতরে রেখেছে, হয়তো সেটার কৌশলগত প্রয়োজন ছিলো কিংবা সেটা আমার ধারণা একান্তভাবেই নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিলো। কারণ আমার সামান্য পরিচিত মহলের যারা শাহবাগে নেই তারা সবাই মূলত কেন্দ্র কিংবা শাহবাগের কর্মসূচির দিকে তাকিয়ে ছিলো, তাকিয়ে ছিলো শাহবাগের ঘোষণা মঞ্চের দিকে, কিন্তু শাহবাগ তার আন্দোলনের বেগ স্থিমিত হওয়ার পরেও এখনও তেমন সার্বজনীন কোনো ঘোষনা দেয় নি। তারা এইসব বিচ্ছিন্ন কেন্দ্রকে নিজেদের সাথে একীভূত করে একটি বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তোলার আগ্রহ পায় নি কিংবা তাদের সে দক্ষতা ছিলো না।
শুধু তাই নয় বরং প্রথম থেকেই যারা কোনো না কোনো ভাবে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা বোধ করে নিজের প্রাণের তাগিদে কোনো না কোনো পরামর্শ দিতে গিয়েছে, তারা এক ধরণের স্পষ্ট নিরবতার আড়াল দেখেছে, তাদের প্রতিটি পরামর্শ কিংবা সদবিবেচনা এক ধরণের শীতল অভর্থ্যনা পেয়েছে, ফলে যারা এই ধরণের আগ্রহের জায়গা থেকে গণজাগরণ মঞ্চের মূল পরিচালক হিসেবে যারা গণমাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছে তাদের সাথে আলোচনা করতে গিয়ে এক ধরণের অচ্ছুত অনুভুতি নিয়ে ফেরত এসেছেন। তারা উপযাচক হয়ে যেসব পরামর্শ দিতে চেয়েছেন সেসব গ্রহনের অসামর্থতা কিংবা অদক্ষতা তাদের পীড়িত করেছে এবং তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং গণজাগরণ মঞ্চের অন্যান্য ঘোষণার সাথে নৈতিক ও মানসিক একাত্মতা বোধ করলেও তারা নিজেদের ঠিক গণজাগরণ মঞ্চের একজন হিসেবে ভেবে নিতে পারেন নি। গণজাগরণ মঞ্চ আসলে তাদের নিজস্ব নিরবতার দেয়ালে সকল সমর্থকদেরই ডিজঔন করেছে। আন্দোলনের সাথে থাকলেও তারা গণজাগরণের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারেন নি। তারা বৃহত্তর লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে ভেবেছেন যদি আমার নিরবতায় এই লক্ষ্য অর্জিত হয় তাহলে আমি নিরব থাকাটাই শ্রেয়।
১৫ই ফেব্রুয়ারী উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গণজাগরণ মঞ্চ "রাজীব"কে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিলো, তবে 'রাজীব'কে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিক্রিয়া খুব একটা সুখকর না, রাজীব প্রশ্নে গণজাগরণ টালমাটাল আস্তিক নাস্তিক বিতর্কে, ২২ তারিখের সমাবেশের সকল ধর্মের ঐক্যতানের রাজনীতি সেই চলমান বিতর্কের রাশ টেনে ধরার প্রয়াস ছিলো। গণজাগরণ যেই একটি স্বীকৃতি দিয়েছিলো সেটার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় এরপর থেকে গণজাগরণ আর কাউকে স্বীকৃতি দেয় নি।
গণজাগরণ জগতজ্যোতিকে সেভাবে স্বীকৃতি দেয় নি, মানে মিডিয়ায় যতবার বক্তব্য এসেছে সেখানে তারা জগতজ্যোতিকে সেভাবে উপস্থাপন করে নি। এমন কি গতকাল ত্বকীর মৃত্যু যেভাবে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে নারী সমাবেশের বক্তৃতা পাঠ করে আমার কখনও মনে হয় নি গণোজাগরণ ত্বকীর বিষয়টা সেভাবে শাহবাগ প্রজন্ম চত্ত্বরকে স্পর্শ্ব করেছে।
ব্যক্তিগত যোগাযোগহীনতা কিংবা দুরত্ব মেনে নিয়ে বলছি আমি একজন পাঠক এবং দর্শক হিসেবে সেই বিষয়টা দেখি নি। কিন্তু গতকাল থেকে আস্তিক নাস্তিক বিতর্কটা নতুন মাত্রা পেয়েছে, উপেক্ষা কিংবা নীরবতার ডিজঔন বিষয়টা একেবারে স্পষ্ট বক্তব্য আকারে উঠে এসেছে সামিউর নামক ফেসবুকার/ব্লগারকে সরাসরি গণোজাগরণ মঞ্চের সাথে সাংগঠনিকভাবে বিচ্যুত একজন হিসেবে উপস্থাপনের পর।
রাজীব ইস্যুর পর গণজাগরণ মঞ্চ স্বীকৃতি বিষয়ে সচেতন এবং তারা সামিউরকে যে কি না নিজেকে উপস্থাপন করতো নাস্তিক নবী হিসেবে, তাকে স্বীকৃতি দিবে গণজাগরণ কর্মী হিসেবে এটা আশা করা ভুল। তার সরাসরি অংশগ্রহন বিষয়ে কিংবা প্রনোদনামূলক উপস্থিতি বিষয়ে স্পষ্ট সচেতন হলেও যেখানে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শাহবাগ এক ধরণের নাস্তিক মিলনায়তন হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে গণমাধ্যমে, যেভাবে ওয়াজে খুতবায় শাহবাগীদের নাস্তিক হিসেবে তুলোধুনা করা হচ্ছে সেখানে 'নাস্তিক নবী'কে স্বীকৃতি দিয়ে নতুন করে উন্মাদনার আগুণে ঘি ঢাকার আগ্রহ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের না থাকাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।
তারা শাহবাগ গণজাগরণের সাথে সামিউরের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করে নি বরং বক্তব্যটা স্পষ্ট, যারা গণজাগরণ মঞ্চের পরিকল্পনাকারী কিংবা যারা গণজাগরণ মঞ্চের নীতিনির্ধারক, এই 'নাস্তিক নবী' তাদের কেউ না। সে কোনো সিদ্ধান্তগ্রহনের ক্ষমতা রাখে না। এই কৌশলগত অস্বীকৃতি বৃহত্তর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রয়োজনীয়।
কাঠামোভিত্তিক বিবেচনায় সুসংগঠিত না হয়েও এক দল সচেতন মানুষের সক্রিয় উপস্থিতিতে, তাদের কৌশলগত একাত্মতায় গণজাগরণ মঞ্চের প্রাপ্তি কিন্তু কম না। আমরা এই একটা আন্দোলনে অনেক কিছুই অর্জন করেছি। যুদ্ধাপরাধী সংগঠনগুলোকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। সেই লক্ষ্যটুকু পুরণ হওয়া পর্যন্ত আমরা ধৈর্য্য ধরে থাকি।
আস্তিক নাস্তিক বিতর্ক, মিডিয়াবাজী নিয়ে নানা ধরণের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সংগত অসংগত ক্ষোভ সবার ভেতরে থাকতেই পারে কিন্তু এইসব আমরা মেনে নিয়েই আন্দোলনের সাথে একাত্ম। আমাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য পুরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই সাময়িক বিভেদের আগ্রহ থেকে সচেতন ভাবে দূরে সরে থাকি।
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ শেষ পর্যন্ত একটি আলাদা মঞ্চ যারা সারা দেশের সকল গণজাগরণ মঞ্চকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধতার কথা ভাবতে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যক্তিক পর্যায়ে তারা যে ঐক্যবদ্ধতা কিংবা সবাইকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করবে এমনটা হওয়া সম্ভব না। এই অসস্তি, অনাহুত উপযাচক হয়ে যাওয়ার বোধটুকু গিলে ফেলে আমরা সামনের দিকে তাকাই। আমাদের লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে এসে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের এক সাথে আওয়াজ তুলতে হবে
যুদ্ধাপরাধীদের সাংগঠনিক বিনাশ চাই।